মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সোশাল মিডিয়া

রাহমান নাসির উদ্দিন
Published : 23 March 2011, 07:20 AM
Updated : 4 July 2013, 04:22 PM

সমকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সে বিচার কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাহবাগের ব্যাপক গণজাগরণ, জামায়াত-ব্রেইনজাত আস্তিক-নাস্তিকতার রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা, হেফাজতে ইসলামের জন্ম, রাজনীতিতে কথিত ধর্মীয় শক্তির আবির্ভাব ব্যাপক আলোচিত ঘটনা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তথাকথিত ধর্মবিরোধী আপত্তিকর ব্লগ লেখার অভিযোগে ব্লগারদের আটক করা হল। এর পরপরই শাপলা চত্বরের অভিযান, সে অভিযান কেন্দ্র করে কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও পরবর্তীতে একজন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে গ্রেফতার সবই আলোড়ন তুলেছে।

সম্প্রতি আটককৃত ব্লগারদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ওদিকে ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস কেন্দ্র করে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সাত বছরের জেল হল। এসব ঘটনা ও ঘটনা-পরম্পরা বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিশীলতায় সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবার একটি স্পেস তৈরি করেছে।

শুরুতেই 'মুক্তচিন্তা', 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা' ও 'সোশাল মিডিয়া' বলতে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি সেটার কার্যকরী সংজ্ঞা দিয়ে বিষয়টি সাফ করে নিই। এখানে 'মুক্তচিন্তা' বলতে ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা বা ভাবনা এবং 'মতপ্রকাশ' বলতে সে চিন্তাভাবনা আপত্তি-বিপত্তিহীনভাবে মাধ্যম-নিরপেক্ষ প্রকাশ করার সুযোগ ও অধিকার বোঝানো হয়েছে। আর 'সোশাল মিডিয়া' বলতে ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, জিমেইল, পালটক, এওএল, স্কাইপে, ওয়ার্ডপ্রেস, ব্লগস্পটস, ইউটিউব, বিভিন্ন ফ্রি এবং পেইড ব্লগ প্রভৃতি মাধ্যম বোঝানো হয়েছে যার মাধ্যমে সমাজের মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে পারষ্পরিক ও সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে।

এ যে সোশাল মিডিয়া যার মাধ্যমে একদিকে যেমন সামাজিক যোগাযোগের একটি 'স্পেস' তৈরি হয়েছে এবং কানেকটিভিটির সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছে; অন্যদিকে 'যোগাযোগ' যে একটি শক্তিশালী সামাজিক 'প্রেসার-গ্রুপ' হতে পারে এবং সে মোতাবেক একটি 'রাজনৈতিক শক্তি' হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, তারও ক্রমান্বয়ে নজির স্থাপন করে চলেছে। আর ব্লগিং তো বিশ্বব্যাপী রীতিমতো সনাতন সাংবাদিকতার পাটাতন ধরে নাড়া দিচ্ছে। অনেকে এটাকে বলছেন, অল্টারনেটিভ জার্নালিজম বা বিকল্প-সাংবাদিকতা; কেউ-বা বলছেন সিটিজেল জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা। সংজ্ঞার এ সীমানা ধরেই এ নিবন্ধের আলোচনার ভূমিকার সদর থেকে বিশ্লেষণের অন্দরমহলে প্রবেশ করা যাক।

বিশ্বব্যাপী মুক্তভাবে চিন্তা করা এবং নিজের চিন্তা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, "Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers." (Article 19: Universal Declaration of Human Rights)

মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি। সে তার জীবন, জগৎ, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব নিয়ে চিন্তা করে। কেননা সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের যে ঘটমান-রূপান্তর তা কোনো-না-কোনোভাবে তার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কোনো-না-কোনোভাবে তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। তাই সামাজিক, আঞ্চলিক, দৈশ্বিক বা বৈশ্বিক যে কোনো রূপান্তরের অনিবার্য ভোক্তা এবং যে কোনো পরিবর্তনের আলটিমেট গ্রহীতা হিসেবে মানুষ সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বের যে কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ 'স্টেকহোল্ডার'।

তাই চলমান সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার নানান বিষয়-আশয় নিয়ে মানুষের নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। নিউ লিবারেল ডেমোক্রেসি বলি আর পশ্চিমা ঘরানার ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা বলি কিংবা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাগুজে 'পাবলিক রিপাবলিক' বলি– মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয়।

কয়েক দশক আগেও যেহেতু মতপ্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম ছিল ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া এবং সেগুলোকে কোনো-না-কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করত সমাজের এলিট বা শাসকশ্রেণি– তাই গণমানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা 'কাজীর গরুর মতো কিতাবে থাকলেও গোয়ালে ছিল না'।

কিন্তু সোশাল মিডিয়ার আবির্ভাব আমজনতার বা গণমানুষের নিজের 'রিঅ্যাকশন' প্রকাশের সে সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজের মত-চিন্তা-ভাবনা সম্পাদক সম্প্রদায়ের, যারা নিজেরাও কোনো-না-কোনোভাবে সমাজের এলিটশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত– তাদের হাতে সম্পাদনার করাতমুক্ত হয়ে প্রকাশ করার একটা অসাধারণ মওকা তৈরি করে দেয়। তাই মূলধারায় গণমাধ্যমের পাশাপাশি সোশাল মিডিয়াও একটি বিকল্প ধারার গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সমাজে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করে।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার যেমন কোনো রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতির বেড়াজালে সীমাবব্ধ নয়, তেমনি সে অধিকার ব্যক্তি, সমাজ, অঞ্চল ও বিশ্বের সীমানার বেদিতেও আবদ্ধ নয়। আর এ সীমারেখা অতিক্রম করার অত্যন্ত সহজতর ও দ্রুততর মাধ্যম হচ্ছে সোশাল মিডিয়া। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বিশ্বের কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তের কোনো প্রান্তিক মানুষের মতামত এ মিডিয়া হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য প্রত্যন্ত প্রান্তরে। সেকেন্ডের মধ্যে প্রান্ত থেকে প্রান্তরে ব্যক্তির মতামত ট্রান্সমিট করার সহজ কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে সোশাল মিডিয়া। এ প্রবাহে কোনো বর্ডার নেই, চেকপোষ্ট নেই, ভিসা কিংবা পার্সপোর্ট নেই, ইমিগ্রেশন নেই, ইমিগ্রেশনের হয়রানি নেই।

ফলে মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সোশাল মিডিয়ার দ্রুততম যোগাযোগের সৌজন্যে একটি প্রযুক্তিগত ন্যায্যতা পায়। বিশ্বব্যাপী মিডিয়া অধ্যয়নে সোশাল মিডিয়া সেভাবেই বিরাট জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কেননা এ মিডিয়া কোনো কোনো সময় মূলধারার মিডিয়ার পাশাপাশি ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে পাঠক কিংবা সংবাদের ভোক্তাশ্রেণিকে দুটি কম্পিটিং ধারণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। নতুন করে তৈরি করছে রাজনৈতিক ডিসর্কোর্স কিংবা কাউন্টার-ডিসকোর্স। সমাজের গতিশীলতায় নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্রে এ মিডিয়া একটি অভূতপূর্ব প্রভাব-বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে তার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে।

অকুপাই ওয়ার্ল্ড ষ্ট্রিট, মিশরের তাহরির ষ্কোয়ার, দিল্লির জন্তর-মন্তর, ঢাকার শাহবাগ এবং সম্প্রতি ইস্তাম্বুলের ব্যাপক গণজমায়েত সোশাল মিডিয়ার শক্তিশালী প্রভাব-বিস্তারকারী ক্ষমতার একবিংশ-শতাব্দীয় নজির হয়ে থাকবে। যেহেতু বাংলাদেশও মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সামাজিক মিডিয়ার ব্যাপক বিস্তার, সেহেতু বাংলাদেশেওে এসব অধিকার সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সোশাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান বিস্তার, ব্যাপকতা, জনপ্রিয়তা, জনসম্পৃক্ততা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিও সমাজে নতুন জায়গা করে নেওয়ার জন্য পপুলার মিডিয়া হিসেবে আবির্ভূত।

কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা এবং শাসকশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে চিন্তার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা ক্রমবর্ধমান সাংঘর্ষিক সম্পর্কের রূপ ধারণ করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সোশাল মিডিয়াকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে তা নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলে যা কোনো কোনো সময় মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের সর্বজনীন স্বীকৃত মানবাধিকারের ফ্রেমওয়ার্কে সোশাল মিডিয়ার অবস্থান এবং সোশাল মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা-কৌশল উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।

সম্প্রতি বেশ কজন ব্লগারকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র মুক্তচিন্তার এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে সামান্য হলেও বাধা সৃষ্টি করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কেননা নাস্তিকতার অভিযোগে যে ব্লগারদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ইসলামের অবমাননা কিংবা রাসুলের অবমাননার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটার যথাযথ প্রমাণাদি এবং গ্রেফতারের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই কেবল হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে ব্যাপক জনসন্দেহ রয়েছে।

তাছাড়া সম্প্রতি 'সন্ত্রাস-বিরোধী আইন (সংশোধিত), ২০১৩' পাস করার মধ্য দিয়ে সরকার ব্লগ, ফেসবুকের স্ট্যাটাস, টুইটারের টুইটস, লেখা, ছবি এবং ভিডিওকে আইনি কার্যক্রমে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করার ধারা সংযুক্ত করেও রাষ্ট্রীয় জুজুর ভয়ের মধ্য দিয়ে সোশাল মিডিয়াকে এক ধরনের পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের রাষ্ট্রীয় খড়গ ঝুলিয়ে দিয়েছে। আবার অতিসম্প্রতি ফেসবুকের একটি ম্যাটাফরিক স্ট্যাটাসের রাজনৈতিক ইন্টারপ্রিটেশন থেকে 'প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি' হিসেবে আদালত বিবেচনায় নিয়ে সে ফেসবুকারকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে যা ভবিষ্যতে ফেসবুকের স্ট্যাটাস প্রদানের মাধ্যমে মানুষের যে স্বাধীন মত এবং মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাভাবিক প্রবণতা সেখানে এক ধরনের স্ব-আরোপিত সেন্সরশীপ বসানো হল।

এটা মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সোশাল মিডিয়ার কার্যকর বিকাশের জন্য কোনোভাবেই সহায়ক নজির হিসেবে বিবেচিত হবে না। বরং ভবিষ্যতে এসব নজির যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্থা করার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে (অপ)ব্যবহৃত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাছাড়া বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত 'অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা ২০১২' মূলত মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের লিগ্যাল হাতিয়ার ছাড়া কিছুই নয়।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, সোশাল মিডিয়ায় জনগণের যে মতামত প্রকাশিত হয়, সেটা সমাজে বিদ্যমান তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টির একটি তাৎক্ষণিক 'ভয়েস'। তাই একে নিয়ন্ত্রণ বা এর কণ্ঠরোধ করার পরিবর্তে একে উন্মুক্ত ও অবারিত করার মধ্যেই রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার রসদ সংগ্রহ করা সম্ভব। ডিজিটাল বাংলাদেশকে একটি রাজনৈতিক বুলি হিসেবে ব্যবহার না করে সত্যিকার অর্থে মানুষের ভাবনার, চিন্তার, আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাটাকে সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেওয়ার মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের বীজ রোপিত আছে।

একটি রাফ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৪৮টি বাংলা ব্লগ আছে, আড়াই লাখ নিয়মিত ও অনিয়মিত ব্লগার আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটির সামান্য বেশি। এর মধ্যে ২৮ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ফেসবুক ব্যবহার করে। ২০০৪ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেসবুকের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে পৃথিবীতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৬তম।

সুতরাং বাংলাদেশে সোস্যাল মিড়িয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে সংযুক্ত হচ্ছে এবং মানুষের এ সংযুক্তিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার মধ্যেই সমাজের গুণগত রূপান্তর ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্ভব। কেননা যত বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হবে, পৃথিবীর সঙ্গে এদেশের সংযোগ তত বেশি বিস্তৃত হবে। এদেশের সম্ভাবনা তত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

একটি উদাহারণ দিই। ২০১০ সালের ৩০ মে বাংলাদেশে ফেসবুক সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে কথিত ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের ঘটনা কেন্দ্র করে। ফলে এদেশের ২৫ থেকে ২৮ লাখ মানুষ গোটা দুনিয়ার সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু সাতদিনের মধ্যেই সরকার সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।

এছাড়া ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর 'ইনোসেন্স অব মুসলিমস'-এর প্রচার বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশে ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় আট মাস পর অতিসম্প্রতি ৫ জুন, ২০১৩ বাংলাদেশে ইউটিউব খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এ আট মাস বন্ধ থাকার কারণে বাংলাদেশ কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার একটি নমুনা পাওয়া যায় জার্মান রেডিও 'ডয়েচে ভ্যালেকে দেওয়া 'বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের' (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুরের এক সাক্ষাৎকারে।

তিনি বলেছেন, ''২০১২ সালে আউটসোর্সিং-এর পরিমাণ প্রায় ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তখন বাংলাদেশে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন ডলারের কাজ হয়েছে। কিন্তু এ আটমাস ইউটিউব বন্ধ থাকার কারণে সেটা মোটামুটি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে।''

অতএব সোশাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের নামে একদিকে যেমন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অস্বীকার ও অসম্মান করা হয়, অন্যদিকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতার কারণে দেশের বড়মাপের অর্থনৈতিক ক্ষতি বয়ে আনা হচ্ছে।

তাই মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সোশাল মিডিয়ার আন্তঃসম্পর্ককে কেবল দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে কিংবা রাষ্ট্রবাদী ধারণা থেকে বিবেচনা না করে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তার যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মূল্য তা বিবেচনায় নেওয়াটা জরুরি।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে কেউ কেউ রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালান– এ মর্মে নানান অভিযোগ শোনা যায়। কেউ-বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, আপত্তিকর ব্যঙ্গচিত্র, ফটোশপ করা ফেব্রিকেটেড ছবি এবং এডিট করা ভিডিও ফুটেজ দিয়ে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার এক ধরনের অপচেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এখানে অবশ্যই এটা মনে রাখা জরুরি যে, স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। সমালোচনা মানেই গালাগালি নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানেই রুচিহীন, সমাজ-অসম্মত ও নগ্ন ভালগারিপনা নয়। এটাও মনে রাখা জরুরি। তবে সোশাল মিডিয়ার শক্তি এতটাই 'কাউন্টার রেসপনসিভ' যে, তার নিজের মধ্যেই এসব মিথ্যাচার, নষ্টাচার ও ফেক স্ট্যাটাস মোকাবেলা করার যথেষ্ট শক্তি সে আপনা-আপনিই উৎপাদন করে।

তাই এ মিডিয়ার নেতিবাচক দিকটি মোকাবেলা করার কৌশল হিসেবে মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা একদিকে যেমন মানুষের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন, অন্যদিকে এটি নিতান্তই রাষ্ট্রীয় বেকুবিপনা।

কেননা "দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।''

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে হুমবোল্ট ভিজিটিং ফেলো হিসেবে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।