বৈশাখের চেতনা ও আমাদের জাতীয়তা

mustafatariqul_ahsan
Published : 15 April 2016, 01:56 PM
Updated : 15 April 2016, 01:56 PM

বাঙালির জীবনে বৈশাখের চেতনার গভীরতা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করতে পারে; কীভাবে এই চেতনার জন্ম হলো,এর শেকড় কত গভীরে এই সব নিয়েও প্রশ্ন হতে পারে। তবে আমরা আজ যেভাবে মহা আনন্দ আর আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালন করি তা তাতে এটি এখন আমাদের প্রাণের উৎসব। বাঙালির শাশ্বত উৎসবপ্রিয়তা, মিলন আর সবদিক দিয়ে রঙিন হয়ে ওঠার চিরায়ত যে জীবনধারা সেটাকে ধারণ করে বৈশাখ। কে প্রথম নববর্ষ পালন শুরু করেছিল, কে প্রথম বাংলা সন প্রবর্তন করেছিল সে সব সালতামামির ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি ঐতিহাসিক বা গবেষকরা করুন; সাধারণ বাঙালির তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। বাঙালির এমনিতে উৎসবের শেষ নেই। বারো মাসের তের পার্বনের দেশে বাঙালিরা সারাজীবন মিলেছে হৃদয়ের জোয়ারে। সেখানে কোথায় যেন একটু খুত ছিলো তা সার্বজনীন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে। কারণ বেশিরভাগ উৎসবের সাথে যোগ আছে হিন্দুধর্মের নানা পুজো ও ব্রতের। বাঙালি মুসলমানরাও সেখানে যোগ দিয়েছে তবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য থাকার কারণে এই যোগের সামান্য সমস্যা হয়েছে তবে তা প্রকাশ্যে নয়। বাঙালি অসম্প্রদায়িক চেতনার বাহক হিসেবে সব উৎসবে পার্বণে যোগ দিয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বৈশাখ আমাদের সেই দ্বিধাহীন মহামিলনের আর আনন্দের উৎসব যা আমাদের ( বাংলাদেশে)জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজ রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে, মঙ্গলশোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষেরা অজস্র অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেচে গেয়ে রাঙিয়ে যে নববর্ষ উৎসব করে তার সমকক্ষ সমান উচ্চতার কোন অনুষ্ঠান আমাদের নেই।
এদেশের লোকজ সংস্কৃতির প্রধান চরিত্র আমরা পেয়ে যাই বৈশাখের নানা আচারের মধ্যে। খাওয়া দাওয়া পোশাক আশাক মেলা এবং নানা যোগের কারণে বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বাঙালি মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে এটা তাদের কাছে অনেক প্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ অনেকটা বাঙালির সংস্কৃতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ঠ্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও আচার প্রবেশ করেছে। মহররম শবেবরাতের উদাহরণ দেয়া যায়।এমনকি মৃত্যুর পরে চল্লিশা থেকে শুরু করে ঈদের মধ্যে ও প্রবেশ করেছে বাঙালির চিরন্তন উৎসব প্রিয়তা ও আচারের বৈশিষ্ট্য। বিবাহ, জন্ম বার্ষিকী, খৎনা বা মুসলমানির মধ্যেও প্রবিষ্ট হয়েছে সার্বজনীন বাঙালির নানা বৈশিষ্ট্য। আর সব যোগের স্রোত এসে মিলেছে পয়লা বৈশাখে। পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে পালিত আগে হতো না। আগে বাঙালিরা হালখাতা হিসেবে পালন করতো পয়লা বৈশাখে। দোকানদার তার বাকি আদায় করার জন্য পয়লা বৈশাখে হালখাতা অনুষ্ঠান করতো। লোকজন বকেয়া পরিশোধ করতো আর মিষ্টি মুখ করতো দোকানদারের কাছ থেকে। অনুষ্ঠানটি এখনো হয় তবে এটি তার জৌলুস হারিয়েছে। পয়লা বৈশাখের আগে ধুমধামের সাথে পালিত হতো চৈত্র সংক্রান্তি,এটি এখনো পালিত হয়। তবে পয়লা বৈশাখের মতো এত জাকজমকের সাথে তা পালিত হয় না। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ বছরের প্রথম দিন আগে ধরা হতো অগ্রহায়ণ মাসের এক তারিখে; সেখান থেকে পরিবর্তন করে সম্ভবত সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। অগ্রহায়ণকে বাদ দিয়ে বৈশাখকে বেছে নেবার কারণ খুব স্পষ্ট নয়। ধারণা করা সম্রাট প্রচলিত হিজরি সনের প্রভাব বাদ দিতে এবং খাজনা পাবার সুবিধার্থে এটি প্রবর্তন করেন। যে কারণে হোক না কেন পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে উৎযাপনের আলাদা তাৎপর্য আমরা খুঁজে পেয়েছি। বাংলার প্রকৃতির শুধু রূক্ষতার দিকটি বিবেচনা করলে হবে না। রূক্ষতা যা আছে, চণ্ডতা যা আছে তা অমঙ্গলকে বিদায় করার শক্তি হিসেবে সনাক্ত করা হয়। আর সত্যিকার অর্থে বাংলার প্রকৃতি বৈশাখে তার নবরূপ পরিগ্রহ করে। পুরাতনের জীর্ণ পাতা ঝরে যায় আগে আগে আর খুব দ্রুত প্রকৃতি ফিরে আসে নব সাজে,পাতায় পাতায়,ডালে ডালে,কোকিলের গানে গানে। বৈশাখের প্রধান সুর হলো রঙের; সব কিছুকে রঙিন করে ফেলে বৈশাখ। এ যেন রঙের মধ্য দিয়ে নবচেতনার আবাহন,একটি নতুন বছরকে পাবার জন্য শুধু মানুষ নয় প্রকৃতিও আয়োজনে নেমে পড়ে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল শিমুল পলাশ সোনালু, বাগানবিলাসসহ অজস্রফুল বৈশাখের উৎযাপনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
বৈশাখ আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে গভীরভাবে মিশে আছে; এটা আজ সবাই উপলব্ধি করেন। সম্মিলিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষেভাবে এভাবে উৎসব উৎযাপন একটি সংস্কৃতিবান জাতি হিসেবে আমাদের লোকঐতিহ্যের মূল চরিত্রকে ধারণ করে। শিশু কিশোর যুবক যুবতি নারী পুরুষ বৃদ্ধ সবাই এখানে এক কাতারে সামিল হয়ে যায়। কেউ এর বিপক্ষে এখন পর্যন্ত কোন কথা বলেছে বলে শুনিনি। যা হয়েছে তাকে ব্যতিক্রম বলতে হবে। যারা প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিবান নয়,যারা প্রগতিশীলতার আলোক চেতনাকে ভয় পায় তাতের তরফ থেকে বাধা আসতেই পারে। আমরা সম্মিলিতভাবে তার মোকাবিলা করে চলেছি। রমনার বটমূলে বোমা মারার ঘটনাকে আমাদের মনে রাখতে হবে। এর থেকে শক্তি নিয়ে আমরা আমাদের লোক ঐতিহ্যের স্মারক,জাতীয় চেতনার মৌল চেতনাবাহী এই উৎসবের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। এখন সময় এসেছে এই উৎসবকে জাতীয় চেতনার সাথে অঙ্কিত করার। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে যে আবেগের সাথে পালন করি তাকে আরো সংহত অবস্থায় আনতে হবে ।

পয়লা বৈশাখে সবাই একসাথে জেগে ওঠে; 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো' রবীন্দ্রনাথের এই গানের সুরে সুরে বাঙালি যেভাবে মেতে ওঠে তা দেখে গভীর এক জাতীয় বোধের জন্ম হয়। এখানে আবেগই মুখ্য নয়। বরং একসাথে মেতে ওঠার আনন্দের মধ্যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। উৎসব এখন চলে সারা বাংলাদেশে – গ্রামে গঞ্জে শহরে। শহরেই এখন বৈশাখের প্রধান জোয়ার। আর তরুণ প্রজন্ম এর প্রধান বাহক তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আগেই বলেছি এখানে রয়েছে সামগ্রিকতার ছোয়াঁ। মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে যাবতীয় আচার পোশাক সাজ সজ্জা খাওয়া দাওয়া মেলা এবং সঙ্গীতসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে যে আবাহন চলে তাকে প্রতীকি করে তোলে নানা আল্পনা আর রঙের আয়োজন। বিচিত্র বর্ণের রঙিন পোষাক আর আল্পনা দিয়ে যে মোহন ভঙ্গি চারুকলার ছেলেমেয়েরা( বিশেষভাবে) তৈরি করেছে তাকে এখন একক মূতি দেবার সময় এসেছে। বৈশাখে মেয়েরা যে শাড়ি গয়না পরে,ছেলেরা যে পাজামা পাঞ্জাবি পরে তার রঙ ও মটিফ বলে দেয় এটা বৈশাখের। কেউ বিশেষভাবে বলে দেয় নি, কেউ নির্দেশনাও দেয়নি সব যেন অবলীলায় হয়ে উঠেছে। এটাই সংস্কৃতির মৌল শক্তি আর জাতির মূল চেতনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার সময়। বৈশাখ যে জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে সেটা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখলে বোঝা যায়। এর মধ্য দিয়ে আমরা সংস্কৃতির মূল শেকড়কে চিনতে শিখেছি। আমাদের চিরায়ত লোকজ সাংস্কৃতিক চেতনা ও দর্শনকে অঙ্কিত করে এই উৎসবে মিলিত হয়ে আমরা ফিরে পেতে চলেছি নিজস্ব উত্তরাধিকার। আমাদের সংস্কৃতি যে শক্তিশালী সেটাই আমরা প্রমাণ করেছি বৈশাখের উৎযাপনের মধ্য দিয়ে।

আমরা কখনো সাম্প্রদায়িক ছিলাম না; সেই অম্প্রদায়িকতার নানা রূপ আমরা দেখতে পাই লোকজ উৎসবে বা অনুষ্ঠানে। নিজের ধর্ম পালন করে ধর্মীয় কূপমন্ডুতার ঊর্দ্ধে উঠে আমরা একসাথে মিলিত হয়েছি আমাদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক চেতনার কারণে। মাঝে আমরা বিভক্ত হয়েছি, ভুলে গিয়েছি আমাদের গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বৈশাখ আমাদের আবার এক সাথে মিলবার সুযোগ করে দিয়েছে। জাতি হিসেবে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়াবার এখন উপযুক্ত সময়। বর্তমান বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুযোগ তৈরি হয়েছে বৈশাখের মাধ্যমে, জাতিকে সুগঠিত করতে। বৈশাখ আমাদের আরো সমৃদ্ধ করবে সামনের দিনে। এর জন্য কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়ে সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাঙালি জাতি সংস্কৃতিবান জাতি। ভাষা ও সংস্কৃতি এর জাতীয়তাবাদের মূল চালিকাশক্তি। বৈশাখকে সামনে রেখে একে আরো শাণিত করা যায় সহজে।