বিকৃতির ঘূর্ণাবর্তে আমাদের উৎসবমানস

বাসন্ত বিষুব
Published : 5 Oct 2011, 12:38 PM
Updated : 5 Oct 2011, 12:38 PM

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ূর বাংলাদেশ ও বাঙালীর পরিচয়ে অনেকগুলো বিশেষণ আছে। বাঙালী অতিথিপরায়ন, উৎসব প্রবণ। বাঙালী ভাবুক, বাঙালী বাউল। বাউলের কোন সমার্থক শব্দ আছে কী? আছে। ক্ষ্যাপা, পাগল। কিংবা হতে পারতো পরিব্রাজক অথবা পরিযায়ী অথবা পথিক। বাউলের যেমন স্থিরতা নেই তেমনি এদেরও নেই। বাঙালী মাত্রেই কী বাউল? হবে হয়তো! বাঙালীর ভূমি পলিমাটির, মনটাও তেমনÑ নরম। পৃথিবীর প্রতিটি বদ্বীপের মত এখানেও হরহামেশা চলে ভাঙা-গড়ার অস্থির খেলা। প্রবহমান নদীর বুক ফুরে যেমন জেগে উঠে আশার বালুচর তেমনি নিরেট বসত ভিটার বুক চিরে বয়ে যায় হতাশার স্রোতস্বিনী। বদ্বীপের এই ভাঙ্গা-গড়ার নিখাদ নির্যাস দিয়েই বোধকরি গড়ে উঠেছে বাঙালীর মনÑ চঞ্চল, আবেগে কোমল। তাই তো এই ভূমির যেদিকেই দৃষ্টি দেয়া হোক না কেন, চোখে পরবে আশা-নিরাশার যুগপৎ পথচলা।

বাঙালী উৎসব প্রবণ, উৎসবের অভাব নেই বাঙলায়। নবান্ন, নববর্ষ কিংবা বসন্ত, বর্ষা- এসবই আমাদের উৎসবের নাম; হয়তো আমাদের বদ্বীপসুলভ চরিত্রের পরিণাম। উর্বর ভূমির মত আমাদের মনটাও উর্বর। উৎসবে আমরা বেশ সৃজনশীল। আমরা উৎসবে মাতি, অন্যকে মাতাই। দিন যায় আর দীর্ঘ হয় আমাদের উৎসবের তালিকা। জন্মের উৎসব, জয়ের উৎসব, পরীক্ষায় পাশের উৎসব এবং হালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বই উৎসব। যদিও 'বই মেলা' শব্দটির সাথেই আমরা বেশি পরিচিত তবে 'বই উৎসব' যে একেবারে নব্য কিছু তা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় বই উৎসব (National Book Festival)। যেমনটা এবার হয়ে গেল ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর। রীতি অনুযায়ী উৎসবের উদ্বোধন করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং তার স্ত্রী।

উৎসবের সাধারণ একটা চরিত্র আছে। উৎসব উল্লাসের, কখনো উন্মাদনার আবার কখনো শিকড় উপরে ফেলার। উৎসবের প্রচন্ডতায় কখনো শহীদ মিনার হয়ে উঠে আদর্শ নাইট ক্লাব অথবা পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনটি হয়ে যায় বাদ্য-বাজনার। আমরা এতোটাই উৎসব মুখর যে খুব সহজেই ভুলে যাই আমাদের শহীদ মিনার নিছক ইট-পাথরের নয়, এটা রক্তে গড়া, এটা আত্মত্যাগের প্রতীক। এর পবিত্রতা আছে, এর সামনে আমরা শ্রদ্ধায় মাথা নুয়াই। উৎসবের প্রচন্ডতায় আমরা ভুলে যাই শহীদ মিনার কোন রূপসীর ভারসাম্যহীন কোমর দোলাবার জায়গা নয়। অথচ কী দুঃখের বিষয়, সংস্কৃতির কথা বলে, জাতিসত্তার কথা বলে এই শহীদ বেদীতে চলে ভিনদেশী সংস্কৃতির উন্মাদনা। যে সংস্কৃতি আমাদের নয়, যে সুর শহীদের রক্তকে লাঞ্ছিত করে সেই সুর-সংস্কৃতি দিয়েই আমরা উৎসবে মাতি শহীদ বেদীতে। তবে কি আমরা আত্মঘাতি জাতি!

আমাদের উৎসবমানস এতোটাই প্রচন্ড যে আমরা ভুলে যাই শিক্ষা কোন উপঢৌকন কিংবা হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গুপ্তধন নয়, এটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের কর্তব্য এই অধিকার নিশ্চিত করা আর নাগরিকের কর্তব্য এই অধিকার চর্চা করা। শিক্ষা অর্জনের বিষয়, এতে তৃপ্তি আছে তবে উল্লাস নেই; বোধকরি তা থাকতে পারেও না। শিক্ষার একটি সংজ্ঞা আছে। শিক্ষা তাই যা মানুষের আচরণকে পরিবর্তন করেÑ এ পরিবর্তন স্থায়ী, সমাজ স্বীকৃত ও কল্যানকর। অথচ বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফল প্রকাশকে উপলক্ষ্য করে যেভাবে বাদ্য বাজিয়ে উৎসব করা হচ্ছে তাতে মনে হয়, শিক্ষার ভেতরটা নয় তার 'পাশ' নামক খোলসটাই যেন মুখ্য। শিক্ষার নামে আমাদের কী অর্জন হলো, পাশকরা ছেলে-মেয়েদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে শিক্ষার ছোঁয়া কতটুকু লাগলো কিংবা আদৌ লাগলো কিনা তা নিয়ে যেন আমাদের কোন চিন্তা নেই। আমাদের সমস্ত মনোযোগ শিক্ষা নামক ফলের রঙিন খোসাটার দিকে। এর কারণ হয়তো সেটাইÑ আমরা উৎসবের জাতি! আমরা উৎসবে মাতি, অন্যকে মাতাই।

সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হলো সামাজিক অনুষ্ঠান। একটি পরিবর্তনশীল সমাজের সামাজিক অনুষ্ঠান ও তার রূপ-রীতি বেশ দ্রুত বদলায়। পরিবর্তিত এসব রীতি কিছু কাল থিতু হয় এবং আবার বদলায়। এই থিতু হওয়া এবং বদলানো কোনটিই চিরস্থায়ী নয়। আর চিরস্থায়ী নয় বলেই সময়ে সময়ে আমরা নতুন কিছু দেখি, নতুন কিছু করি। আগেই বলেছি বই উৎসব তেমনই একটা কিছু। তবে এই উৎসব আর মেলার মধ্যে কার্যত খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হয়না। তফাৎ যেটুকু তা শুধু ধারণার। কিন্তু ধারণা বরাবরই ক্ষুরধার। কারণ ধারনারও ক্ষমতা রয়েছে সমাজ ও ব্যক্তিমানসকে বদলে দেবার।

খুব সম্প্রতী আমার জেলায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে হয়ে গেল আট দিনব্যাপী 'ঐতিহ্য বই উৎসব।' সাধারণ গ্রন্থাগারের সহযোগিতায় ঐতিহ্য প্রকাশনীর এযাবৎ প্রকাশিত প্রায় সব ধরনের বই নিয়ে ছিল এই আয়োজন। ঐতিহ্য প্রকাশনীর উদ্দেশ্য ছিল কিছু ভাল বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া আর সাধারণ গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য ছিল সেই মহতী উদ্দেশ্যকে সফল করতে সহযোগিতা করা। পাঠকের হাতে বই পৌঁছে দেবার এমন আয়োজনের জন্য সাধারণ গ্রন্থাগারের কর্তৃপক্ষ যেমন ধন্যবাদ পাবার যোগ্য তেমনি ব্যবসায়ীক স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও সাধুবাদ পাবার দাবিদার যার বই নিয়ে এই আয়োজন সেই ঐতিহ্য প্রকাশনী। কিন্তু এই উৎসবে আমরা কী দেখেছি। দেখেছি পাঠক-ক্রেতার হতাশাজনক উপস্থিতি আর যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই প্রবীন ও মধ্যবয়সী। দুঃখজনকভাবে খুব একটা চোখে পড়েনি নতুন প্রজন্মের সেই শ্রেণিকে যাদের বলা হয় টিনেজার। অথচ শহীদ মিনারে যখন বিদেশী সংস্কৃতির উন্মাদনা চলে কিংবা পরীক্ষায় সস্তা এ প্লাস জোটে তখন উৎসবে মেতে উঠতে এই শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের সংখ্যায় কোন কমতি চোখে পরে না। এমনকি অনেক টিনেজার তো বই মেলাকে 'ফালতু' অনুষ্ঠান বলতেও দ্বিধা বোধ করেনা। একটি প্রবাদ আছে, তুমি একটি ঘোড়াকে টেনে জলের কাছে নিতে পার কিন্তু তাকে দিয়ে জোর করে জল পান করাতে পারনা। ঠিক এরকমই একটি মন্তব্য পড়েছিলাম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, একজন পাঠককে দিয়ে দু'শ টাকার একটি বই কেনানো যেতে পারে কিন্তু তার ইচ্ছে না হলে দু'শ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়েও তাকে দিয়ে বইটি পড়ানো যাবে না। আমাদের সামাজে বই ও পাঠকের সম্পর্কটাও এখন বহুলাংশে এরকমই। যে বই পড়লে পরীক্ষায় পাশ করা যায়না সে বই নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই মূল্যহীন। উপরন্তু বই পড়া নয় বরং কেনাটাই আজকাল ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। অনেকের কাছে বই এখন ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখার মতই একটা কিছু। এবারের বই উৎসব বা মেলাতেও এই প্রবণতার পাঠকের অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচড় হয়েছে খুব সহজেই।

'উৎসবের' এই যে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র তা সমাজ ও ব্যক্তি কারো জন্যই ইতিবাচক নয়। যা নিয়ে উৎসব হবার কথা নয় আমরা তাকেই বড় উৎসবে পরিণত করেছি। আর যে উৎসব আমাদের এই পরিবর্তনশীল সমাজ ও ব্যক্তিমানসকে একবিংশ শতকের উপযোগী করে স্থিরতা দেবে সেখানেই আমাদের অনুপস্থিতি ও অবজ্ঞা বেশ প্রকট। মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক অস্থিরতাই এই উৎসব-বিকৃতির জন্য দায়ী। যে শহীদ মিনারে প্রতি সন্ধ্যায় ডজন ডজন টিনেজারের আড্ডা বসে বই উৎসব চলাকালে সেই সব টিনেজারদের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। বই কি তবে কোন আতঙ্কের নাম! এ নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। ভাবতে হবে অভিভাবকদের, সমাজের কর্ণধারদের এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের। আমাদের বুঝতে হবে, শুধুমাত্র নকলমুক্ত পরীক্ষা কিংবা পাশের হার বৃদ্ধি পেলেই জাতির ভবিষ্যত নিরাপদ ও সুন্দর হবে না। আমাদের বুঝতে হবে, যে শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে আমরা দিচ্ছি সে শিক্ষার যেন সামর্থ্য থাকে প্রজন্মের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি আর নৈতিকতাকে প্রভাবিত করার, ইতিবাচকভাবে বদলে দেবার। আর তা না হলে, বলা যায়, পলিমাটির এ দেশ অদূর ভবিষ্যতে পরীক্ষায় পাশকরা আত্মঘাতি এক প্রজন্মের উত্তরাধিকারী হতে যাচ্ছে।