পড়ন্ত বিকেলে রোজ গার্ডেনে

বাসন্ত বিষুব
Published : 25 July 2016, 07:01 PM
Updated : 25 July 2016, 07:01 PM

পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন দেখার বাসনাটা অনেক পুরনো। এই বাসনা জন্মেছিল দুটো কারণে। প্রথমত, যে কোন প্রাচীন স্থাপনা আমাকে আপ্লুত করে এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের আঁতুর ঘর বলে। কী চমৎকার প্রেক্ষাপটই না ছিল তখন, যখন নিম্ন বর্ণের হিন্দু জমিদার ঋকেশ দাস বলধা'র জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ও উচ্চ বর্ণের কৌলিন্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এই জলসাঘর বা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। অপমান কিংবা তাচ্ছিল্য থেকেও যে দারুণ এক স্থাপনা সৃষ্টি হতে পারে ঋকেশ দাশের রোজ গার্ডেন প্যালেস তারই প্রমাণ। আমি আপ্লুত হয়ে যাই যখন কল্পনার ক্যানভাসে আমার সামনে ভেসে উঠে দুধ-সাদা প্রাসাদের সামনে অসংখ্য রক্ত-লাল গোলাপ। অতীতই হয়তো একমাত্র বাস্তব চিত্র যাকে দেখতে হয় কল্পনার চোখে। এবং সেই ১৯৩৯ সাল! সেটাও কি কম ঐশ্বর্যময়! তখন কি কেউ জানত, দাপুটে মুসলিম লীগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ওই সফেদ বাড়িতে যে দলটির জন্ম হল সেটিই এক সময় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখন্ড সৃষ্টি করবে! কেউ ভাবুক আর নাই ভাবুক, ঋকেশ দাসের রোজ গার্ডেন প্যালেস আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের জীবন্ত অংশ।

আমার রোজ গার্ডেন দেখার বাসনা পূরণ হয়েছে, তবে এই মুহূর্তে সেটাও যথেষ্ট পুরনো ঘটনা। অর্থাৎ ওখানে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক মাস আগে। রোজ গার্ডেনের উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা ছিল আকস্মিক এবং ঘুরে দেখার সময়টুকুও ছিল যতকিঞ্চিৎ। কোন এক কাজে গিয়েছিলাম মতিঝিলে। কাজ শেষে মনে হল, দেখে যাই, কাছেই তো।
রোজ গার্ডেন ইতিহাসখ্যাত স্থাপনা– তামাম দুনিয়ায় না হোক, অন্তত এই অঞ্চলে। আমার ধারণা ছিল, ওটার খ্যাতি এখনও অটুট আছে। হ্যাঁ, আছে, তবে বোধ করি শুধু তাদের কাছে যারা ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। কারণ হতবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, টিকাটুলির মানুষের কাছে ওটার খ্যাতি প্রায় বিলিন হয়ে গেছে। এ কথা বলছি এ কারণে যে, বাড়িটার হদিস বের করতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ঐ এলাকার দোকানদার আর পথচারীদের রোজ গার্ডেন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে যে জবাব পেয়েছি তাতেই আমার এই ধারনা জন্মেছে। যাদের জিজ্ঞেস করেছি তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বলেছেন, 'এই এলাকায় কোন রোজ গার্ডেন (গোলাপ বাগান) নেই। এত বড় 'গোলাপ বাগান' থাকলে তারা নাকি ঠিকই চিনতেন। হতাশ হয়ে আমাকে বলতে হয়েছে, রোজ গার্ডেন আসলে কোন গোলাপ বাগান না, ওটা ছোট-খাট একটা জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির কথা শুনে দু-একজন অবশ্য আশার আলো দেখিয়ে বলেছেন, 'আরেকটু সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন।'

আমি সামনেই এগুলাম। এসেছি যখন, পিছ পা হবার তো সুযোগ নেই। শেষ পর্যন্ত ছোট একটা মোবাইলের ফ্লেক্সিলোডের দোকানে একই প্রশ্ন করে কিছুটা আশার সঞ্চার হল। দোকানীর কথা মত প্রথমে সোজা, তারপর ডানে এবং তারপর বামে গিয়ে রোজ গার্ডেনের দেখা পেলাম। গলিপথের চেহার দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল, এটা আদিম পথ নয়। অর্থাৎ ঋকেশ দাস এ পথ দিয়ে যাতায়াত করতেন না। আমার এই ধারণা পরে সত্য হয়েছে। রোজ গার্ডেনের পুরনো একটা ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েছি, প্যালেসের সামনে এখন যে পুকুরটা আছে ওটা আগে ছিল না। যেখানটায় এখন পুকুর সেখান দিয়েই ছিল মূল প্রবেশ পথ। পুকুরের ওপারে প্রাচীন প্রবেশ পথের পিলার দুটো এখনো আছে। ওই পথ দিয়েই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে তৎকালীন বিত্তশালীরা লাল গোলাপ বাগানের ভিতর দিয়ে নর্তকীদের নাচ দেখতে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন।

রোজ গার্ডেন প্যালেসের দেখা পেলাম ঠিকই তবে উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে। গেট বন্ধ। গেট বন্ধ থাকলে যা করতে হয় আমিও তাই করলাম। বেশ অনেকক্ষণ, তাও প্রায় ৫ থেকে ৬ মিনিট! কোন সাড়া-শব্দ পেলাম না। গেটের এক পাশে একটু ফাঁক ছিল, ওদিক দিয়েই ভিতরে দেখার চেষ্টা করলাম। না, তিনটা ছাগল ছাড়া আর কাউকেই চোখে পড়ল না। একটা মা, বাকি দুইটা ছানা। ওদের তো আর কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। গেট খোলার দায়িত্ব তো আর ওদের না! তাই আবারও টোকা দিলাম। এবারও কয়েক মিনিটি চলে গেল। সামনের গলি পথে স্থানীয় ছেলেপুলেরা ক্রিকেট খেলছিল, ক্যামেরা হাতে দরজায় টোকা দিতে দেখে ওরা বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। ওরা নিশ্চই ভাবছিল, 'বেচারা!' ওদের চাহনিতে আমিও বিব্রত বোধ করছিলাম। কারণ এই গলিতে ঢুকে প্রথমে ওদেরকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা, রোজ গার্ডেনটা কোথায়?' ওরা বলেছিল, 'এইটাই তো!' ভাবটা এমন: রোজ গার্ডেনের সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে দেখেন না! ওরা জানতে চাইল: 'আপনি কি সুটিং এর জন্য ভাড়া নিতে আসছেন?' আমি বললাম, 'না।' ওরা বলল, 'নাটক-সিনেমার সুটিং ছাড়া এখানে কাউকে ঢুকতে দেয় না।' আমি হতাশ হলাম, তবে ওদের বুঝতে দেইনি। ভাবলাম, চেষ্টা করে দেখি।

গেটের ফাঁক দিয়ে আবারও ভিতরে তাকালাম। এবার ছাগলের সাথে দুইটা কুকুরও চোখে পড়ল। দেশী। একটু বিরতি নিলাম। টোকা দেব, নাকি চলে যাব তাই ভাবছিলাম। কুকুর বলে কথা। গেটটা আরো একটু ভাল করে দেখে নিলাম। 'কুকুর হইতে সাবধান' এ কথা কোথাও লেখা নেই! তবে আশার কথা, গেটে এমন কোন ফাঁকও নেই যেখান দিয়ে ওগুলো মাথা বের করতে পারবে। তাছাড়া গেটটা যথেষ্ট উঁচু, সুতরাং জাম্প করে আসার সুযোগও ওরা পাবে না।
বাইরে পড়ন্ত বিকেলের তীর্যক রোদ। ভালই জ্বালাপোড়া আছে। রোদের দাপটে মাথাটা খুব একটা কাজ করছিল না। তবুও ওই আধা অকেজো মাথায় একটা বুদ্ধি এল: যদি জোরে টোকা দেই তাহলে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করবে, আর সেই সুযোগে দাঁড়োয়ানের দেখাও মিলবে। তো, দিলাম টোকা। বেশ জোরে। শব্দও হল, কিন্তু কুকুরগুলোর কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না। বিকেলের রোদে ওরাও ক্লান্ত ছিল হয়তো। তবে কুকুরের প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও দাঁড়োয়ানের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। টোকার শব্দ তার কানে পৌঁছেছিল। ভিতর থেকে বৃদ্ধ দাঁড়োয়ান বলল, 'কার কাছে আসছেন?'
বললাম, 'ঘুরতে আসছি। রোজ গার্ডেন দেখব।'
দাঁড়োয়ানের সোজা কথা, 'ঢুকা যাবে না। নিষেধ আছে।'
মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। বললাম, 'অনেক দূর থেকে আসছি, ফিরে যাব?'
উনি বললেন, 'তাহলে দাঁড়ায়া থাকেন। গেটের সামনে থেকে সরে দাঁড়ান, স্যারেরা আসবো।'
কী আর করার! চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে একটা সাদা গাড়ি এসে থামল। তবে গাড়িটা ভিতরে গেল না, গেল দুজন মানুষ। দেখে মনে হল, ওনারা কেউই 'স্যার' না। গাড়ি থেকে নেমে একজন জিজ্ঞেস করলেন, 'কার কাছে আসছেন?' উনি রোজ গার্ডেনের কেয়ারটেকার, পরে শুনেছি।
বললাম, 'রোজ গার্ডেন দেখতে এসেছি।'

'আপনি সাংবাদিক?'
সাথে ক্যামেরা থাকার এই এক জ্বালা। সবাই সাংবাদিক মনে করে। সাংবাদিক দেখলেই তারা ভরকে যায়। বললাম, 'না, তবে পত্রিকায় অল্প-স্বল্প লেখি।'
'লেখালেখি করেন! তাহলে তো ভিতরে যেতে পারমিশন লাগবে।'
আমি বললাম, 'যার পারমিশন লাগবে তার সাথে কথা বলা যাবে?'
ওনি বললেন, 'না, ম্যাডাম ঘুমাচ্ছেন।'
আমি বললাম, 'কোন ম্যাডাম?'
কেয়ারটেকার বললেন, 'এই বাড়ির মালিক?'
তখন মনে পড়ল, রোজ গার্ডেন বহু বছর ধরেই ব্যক্তিমালিকানায় আছে। এই প্রাসাদ কিংবা জলসা ঘর ঋকেশ দাসকে দেউলিয়া করেছিল। ১৯২৭ সালে বাড়িটা তিনি বিক্রি করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনাগড়ের জমিদার বশির উদ্দিন সরকারের কাছে। এরপরও হাত বদল হয়েছে। এখন যিনি মালিক তিনি একজন ব্যারিস্টার। রোজ গার্ডেন প্যালেসের বর্তমনা নাম 'হুমায়ুন বাড়ি।' তবে মার্বেল পাথরে 'রোজ গার্ডেন প্যালেস' লেখা ফলকটা এখনও আছে।

কেয়ারটেকার জানতে চাইলেন, 'আপনার বাড়ি কোথায়?' বললাম, 'ঢাকাতেই থাকি।' ওনার প্রশ্ন, 'আপনার বাড়ি কোন জেলায়?'
বললাম, 'টাঙ্গাইল।'
'টাঙ্গাইল! টাঙ্গাইলের কোথায়?'
মনে মনে বললাম, 'তা দিয়া আপনার দরকার কী!' তবে স্বশব্দে যে জবাব দিয়েছিলাম তা ভদ্রচিতই ছিল। তিনি তো মহাখুশি। বললেন, 'আমার বাড়িও টাঙ্গাইলে।' আমিও খুশি হওয়ার ভান করে বললাম, 'ও আচ্ছা।'
আমরা দুজনই একই জেলার মানুষ, এ কথা জানাজানি হওয়ার পর হাওয়া বদলাতে শুরু করল। তিনি বললেন, 'আমরা তো একই জেলার মানুষ। আসছেন যখন, ভিতরে আসেন। তবে ম্যাডাম একটু পরেই হাঁটতে বের হবেন। তার আগেই ছবি তুলতে হবে।' আমি বললাম, 'শিওর। কোন সমস্যা নেই।' ভিতরে ঢুকার সময় মনে মনে বললাম, 'দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে ছবি তুলার অভ্যাস আমার আছে।'
রোজ গার্ডেনের নয়নাভিরাম দুধ-সাদা ভবনটি তালাবদ্ধ ছিল। ভিতরে যাবার সুযোগ নেই। বাইরেই ঘুরাঘুরি করলাম। একবার এই মাথায় যাই তো আরেকবার ঐ মাথায়। যত দ্রুত কাজটা শেষ করা যায় ততই ভাল। ওনার 'ম্যাডাম' আমাকে দেখে ফেলবেন এই ভয়ে নয়। আমাকে দেখে তিনি যদি কেয়ারটেকারকে বকুনি দেন সেই ভয়ে। লোকটি আমাকে ঢুকতে দিয়েছে, সেজন্য তার প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা বোধ থাকা উচিত।

জমিদার ঋষিকেশ দাস নির্মিত এই জলসা-ঘরের সামনে শ্বেত মার্বেলের অনেকগুলো মানব মূর্তি আছে। ভেঙ্গেও গেছে কোথাও কোথাও। তারপরও সুন্দর মূর্তিগুলো। ভবনের সামনে বেশ বড়সর আঙ্গিনা। আঙ্গিনার মাঝখানে একটা ফাউন্টেন। এখানেই এক সময় গোলাপ বাগান ছিল। সাদা ভবনের সামনে লাল গোলাপ– নিশ্চই খুব অসাধারণ দৃশ্য ছিল ওটা। এখন ওখানে শুধুই সবুজ ঘাস। সবুজ আঙ্গিনার পর একটা পুকুর, সিঁড়িও আছে। পানি খুব একটা স্বচ্ছ না। তবে গোসলের উপযোগী। অনেকে গোসলও করে হয়তো। সিঁড়ির সামনেই লোহার তোরণ। তবে বেশ নিচু। ওটার ভিতর দিয়ে আসা-যাওয়া করা দুরহ। তোরণ প্যাঁচিয়ে রেখেছে বোগেনভিলা। সামনের গোলাপ বাগানটা এখন না থাকলেও প্রাসাদের ঐশ্বর্য এখনও অটুট আছে। অথচ যেখানে প্রবেশ না করতে পারার জন্য এই রোজ গার্ডেনের সৃষ্টি সেই বলধা গার্ডেন এখন বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায়, ঐশ্বর্যহীন। অসামাজিক কর্মকান্ড দিনে দিনে ওটাকে হত্যা করছে। একেই হয়তো বলে, মহাকালের নির্দয় বিচার।

ভিতরে না ঢুকেও রোজ গার্ডেন প্যালেস দেখা হল আমার। সময় নিয়েছিলাম বড়জোর ২০ মিনিট। কেয়ারটেকারকে ধন্যবাদ দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম। রোদের তেজ ততক্ষণে অনেকখানি কমেছে, ছেলেগুলো তখনও ক্রিকেট খেলছে। ওদের একজন বলল, 'দেখতে পারছেন?' বললাম, 'হু।' ওরা আবারো খেলায় ব্যস্ত হল আর আমি কে এম দাস লেন থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলাম গুলিস্তানের দিকে। একটা লোক অনেকগুলো ছাগলকে দড়ি দিয়ে বেধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওই দৃশ্য দেখে কেন জানি মনে হল, ছাগলেরা বোধহয় জন্মসূত্রেই ঘাড়ত্যাড়া প্রাণি।