এখনো খুঁজি সেই ‘নীলা হরিণের দেশে’

বাসন্ত বিষুব
Published : 19 April 2012, 05:32 PM
Updated : 19 April 2012, 05:32 PM

কী বোকা ছিলাম আমি! নিজের অবহেলায় কিভাবেই না হাতছাড়া হয়ে গেল প্রিয় জিনিসটা! আমার কৈশোরের আবেগ ও কল্পনার সবটুকুই মিশে ছিল ওটার সাথে। আবেগ ও কল্পনা ছাড়া একটা কিশোরের আর কিই বা থাকে! চঞ্চলতা? দুরন্তপনা? এ দুটো তো ও দুটোরই অভিব্যক্তি। অথচ আমার কৈশোরের এই সামান্য সম্পদটুকু হুট করেই নিখোঁজ হয়ে গেল ঐ প্রিয় জিনিসটার সাথে।

আমি একটা বইয়ের কথা বলছি। বইটির গায়ে কোন বাহারি রঙ ছিল না, কোন চাকচিক্য ছিল না। নীল প্রচ্ছদের সাদাকালো একটি বই। ঠিক বলছি তো! হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। ওটার অবয়ব আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ছোট-খাট একটি বই কিন্তু পাতায় পাতায় আবেগ আর উত্তেজনা। আমার কাছে ওটা শুধু বই-ই ছিল না, ছিল আরো অনেক কিছু। কারণ ওটা আমাকে এমন এক জগতে নিয়ে গিয়েছিল যে জগতের সবটুকুই আমার কাছে ছিল অজানা।

তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। এক অদ্ভুত সময় ছিল সেটা। স্কুল ছিল, খেলার মাঠ ছিল; ছিল চঞ্চলতা, দুরন্তপনা। কিন্তু এসবের কোনটির সাথেই নিখাদ সখ্য ছিল না আমার। কিন্তু যার সাথে নিখাদ সখ্য ছিল তারও প্রাচুর্য ছিল না আমার বাড়িতে। বলা চলে আমাদের বাড়িটা ছিল বই শূন্য। কিন্তু শূন্যতা থেকে যার জন্ম তার বিস্তার অনন্ত। এই শূন্যতাই আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল বইয়ের প্রতি আবেগ ও আকর্ষণ।

বইটা আমি পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। প্রথমে ধারে, পরে একেবারে। সীমার মধ্যেই যে অসীমের আনাগোনা তার আদর্শ প্রমাণ ওই বইটা। ওটাই আমাকে শিখিয়েছে- বইয়ের ক্ষমতা অসীম। একটা বই একটা কিশোরকে ছিনিয়ে নিতে পারে, তাকে নিয়ে যেতে পারে এমন এক কল্পলোকে যেখান থেকে ফিরে আসার সাধ্য সবার থাকে না। বইকে এই ক্ষমতা কে দিয়েছে? ঈশ্বর নাকি লেখক? এই দুয়ের মধ্যে কোন তফাৎ আছে কি? লেখককে কি ঈশ্বর বলা যায়? এ আলোচনা এখানকার নয়। তবে লেখক ঈশ্বর হোক আর নাই হোক, তার ক্ষমতা আছে কিছু একটা কেড়ে নেবার। এই নেয়াটা ব্যতিক্রম কারণ এর মধ্যেও একটা দেয়া আছে। এটা প্রতিদান, এ প্রতিদান অমূল্য।

ওই বইটা নিয়ে গেছে আমার সময়, আমার কল্পনা, আমার আবেগ। কিন্তু প্রতিদানে যা দিয়েছে তা নতুন কিছু নয়- সেই সময়, কল্পনা ও আবেগ। কিন্তু এই দেয়া আর নেয়ার মধ্যে তফাৎ অনেক- এ তফাৎ গভীরতার।

আমি যে বইটার কথা বলছি সেটা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এমন এক রহস্যের জগতে যেখানে এর আগে আমি যাইনি কখনো। শুধু রহস্য বলছি কেন, ওখানে রোমাঞ্চ ছিল, ছিল আবিস্কারও। কী অদ্ভুত সেই আবিস্কার! আমি কখনো আবিস্কারক হতে চাইনি, কিন্তু আবিস্কার আমাকে টেনেছে এবং আমি হার মেনেছি। এসবই ঘটেছে আমার মন ও মস্তিস্কে।

কী আশ্চর্য! আমি একটা বইয়ের কথা বলতে চাচ্ছি, অথচ বার বার অন্য কথা বলে ফেলছি। দোষটা আমার নয়, ওই বইয়ের। আরো একটি কারণ আছে- লেখাটি আমি পাঠকের উদ্দেশ্যে লিখছি না। লিখছি শুধু আমার জন্য। কিন্তু জানি, তারপরও কোন না কোন পাঠক এই লেখাটি পড়বেন কারণ আমিই এটাকে প্রকাশ করবো।
ওটা ছিল একটা অ্যাডভেঞ্চার। একটা বিদেশি কাহিনীর অনুবাদ। লেখক কে ছিলেন জানি না, অনুবাদক কে ছিলেন তাও মনে নেই। একটা কিশোরের কাছে লেখক কিংবা অনুবাদকের কী মূল্য আছে! তারা আমার সামনে আসেনি কিংবা আমিই তাদের কথা ভাবিনি। শুধু পড়েছি। পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছি, হারাতে হারাতে আপ্লুত হয়েছি। হারানোর মধ্যে এত আনন্দ আগে জানা ছিল না।

গল্পের নায়ক একটা অভিযানে বের হয়েছিলÑ অরণ্যে, অরণ্য ঘেরা পাহাড়ে, পাহাড় ঘেরা সভ্যতার খোঁজে। পথে পার হয়েছিল অনেকগুলো রাত, অনেকগুলো দিন। কী চমৎকার ছিল জঙ্গলের সেই রাত্রি যাপন- মাঝখানে আগুন, চারপাশে জ্বলজ্বলে কিছু চোখ। কাদের চোখ ছিল ওগুলো? নেকড়ের কিংবা চিতা বাঘের- মনে নেই। সে এক দীর্ঘ যাত্রা, অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। মানুষের এরকম প্রতিটি যাত্রাই দীর্ঘ হয়।

কার জন্য ছিল সেই অভিযান? নীলা হরিণের জন্য। নীলা হরিণ মানে নীল রঙের হরিণ। অদ্ভুত, সত্যিই অদ্ভুত! হরিণ আবার নীল হয় নাকি। কখনো কখনো হয়। এ জন্যই তো পৃথিবীটা রহস্যময়। আমি সেই রহস্যে অবগাহন করেছিলাম।

গল্পের নায়ক কি নীলা হরিণের দেখা পেয়েছিল? হ্যাঁ, পেয়েছিল। দারুণ এক অভিযানের মাধ্যমে। রহস্যময় এক জায়গা, নাম না জানা এক প্রান্তর। চারিদিকে অরণ্য, অজানা এক সভ্যতা। ওটাই ছিল নীলা হরিণের ঠিকানা। এর আগে আর কোন মানুষ সে হরিণ দেখেনি। সে হরিণ সৌভাগ্যের আর সৌভাগ্য বরাবরই নির্ভীক অভিযাত্রীর।

বইটিতে গুটি কয়েক ছবি আঁকা ছিল- সাদাকালো। ওগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আর বাকি অভিযাত্রার ছবিগুলো ছিল রঙিন। তবে ওগুলো আমার আঁকা- কল্পনার তুলিতে, মনের ক্যানভাসে। ওগুলোই এখন আমার আবেগ। ওগুলো এখনো লুকিয়ে আছে আমার হৃদয়ের অজানা প্রকোষ্ঠে। আমার এই লেখাটাও সেই প্রকোষ্ঠ থেকেই আগত। ওই প্রকোষ্ঠের সৃষ্টি হয়েছিল আমার কৈশোরে, এজন্যই হয়তো এই লেখাটাও কিছুটা এলোমেলো।

বইটি রাখা ছিল আমার টেবিলে, কিছু পুরনো পত্রিকার সাথে। কি জানি কী হলো, বইটা হারিয়ে গেল। কেউ কি বিক্রি করে দিয়েছিল পুরনো পত্রিকার সাথে! তাও জানি না। শুধু জানি বইটা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে আমার আবেগ, আমার কল্পনাও। কিন্তু ঐ যে বলেছি, হারানোরও একটা প্রাপ্তি আছে। সেই প্রাপ্তি নতুন কিছু নয় তবে আরো গভীর, আরো গাঢ়।

প্রতিটি অভিযানের একটি বর্ণনা থাকে। সে বর্ণনা গন্তব্য খুঁজে পাবার। কিন্তু থাকেনা প্রত্যাবর্তনের বর্ণনা। কেন? অজানাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন আর ফিরে আসাটা সহজÑ এজন্যই হবে হয়তো। ফিরে আসা কি সত্যিই সহজ! আমি কি ফিরতে পেরেছি নীলা হরিণের দেশ থেকে? না, চট জলদি এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে না। শুধু বলা যাবে, বইটি আমি এখনো খুঁজি। এখনো খুঁজি সেই নীলা হরিণকে- কোন এক গহীন অরণ্যে, অরণ্য ঘেরা পাহাড়ে, পাহাড় ঘেরা এক সভ্যতায়। যেখানে হয়তো এখনো ছুটে বেড়াচ্ছে সেই নীলা হরিণের দল।