আদিবাসী দিবসঃ একটি দীর্ঘশ্বাস

নেংমিঞ্জা বাপন
Published : 9 August 2016, 04:09 PM
Updated : 9 August 2016, 04:09 PM

প্রতি আগষ্ট এলে শ্বাসপ্রশ্বাস  বেড়ে যায় । আগষ্টের ৯ এলেই হৃদপিন্ডের ঢুপঢাপ আওয়াজ শুনতে পাই । আদিবাসীদের হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গিয়ে চাঙ্গা হতে শুরু করে। কিন্তু চাঙ্গা হতে শূরু করার পেছনে আদিবাসীদের পরিশ্রান্ত দেহটার মিল নেই । বছরজুড়ে নিজেদের আদিবাসী ভাবা এই দেশের জনগণরা যত পৃষ্ঠাজুড়ে খবররের কাগজে আসে সেই কাগজ দিয়ে নিশ্চিন্তে শরীরের প্রতি ইঞ্চি ঢেকে দিতে পারবে । দেহের ভেতর সেই হৃদপিন্ডের কাঁপন আগস্ট এলে চাঙ্গা হয় কারণ শুধুই একটি পাওনা  স্বীকৃতির টান  "আদিবাসী" । কিন্তু কি হবে আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে? প্রশ্নটার উত্তর আদিবাসীদের কাছে একটাই তাঁরা শান্তিতে বাংলায় বেঁচে থাকবে। তাহলে শান্তির পায়রা উপহার দিতে কি সমস্যা এই রাষ্ট্রযন্ত্রের ? প্রশ্নটি একবার একজনকে করেছিলাম । তিনিও একজন আদিবাসী। তিনি বলেছিলেন শান্তির পায়রা এই দেশে নেই । যৌক্তিক উত্তর । কিন্তু যৌক্তিক উত্তর দিতে গিয়ে সত্যিকে চাপা দিয়ে দেওয়াটা হয়ত ঠিক হবেনা। মিথ্যাকেও যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করা যায় । কিন্তু যুক্তির সাথে সত্য একই সাথে একই রাস্তায় হাঁটতে হবে এমনও বোধয় নয় । দেশে এখনও শান্তির পায়রা রয়েই গেছে । কিন্তু পায়রাটা বন্দি কোথাও । স্বার্থ অথবা রাজনৈতিক অথবা বৈষম্যের পিঞ্জিরায় । এই পিঞ্জিরার ভয়ও হতে পারে । ভয়টা কিসের? আদিবাসীরা দেশ উজাড় করে দেবে? আদিবাসীরা নিজেদের জন্য দেশ চাইবে ? নাকি আদিবাসীরা দেশের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেবে? শত কোটি প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর দেবার কেউ নেই ।

এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০১৬ এর মুলসুর "আদিবাসীদের শিক্ষা,ভূমি ও জীবনের অধিকার"।  আদিবাসীরা শিক্ষিত হচ্ছে । প্রত্যেকের  জীবনের অধিকার জানতে গিয়ে অধিকার সংকটকে কাছ থেকে দেখছে । সমস্যার ছড়াছড়ি নিজের চোখে অবলোকন করছে । এর মধ্যে আসছে সর্বপ্রথম ভূমি সমস্যা । এই ভূমি সমস্যা এতোটাই প্রকট যে একমাত্র এই সমস্যা একাই লক্ষ লক্ষ সমস্যা জন্ম দিতে পারে । কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারে নাহার পুঞ্জি উচ্ছেদ নোটিশকে আপনি যে ক্যাটাগরিতে ফেলতে যাবেন সেটিই হলো ভূমি সমস্যা। তাঁর আরও কিছুদিন পরে মধুপুরে রিজার্ভড ফরেস্ট এর প্রজ্ঞাপন জারির ব্যাপারটিকে যে ক্যাটাগরিতে ফেলবেন সেটিও ভূমি সংক্রান্ত। ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দিলে সেখানকার মানুষ থাকবে কোথায় ? তারপর শিক্ষাটা নেবে কোথায় ? কিন্তু এই ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার আতুর ঘর কোথায় ? এই সমস্যাগুলির বেশীর ভাগই আসছে প্রশাসন বা রাষ্ট্র পরিচালকদের হাত ধরেই । এখন আপনি হয়তও সেই স্থানে বসে বলতে পারেন আদিবাসী নারী ধর্ষিত হচ্ছে দেশের কিছু নরপশুর কারণে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিছু মানুষের বৈষম্য নীতির কারণে, প্রতিটি পদক্ষেপে নির্যাতিত হচ্ছে মানবতার অভাব থেকে। কিন্তু আদিবাসীদের এইসকল ছোট ছোট সমস্যাগুলোকে জেনে অথবা না জেনে আপনি নিজেই কিভাবে উস্কে দিচ্ছেন তা যদি প্রজ্ঞাপন জারি বা উচ্ছেদ নোটিশ থেকে শিখতে না পারেন, তবে আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে দেশের জন্য ঝুঁকি হয়ে যাবে সে কথা ভেবে হয়তও অনেকেই মনে করবেন যে সে ঠিকটাই ভাবছে । এখন এতোগুলো কথা বলার মানেটা হলো, এতো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলেই হয়তও স্বীকৃতি শুধুই মুখের বয়ান । যখন এই নাক চ্যাপ্টা, পাহাড়ীদের সমস্যার শেষ হতেই নেই তবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিটা  হয়ত অরণ্যে রোদন । কিন্তু তবুও "আদিবাসী বান্ধব"  শব্দের পূজারীরা আজও দেবতার গলায় মালা দিয়েই চলেছে !

আমরা কোন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যেমন বলি তেমনি সমাধান করার রাস্তাকে রাজনৈতিক প্যাঁচে ফেলে চেতনার অবমাননাও করি । এই দেশের স্বাধীনতা বাংলার মানুষের রক্তের সমুদ্রে ধৌত । এখানে বাঙ্গালী ছিল, চাকমা ছিল, গারো ছিল, মার্মা, ত্রিপুরা সহ আরও অনেক জাতি গোষ্ঠীর রক্তে পাওয়া । কিন্তু বহমান সময়ের স্রোত যখন স্বাধীনতার সেই এক সাগর রক্তের স্রোতের চাইতেও মহা পরাক্রমে বইয়ে চলে তবে বৈষম্য থাবা মেরে একথাল মাংস উঠিয়ে নেয় । আর আমরা একই ঘরে বসেও আরেকজন মাংসহীনকে দেখে তিরস্কার করি । এইসব রক্তাত্ব আদিবাসী ভূমি, ধর্ষিতার কাপড়ে প্যাঁচানো পাহাড়ের কান্না প্রতিদিন ভারি হয় ধীরে ধীরে । হৃদপিন্ডটা ঢিব ঢিব করে আওয়াজ ছাড়তে থাকে। উপজাতি, নৃগোষ্ঠি অভিশাপের আড়ালে সব কিছুই চাপা পরে যায় প্রতিদিন ।