জঙ্গিবাদ দমনে প্রয়োজন অভীষ্টের ঐক্য, দলের নয়

মোজাম্মেল খানমোজাম্মেল খান
Published : 16 Sept 2011, 07:18 AM
Updated : 3 August 2016, 11:46 AM

গুলশান ক্যাফে ট্রাজেডির পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী, শোক প্রকাশকারীদের মধ্যে এক ইতিবাচক ঐক্যমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেটা হল, সরকারের পরিচালিত সংকট সমাধানের পদ্ধতি এবং নীতিমালার ব্যাপারে। সবচেয়ে অভূতপূর্ব বিষয় ছিল, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এ সংকট থেকে উত্তরণের প্রশ্নে সরকারের কাজের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়।

হামলার পর ৩ জুলাই এক লিখিত বিবৃতিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, "কোনো অর্জনই টিকবে না, যদি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে না পারি। তাই আসুন সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলি।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের একতাবদ্ধ হতেই হবে। কে ক্ষমতায় থাকবে, কে থাকবে না, এটি বড় কথা নয়। একদিন আমরা কেউ থাকব না, কিন্তু দেশটা থাকবে।"

খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এত সুন্দর বক্তব্য আমি কোনোদিন শুনিনি! তাঁর বিবৃতি শুনে মনে হয়েছিল, এটি যতটা না একজন রাজনীতিবিদের পরিচয় বহন করে তার চেয়ে বেশি করে একজন রাষ্ট্রনায়কের।

কিন্তু তার পরের দিন তিনি আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হন! কমান্ডো অভিযান চালাতে দেরি করা হয়েছে– এ অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, "তারা যখন গেছে, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। এত দেরি কেন? এত দেরিতে কেন সে কাজটি করা হল?" তিনি দাবি করেন, এটা সরকারের গাফিলতি বা ব্যর্থতা। সরকারের অযোগ্যতার কারণেই এটি হয়েছে। সরকার আজ পর্যন্ত কোনো ঘটনাই ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারেনি।

খালেদা জিয়া আরও দাবি করেন, "আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অভাবে দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রথম থেকেই সরকার ব্যর্থ। সরকারের উচিৎ ব্যর্থতার দায় নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া।"

স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভাবনা ও পরামর্শ বেরিয়ে এসেছে সরকার সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার প্রশ্নে। কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী যে ধর্মে বিশ্বাসী– দুর্ভাগ্যবশত– তার নামে সন্ত্রাস সংঘটিত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক শেষে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি, কমিউনিটি পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। "তবে ইনশাআল্লাহ, সন্ত্রাসীদের শিকড় উৎপাটন করার মাধ্যমে, আমরা বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করব… কোনো ষড়যন্ত্র আমাদের অগ্রগতি রোধ করতে পারবে না। চলুন একসাথে কাজ করি, আমাদের সমস্ত মতপার্থক্য পিছনে ফেলে এক নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করি।"

২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী আবারও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করে জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বললেন, তাঁর সরকার এসব অপরাধ কোনো অবস্থাতেই বরদাস্ত করবে না। "যাই হোক না কেন, যে নাম বা যে আকারে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের আবির্ভাব ঘটুক না কেন এই সামাজিক অপরাধকে নির্মূল এবং ধ্বংস করতেই হবে।"

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিএনপির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, যাদের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লিঙ্ক আছে এবং যুদ্ধাপরাধের রেকর্ড আছে, তারা ব্যতিত দেশের মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যে একটি সমঝোতা হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, "সাধারণ মানুষের ঐক্য, যা সত্যিই সন্ত্রাসীদের নির্মূলের জন্য প্রয়োজন– তাদের ঐক্য ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে এবং সেই ঐক্য টিকে থাকবে।"

তবে যে দলটি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তারা বলল, "কী করে এই ঐক্য বিএনপি ও অন্যান্য দল ছাড়া গঠিত হয়? কীভাবে একটি জাতীয় ঐক্য সম্ভব বিএনপি ছাড়াই, যে দলটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে?" বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ১৮ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য আমাদের হতাশ করেছে।" তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

জাতীয় ঐক্য নিয়ে এ ধরনের একটি বিতর্কের প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিশেষ দল "Storm 26" নামে একটি অতর্কিত অপারেশন চালায় ২৬ জুলাই। রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি ফ্ল্যাটে চালানো ওই অভিযানে সন্দেহভাজন ৯ জঙ্গির মৃত্যু হয়।

"এটা সবচেয়ে সফল অপারেশনগুলোর অন্যতম। আমরা জঙ্গিদের একটি গ্রুপ নির্মূল করতে পেরেছি", বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, "জঙ্গিরা হঠাৎ ভবনের চতুর্থ তলা থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। প্রতিউত্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের মোকাবিলা করতে হয়।"

এ ঘটনার পরবর্তী কয়েক দিন ধরে নিহত জঙ্গিদের পরিচয় বিস্তারিতভাবে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে রয়েছে রায়হান কবীর নামের একজন। ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানালেন, গুলশান ক্যাফেতে হামলা চালানো বন্দুকধারীদের প্রশিক্ষক ছিল সে।

আবদুল্লাহ নামে নিহত একজনের বাবা বলেন, "এটা তাঁর জন্য অপমান যে তাঁর ছেলে একজন জঙ্গি হয়ে ওঠে।" তা সত্ত্বেও ২৭ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ (যাঁর বাবা মোনেম খানের মন্ত্রী ছিলেন) বললেন, "পুলিশ দাবি করেছে যে কল্যাণপুরে নিহতরা সবাই জঙ্গি ছিল। কিন্তু আমাদের সন্দেহ আছে হতাহতের মধ্যে নির্দোষ মানুষও থাকতে পারে।"

এরই অনুকরণে পরের দিন কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত ব্যক্তিরা আসলেই জঙ্গি কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। নিহতদের সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ হল, কেন তাদের পিঠে গুলি লেগেছে? একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকজন বিএনপি নেতা।

কল্যাণপুরের অভিযান নিয়ে বিএনপির নেতাদের এসব বক্তব্য এবং সংশয়ের জবাবে বিএনপি নেতাদের ওপর নাখোশ হন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখলেন, তাহলে কি জঙ্গিদের সঙ্গে ওই দলের গোপন যোগাযোগ ছিল? সংসদের বাজেট অধিবেশনে সমাপনী বক্তৃতায় তিনি নিহত জঙ্গিদের নিয়ে বিএনপি নেতাদের মায়াকান্নায় আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, "কেন তাদের (বিএনপি নেতাদের) জঙ্গিদের প্রতি এত স্নেহ প্রকাশ পায়? এটাই আমার প্রশ্ন? তারা কি কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত আছেন?"

বস্তুত, নিহত জঙ্গিদের 'নির্দোষ' হিসেবে তুলে ধরার ব্রত নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আকারে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। সাবেক একজন বামপন্থী জাতীয় ছাত্রনেতা– যিনি বর্তমানে একটি কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন– ফেসবুকে লিখেছেন, "কল্যাণপুরে নিহত ৯ তরুণ আসলে জঙ্গি কি না সন্দেহ হান্নান শাহের। বিএনপি তার প্রতিবাদ না করায় ধরে নেওয়া যায় এটা বিএনপিরও বক্তব্য! কিন্তু কেন এমন সন্দেহ? লাশগুলো কেবল কতিপয় জঙ্গির, সে কারণেই কি? যেহেতু এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিশেষ বা সাধারণ নাগরিক, পুলিশ-সেনাদের লাশ নেই, সে কারণেই কি এই সন্দেহ? তাহলে গুলশান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কীভাবে তারা বুঝতে পারলেন, নিশ্চিত হলেন, সেই তরুণরা জঙ্গি ছিল? বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এভাবেই পথ হারাবে! সঙ্গে কি বিএনপিও? দলটি তার কোনো ইস্যুতেই স্থির থাকতে পারেনি। উপযুক্ত নেতৃত্ব ও সিন্ধান্তের অভাবে কেবল পথ খুঁজতেই থাকবে।"

বাংলাদেশের মেরুকরণীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঐক্যের মোহ, যেখানে মেরুকরণের বিভাজন রেখা, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার রক্তমাখা ইতিহাস যে কতটা অবাস্তব– সেটা আবারো সামনে উঠে আসল। ১ জুলাই গুলশান ক্যাফেতে মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে দেশে এবং বিদেশে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করছে। প্রতিবাদে রাস্তায় মানববন্ধন করছে। এইসব প্রতিবাদকারীদের পরিচয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এরা তারাই যারা গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল দিনগুলোতে রাস্থায় নেমে এসেছিল, যারা তাদের হৃদয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন এবং চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং বিচারের প্রক্রিয়াকে দৃঢ়ভাবে সমর্থনে করেন।

গণজাগরণ মঞ্চের সুবর্ণ দিনগুলোতে ঐক্যের যে ব্যাপ্তি ছড়িয়েছিল বিশ্বব্যাপী তার সঙ্গে শুধুমাত্র ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যই তুলনীয়। দুটি স্বর্ণ-অধ্যায়েই ছিল অভীষ্ট লক্ষ্যের ঐক্য, তখন দলের ঐক্যের কোনো প্রয়োজন হয়নি। এটা আবারো প্রমাণ হল যে আমাদের জাতীয় সংকট মোকাবিলায় উদ্দেশ্যের ঐক্যই সত্যিকার পথনির্দেশক নীতি; মেরুকরণীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কল্পনারাজ্যের রাজনৈতিকদলগুলোর ঐক্য নয়।

আর আমাদের জাতীয় চ্যালেঞ্জের এই সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী অতি সঙ্গতভাবেই দৃঢ়তার সঙ্গে পুনরুল্লেখ করেছেন, "সাধারণ মানুষের ঐক্য, যা সত্যিই সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন, তাদের ঐক্য ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে।"