আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু-সংবাদ ও বাংলানিউজের বক্তব্য

বাসন্ত বিষুব
Published : 25 Dec 2011, 05:31 PM
Updated : 25 Dec 2011, 05:31 PM

একবার আমার এক বন্ধু তার চাচার চল্লিশার দাওয়াত দিয়েছিল। আমি দাওয়াত কবুল করে জানতে চেয়েছিলাম ওর চাচা কিভাবে মারা গেছেন। কিন্তু ও যে উত্তর দিল তাতে আমি কিছুটা থতমত খেয়েগেলাম। আমার ঐ বন্ধু বললো, চাচা এখনো মারা যাননি। মৃত্যুর আগেই তিনি তার চল্লিশা করে যাচ্ছেন। বড় বড় তিনটি গরু কেনা হয়েছে; হাজার খানেক লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম এবং শেষে বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিলাম। কারণ বিচিত্র এই পৃথিবীতে এ আর এমনকি।

কিন্তু 'এ আর এমনকি' ধরনের ঘটনার যেন শেষ নেই। গত পরশু (২৩ ডিসেম্বর) এইরকম আরো একটি ঘটনা পুরো জাতি প্রত্যক্ষ করলো। ঘটনাটির মঞ্চায়ন হয়েছে আমাদের জাতীয় কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে এবং বিশেষকরে অনলাইন সংবাদ সংস্থা বাংলানিউজ২৪.কম এ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম একজন বীরপুরুষ আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা নিয়ে যে অযতœ ও অধৈর্যের পরিচয় সংবাদ মাধ্যমটি দেখিয়েছে তা ইতোমধ্যেই সবার জানা হয়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোন ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার দায়িত্ব চিকিৎসকের এটা বুঝতে খুব বিজ্ঞ হবার প্রয়োজন হয়না কিন্তু ডাক্তারকে টপকিয়ে সে কাজ যদি কোন সংবাদ মাধ্যম করে তবে বিনা দ্বিধায় বলা যায়- এটা ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া।

বাংলা নিউজের এমন অসতর্ক প্রতিবেদন পাঠককে বেশ ক্ষুব্ধ করেছে। একজন পাঠক হিসেবে আমি নিজেও বেশ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। বেশ কয়েকজন ব্লগারও এনিয়ে তাদের ক্ষুব্ধ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। আরো অনেক পাঠকও হয়তো একই রকম মতামত সরাসরি ব্যক্ত করেছিলেন সংস্থাটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে। কারণ কোন দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে কেউই এমন প্রতিবেদন আশা করেনা। এটা যদি মৃত্যু সংবাদ না হয়ে কোন সংবেদনশীল রাজনৈতিক সংবাদ হতো তাহলে তা হলে এর ফলাফলটা কী হতো! নিশ্চই সুখকর নয়। তাই ঠিক কেন এবং কোন ত্র"টির কারণে এমনটি ঘটেছে তা জানার আগ্রহ কমবেশি সবারই ছিল।

আজ দুপুরে বাংলানিউজ এর হেড অব নিউজ অপারেশনস মাহমুদ মেননের একটি লেখা চোখে পড়লো। শিরোণাম ছিল- "প্রসঙ্গ: বাংলানিউজে আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর প্রকাশ।" তার লেখাটি পড়ে বুঝা গেল এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ পরিবেশন করার জন্য তিনি অনুতপ্ত। তিনি লিখেছেন, "রিপোর্টটি যখন লিখছিলাম তখন অনেক অনুভূতি একযোগে কাজ করছিলো। দেশপ্রেমিক এক রাজনীতিককে হারানোর বেদনা সংবাদকর্মীরও থাকে, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিলো অপরাধবোধ আর কিছুটা ধর্মীয় অনুভূতিও। সৃষ্টিকর্তা যাকে পৃথিবীর বুকে জীবিত রাখলেন শুক্রবার রাত ৯টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত, তার মৃত্যু হয়েছে এমন একটি খবর আমি নিজ হাতেই লিখেছি প্রায় ৩ ঘণ্টা আগে।… রাত ১০টার দিকে যখন মৃত্যু সংবাদটি 'মৃত্যুর দেশেই পাড়ি জমালেন আবদুর রাজ্জাক' শিরোনামে লিখছিলাম তখন এই সব চিন্তার মাঝে সাংবাদিকতায় দক্ষতা, যোগ্যতার অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছিলাম নিজের কাছে নিজেই।"

শুধু তাই নয়, তিনি এই সংবাদকে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য একটি কলঙ্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, "খবরটি বাংলানিউজের তথা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য একটি কলঙ্ক হয়েই থাকবে। কারণ দেশের প্রায় সবক`টি সংবাদমাধ্যমই খবরটি একইভাবে প্রচার করেছে। সবাই বলেছে আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন।"

পুরো ঘটনাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং সব অভিযোগ মেনে নিয়েছেন। তার ভাষায়, "আমি মনে করি বাংলানিউজের পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে কী ঘটেছিলো শুক্রবার সন্ধ্যায় তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। তবে অবশ্যই তা সকল দুঃখ প্রকাশ ও দায় মাথায় নিয়ে।"

একজন সাধারণ ব্লগার ও পাঠক হিসেবে মাহমুদ মেননের এই জবাবদিহিতাকে আমি স্বাগত জানাই। কারণ আমারও দাবি ছিল ঐ বিভ্রান্তিকর ও প্রতিযোগিতামূলক সংবাদের জন্য বাংলা নিউজ দুঃখ প্রকাশ করুক এবং এর একটি ব্যাখ্যা পাঠকের কাছে তুলে ধরুক। মাহবুব মেনন সেই কাজটিই করেছেন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, পাঠকের কাছে জবাবদিহিতার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।