একুশ এবং ভারতীয় প্রেক্ষিত

গৌতম রায়
Published : 21 Feb 2020, 02:34 PM
Updated : 21 Feb 2020, 02:34 PM

মাতৃভাষার অধিকার স্থাপনের প্রশ্নে বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল, দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে তা আজ গোটা বিশ্বে, কেবল মায়ের মুখের ভাষাই নয়- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র রক্ষার, ধর্মনিরপেক্ষতার, অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার, ভাষাগত ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং সম্প্রীতি রক্ষার লড়াইতে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

একুশের চেতনার ভেতর দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি আনুগত্য, ভালোবাসা, আবেগ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে যে প্রেক্ষিত বাংলাদেশের মানুষ রচনা করেছিলেন, সেই প্রেক্ষিতে আজকের ভারতবর্ষে জাতি-ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ, কেন্দ্রিক অস্থিরতার ভয়াবহ আবর্তের ভিতরে একটি নতুন আঙ্গিকে লড়াইয়ের হাতিয়ার সংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ বিবেক হিসেবে আমাদের সামনে উঠে আসছে।

বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য যে লড়াই করেছিলেন, তার পেছনে কিন্তু তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শাসন, সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা, ভাষা-ধর্ম-লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সে ভূমিকার প্রেক্ষিতটিকে প্রায় ভুলে গিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী বিভাজনমূলক রাজনীতির এক ভয়ানক আবর্তের ভেতরে, একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের গোটা আঙ্গিককে আমাদের বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার।

মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে রক্ত ঝরানো, তার ভেতর কিন্তু কোনো অবস্থাতেই উর্দু ভাষা বা উর্দুভাষী মানুষদের প্রতি একবিন্দু ও বিদ্বেষ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়নি ।প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্প ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল উর্দু ভাষাকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভাগ উত্তর কালের ঔপনিবেশিক, বিভাজনমূলক মানসিকতার বিরুদ্ধে ।

পশ্চিমবঙ্গে এ প্রেক্ষিতকে বর্তমান সময়ে প্রায় বিস্তৃত হয়ে ভারতবর্ষের মতো বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, সমন্বয়বাদিতা চেতনার দেশে, ভাষা প্রীতিটিকে অপর ভাষার প্রতি বিদ্বেষের জায়গায় পরিণত করে, তাকে প্রয়োগ করার একটা ভযংকর প্রবণতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

৫২-র মহান ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার ভেতর দিয়ে ধর্মীয় আবেগ-কে প্রধান উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরে সম্প্রদায়িক রাজনীতিকদের তৈরি করা, মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ-অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি  নিহিত ছিল, যার মধ্যে প্রথম ও প্রধান বিষয়টি ছিল- তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, তথা আজকের বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি। সে প্রেক্ষিতকে  কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গে, একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সার্বিক প্রেক্ষিত ও কর্মসূচির ভেতরে উঠে আসার প্রবণতা খুব প্রবলভাবে দেখতে পাওয়া যায় না ।

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক যে বহুত্ব বিরাজমান, সেই বহুত্ববাদী মানসিকতাকে সম্মান এবং মর্যাদা জানিয়েই কিন্তু মাতৃভাষার স্বাধিকার আন্দোলন বিকাশ হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির রক্ত ঝরেছিল।  সেই আন্দোলনের ভেতর দিয়েই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রারম্ভিক শুভ সূচনা ঘটেছিল। মহান একুশের আন্দোলনে এ বহুত্ববাদী চেতনার প্রতি যে মর্যাদা সম্মান এবং ভালোবাসার শপথ উচ্চারিত হয়েছিল, সেই জায়গাটি আজকের ভারতবর্ষে, ভয়াবহ রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের ঘূর্ণায়মান পঙ্কিল আবর্তে দীর্ণ ভারতবর্ষে উচ্চারিত হওয়াটা একান্ত জরুরি।

এই বিষয়টি এপার বাংলার ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে একটা বড় অংশের সমাজ সচেতন মানুষদের ভেতর ভাষা কেন্দ্রিক পক্ষপাতিত্ব বহুভাষার দেশ ভারতে একটি বিপদজনক প্রবণতাকেই শক্তিশালী করছে। বহুভাষী ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার বিশেষ অধিকারের  জায়গায় কার্যত একাংশের মানুষ পর্যবসিত করার  একটি ভয়ঙ্কর  প্রবণতা ক্রমশ স্পষ্ট করে তুলতে  শুরু করে দিয়েছেন।

মাতৃভাষা প্রীতির ভেতরে একুশের চেতনা,  কিন্তু একটিবারও আমাদের শেখায়নি অপরের মাতৃভাষার প্রতি কোনো ধরনের বিদ্বেষ-বিভাজন-অপমান-অসম্মান মানসিকতা তৈরির  বিষয়টিকে। একুশের চেতনার এই বিষয়টি সঠিকভাবে আজকের পশ্চিমবঙ্গের সবসময় অনুধাবন করা হয় না। বাংলা ভাষাকে ঘিরে একটা আবেগ তৈরির চেষ্টা এমন একটি জায়গায় পর্যবসিত করবার পরিকল্পনা একটি দুটি কায়েমি চক্রের মধ্যে দিয়ে উঠে আসছে। এটিকে ভারতবর্ষের মতো বহু ভাষাভাষী দেশের পক্ষে একটি ভয়ংকর বিপজ্জনক, বিচ্ছিন্নতাবাদী, আঞ্চলিক প্রবণতা হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।

ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে একুশের চেতনা প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কখনো হিন্দি ভাষা বিদ্বেষ একমাত্র উপজীব্য হতে পারে না। হিন্দি ভাষা বিদ্বেষের নাম করে, হিন্দিভাষী মানুষদের প্রতিরোধের উদ্দেশে,'গুটখা সংস্কৃতি', ' খৈনি সংস্কৃতি' ইত্যাদি শব্দ ক্রমশ এপার বাংলার বাঙালি সমাজ জীবনে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই মানসিকতার ফলে  ভারতবর্ষের মত বহুত্ববাদী দেশে একটা ভয়ংকর বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির, তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রয়োগের লক্ষ্যেই, এক ভাষার নীতির কথা বলে। বহুত্ববাদী ভারতবর্ষের সার্বিক চেতনাকে ধ্বংস করে, কেবলমাত্র হিন্দি ভাষাকে ভারতবর্ষের প্রধান ভাষা হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পাল্টা কিন্তু কখনো কোনো ভাষাভিত্তিক, আঞ্চলিক অবস্থান দিয়ে, আবেগ দিয়ে মোকাবিলা করা যেতে পারে না।

বিশ্ব মানব হতে গেলে যেভাবে শাশ্বত বাঙালি হতে হয় তার সার্বিক চর্চা না করে অপর  ধর্মবিদ্বেষ- যেমন একটি মানবিক ও সামাজিক অপরাধ, তেমনি অপরের ভাষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা, অপমানসূচক, অ-সম্মান সূচক মানসিকতার জন্ম দেওয়াও  ভয়ংকর সামাজিক অপরাধ। এই সামাজিক অপরাধকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গেঁথে দিতে একাংশের কায়েমী, স্বার্থবাদী মানুষজন চেষ্টা  করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে ।

একুশের চেতনাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে, একুশের চেতনার ভেতর যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সম্প্রীতির প্রতি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ মানসিকতা রয়েছে, সেই সমস্ত কিছুকে ভুলে গিয়ে, এক ধরনের ভাষাভিত্তিক 'শ্যভিনিজম'কে প্রকট করে তোলবার প্রবণতা এপার বাংলা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা কিন্তু ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী সন্ত্রাসী শিবিরকেই সবরকমের সুযোগ করে দেবে।