পদ্মা ঋণচুক্তি, বিশ্বব্যাংকের রোডম্যাপ ও জাতীয় সক্ষমতার প্রশ্ন

আনু মুহাম্মদ
Published : 13 Feb 2011, 06:10 PM
Updated : 22 July 2012, 04:24 PM

বিশ্বব্যাংক পদ্মা ঋণচুক্তি প্রত্যাহারের পর কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মন্ত্রী আমলাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কি সত্য? দ্বিতীয়ত, শুধু এই কারণেই কি বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রত্যাহার করেছে নাকি অন্য কোন কারণ আছে? তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়া কি বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব? এবং চতুর্থত, বাংলাদেশের পক্ষে কি নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব? বাংলাদেশের মতো 'গরীব' দেশের পক্ষে কি জাতীয় সক্ষমতা অর্জন সম্ভব?

দুর্নীতির অভিযোগ
চারদিকের ঘটনাবলী থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির আয়োজন নিয়ে বাংলাদেশের মন্ত্রী আমলাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে সত্যতা আছে বলেই মনে করি। সরকার এখনও এই অভিযোগ নাকচ করবার মতো কোন গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে পারেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা দেখে মনে হয় দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে কিংবা সরকারের ইচ্ছামতো কাজ করাই তাদের প্রধান ভূমিকা।

বাংলাদেশের নানা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। পুরো প্রকল্প হজম হয়ে যাবার খবরও দুর্লভ নয়। সারাদেশে এমনকি ঢাকা মহানগরীর শতকরা ৯০ ভাগ রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। শতকরা ৫০ ভাগের অবস্থা ভয়াবহ। যোগাযোগসহ অনেক ক্ষেত্রের দৈন্যদশার প্রধান কারণ দুর্নীতি। অনেক সড়ক, সেতুর উন্নয়ন প্রকল্পের পুরো টাকারই হিসাব নাই। প্রতিদিনের পত্রিকায়, লোকখবরে সরকারী প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় দখল ও দুর্নীতির নিত্য নতুন ঘটনা পাওয়া যায়। পদ্মা সেতুর বিশাল বরাদ্দে দুর্নীতির আয়োজন নিয়ে লোকমুখে নানা গল্পের কমতি নেই। বাংলাদেশে লোকখবরে সত্যতাই বেশি পাওয়া যায়।

সরকারি একটি সমীক্ষার সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, দেশে এখন ৫ থেকে ৮ লাখ কোটি টাকা আছে যার হিসাব সরকারি খাতায় নাই। এই টাকাকে আদর করে বলা হয় 'অপ্রদর্শিত আয়', অর্থশাস্ত্রে সাধারণভাবে এটি 'কালো টাকা' নামে পরিচিত, আর আমি মনে করি এর প্রধান অংশ 'চোরাই টাকা'। এই টাকার অস্তিত্বই সর্বব্যাপী দুর্নীতির চিহ্ন হিসেবে হাজির।

পদ্মা সেতু সংক্রান্ত কিছু চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন পক্ষের তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক একটি চীনা কোম্পানির পক্ষে দাঁড়িযেছিল, আর সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী কানাডীয় এক কোম্পানির সঙ্গে দরকষাকষিতে ব্যস্ত ছিলেন। পদ্মা সেতু নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত সম্ভবত এখানেই। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংককে যেসব পত্র লেখা হযেছে সেগুলোতে কাকুতি মিনতি ও হাতজোড় যথেষ্টই ছিল। এতদিন যা হাতজোড় ছিল তা এখন হাঁটুভেঙে প্রার্থনার পর্যায়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। একদিকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকার দলীয় বিভিন্ন ব্যক্তি বিশ্বব্যাংক বিরোধী নানা কথা বলছেন। অন্যদিকে, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে চলছে প্রার্থনা ও তদ্বিরের নানা আয়োজন। একদিকে তদ্বির চলছে অন্যদিকে চাঁদা সংগ্রহ চলছে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলে । চাঁদা সংগ্রহের নামে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজী ও তেলবাজীর প্রতিযোগিতা। ইতিমধ্যে চাঁদা নিয়ে সংঘাতে একজন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি বিশ্বব্যাংক তথা যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এইসবকিছু বিশ্বসমাজের সামনে বাংলাদেশকে আরো খেলো করে তুলছে।

বিশ্বব্যাংক কি দুর্নীতিবিরোধী?
১৯৪৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেদেশেরই ব্রিটনওডস নামে এক শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে উপনিবেশউত্তর দেশগুলো নিয়ে অধিপতি বিশ্বব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই তাদের আবির্ভাব। গঠন ও পরিচালনা বিন্যাসই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও পরিচালনায় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগুলোকে দাঁড় করায়। যদিও বিশ্বব্যাংক ১৮৮টি দেশের সদস্যপদ নিয়ে গঠিত, কিন্তু তার পরিচালনা কাঠামো এমন যে, যুক্তরাষ্ট্রই তার প্রধান কর্তা। মতাদর্শিক ভিত্তি ও পরিচালনা কাঠামোর ধরনের কারণে বহুদেশ সদস্য হলেও এসব সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রসহ ক্ষমতাশালী কতিপয় রাষ্ট্রের ক্ষমতার অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবেই হোয়াইট হাউজের সঙ্গে বাঁধা। দ্বিতীয়ত, এসব সংস্থা মুক্ত বাজার অর্থনীতি বা অদৃশ্য হস্তের কথা বললেও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার চাইতে চাপ, ভীতি ও ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ করে। তৃতীয়ত, এসব সংস্থা আপাত দৃষ্টিতে স্বাধীন মনে হলেও এগুলো একচেটিয়া সংস্থাসমূহের লবিষ্ট হিসেবে কাজ করে এবং বহুজাতিক সংস্থা কিংবা বিশ্ব পুঁজির আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় থাকে।

১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যখন তাদের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন শুরু করে তখন সারাবিশ্বে তার ভূমিকার ফলাফল নিয়ে উল্টো পর্যালোচনা সমালোচনাও অনেক বিস্তৃত হয়। এর মুখে বিশ্বব্যাংক নিজেই স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট রিভিউ ইনিশিয়েটিভ বা (সাপরি)-র উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশেও এই পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বত্রই দেখা যায় কীভাবে তাদের সংস্কার বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান বিপর্যস্ত করেছে, টেকসই উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত করেছে, পরিবেশ বিপন্ন করেছে। এরকম ফলাফল দেখে বিশ্বব্যাংক নিজেই এর কার্যক্রম এক পর্যায়ে স্থগিত করে।

বিভিন্ন দেশের কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখি- দুর্নীতিবাজ নিপীড়ক শাসকেরাই বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির প্রধান ভরসা, উর্বর ক্ষেত্র। এরা না থাকলে দেশে দেশে দখলদার বহুজাতিক পুঁজি, লোভী কনসালট্যান্ট, আমলা আর দেশি ভাগীদারদের বিশ্ব সাম্রাজ্যের এই রমরমা রাজত্ব কি টিকতো? টিকতো না, কারণ কোন সরকার জনগণকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন মডেল দাঁড় করাতে চাইলে তার পক্ষে এদের আধিপত্য মানা সম্ভব নয়। সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নতুন যাত্রায় তাই প্রথমেই এদের কর্তৃত্ব নাশ করেছে।

সেজন্য সরকারের মধ্যে দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের মতো উত্তেজনা সত্যিই বিস্ময়কর! বাংলাদেশের বহু প্রকল্পের সাথে বিশ্বব্যাংক জড়িত। প্রকল্পব্যয়ের শতকরা ১ থেকে ১০ ভাগ অর্থায়ন করে পুরো কর্তৃত্ব করছে বিশ্বব্যাংক, এরকম অনেক প্রকল্প আছে। সেগুলোতে কি তবে কোনো দুর্নীতি নাই? বিশ্বের যত প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক তহবিল যোগান দিচ্ছে সেগুলো কি সবই দুর্নীতিমুক্ত? বিশ্বব্যাংকের নিজের দুর্নীতির কী খবর? বিশ্বের দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসকদের সাথে, লোভী দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী আমলা আর কনসালট্যান্টদের সাথে যে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর নাড়ির সম্পর্ক তারা দুর্নীতি নিয়ে এত উত্তেজিত, এর চাইতে কৌতুকের বিষয় আর কী হতে পারে?

বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকার বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর উন্নয়ন দর্শনের ওপর ভর করে, তাদের সামান্য ঋণ অপরিহার্য দেখিয়ে, তাদের পরামর্শকে ঐশী আইন হিসেবে হাজির করে গত কয়েক দশকে দখল লুন্ঠনকে বৈধতা দেবার মতো সব অর্থনৈতিক সংস্কার করেছে। এতে দেশি বিদেশি দুই দখলদারদেরই লাভ। ক্ষতি জনগণের, প্রকৃতির; বর্তমান ও ভবিষ্যতের। তাদের যৌথ 'উইন উইন' উন্নয়ন প্রকল্পের সুবাদে দেশের নানাপ্রান্তে এখন জলাবদ্ধতা, বৃহত্তম পাটকল বন্ধ, গ্যাসক্ষেত্র আর বিদ্যুতের বড় অংশ হাতছাড়া, গ্যাস বিদ্যুতের ক্রমান্বয় দামবৃদ্ধি, শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন টাকায় কেনার জিনিষ, বীজ এখন কোম্পানির, পানি ক্রমেই কোকাকোলা….। এর মধ্য দিয়েই বৈষম্য ও দখলের বিস্তার।

বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশে কাজ করে সেদেশের শাসকগোষ্ঠীর ওপর ভর করেই। 'বিদেশি সাহায্য'যুক্ত প্রকল্পের ব্যাপারে আমলা, কনসালট্যান্ট ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সবসময় বিশেষ আগ্রহ। বর্তমানে জ্বালানী মন্ত্রণালয় যেমন বহুজাতিক কোম্পানির হাত হিসেবে কাজ করে তেমনি অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফএর সম্প্রসারণ হিসেবেই। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থ মন্ত্রণারয়ের অস্থিরতা তাই খুবই বোধগম্য।

বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বা এডিবির মতো সংস্থাগুলোর মুখে কাগজপত্রে অপচয়, দুর্নীতি নিয়ে সবসময়ই বাগাড়ম্বর পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় তারা সরব হয়, কোথায় নীরব থাকে সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, ১৯৯৭ সালে মাগুড়ছড়া আর ২০০৫ সালে টেংরাটিলায় মার্কিন ও কানাডীয় কোম্পানির কারণে আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস সম্পদ নষ্ট হয়েছে তাতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমাদের ন্যুনতম পাওনা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তা দিয়ে দুটো পদ্মা সেতু করেও হাতে টাকা থাকার কথা। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী কখনও এই পাওনার কথা বলেনি। কোন সরকারের মুখ থেকেও এই নিয়ে কোন দাবি ওঠেনি।

বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর রোডম্যাপ
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাঘের আগে ফেউ-এর মতো কাজ করে। 'বিদেশি সাহায্য' 'টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্স', 'ফিজিবিলিটি স্টাডি', 'রুটিন এডভাইজ' ইত্যাদি এক একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নানারকম বাগাড়ম্বরের মধ্য দিয়ে তাদের লক্ষ্য থাকে দুটি: ১. সাধারণ সম্পত্তিকে বাণিজ্য ও মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করা ও ২. জাতীয় সম্পদকে বহুজাতিক পুঁজির দখলে নিয়ে যাবার উপযোগী নীতি ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। সেই পথেই পুঁজির আধিপত্য বিস্তার বা দেশি বিদেশি মুনাফাখোরদের দখল লুন্ঠন স্বচ্ছন্দ, নিরাপদ হয়, বৈধতা লাভ করে। দুর্নীতিরও বিস্তার ঘটে এই পথেই। এখন পর্যন্ত যত সরকার আমরা পেয়েছি তারা এই রোডম্যাপ অনুযায়ীই হেঁটেছে। ক্ষমতার অংশীদার বিভিন্ন দলের মধ্যে নানা বিষয়ে কঠিন মতবিরোধ থাকলেও এই বিষয়ে গভীর ঐকমত্যই পাওয়া যায়। সেজন্য সরকার পরিবর্তনেও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা খর্ব হয় না।

২০০৭ সালে যখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেন তার আগের কয়েক বছর এই প্রতিষ্ঠান দায়মুক্তি লাভের জন্য প্রাণপণ চাপ দিচ্ছিলো। সেসময়ই আমরা বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির বিরুদ্ধে একটি গণআদালত গঠন করি এবং একবছরের অধিক সময় কৃষি, পানি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, পাট, জ্বালানীসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করি।

এসব সমীক্ষা থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। এসব সংস্থার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ ও সমীক্ষার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপে উপস্থিত করা যায়:
১. প্রতারণা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের কথা বলে বিভিন্ন প্রকল্প মহিমান্বিত করে; কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয় যে, তাদের মূল লক্ষ্য অর্থনীতির উপর বিশ্ব পুঁজির দখল নিশ্চিত করা। এরফলে দারিদ্র ও বৈষম্য আরও স্থায়ী হয়, উন্নয়ন সম্ভাবনা বিপর্যস্ত হয়।
২. অস্বচ্ছতা, গোপনীয়তা। এই প্রতারণা ঢাকার জন্যই এসব সংস্থা তাদের সকল প্রকল্পের বিস্তারিত, শর্ত ও আর্থিক দিকগুলো গোপন বা অস্বচ্ছ রাখে। এসব সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা ক্রমাগত বললেও নিজেদের প্রকল্প কিংবা জ্বালানী, বিদ্যুৎ খাতসহ নানা ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা গোপন রাখবার পক্ষে অবস্থান নেয়।
৩. ঘুষ ও দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা। এসব প্রকল্প ও চুক্তির পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করবার জন্য আমলা, মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ ও নীতি নির্ধারকদের বিদেশ সফর, কনসালট্যান্সী, অবসর পরবর্তী উচ্চবেতনে চাকুরি ইত্যাদি বন্দোবস্ত রেখে ঘুষ ও দুর্নীতির নতুন এক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। ঋণের টাকা থেকেই এসব ব্যয় নির্বাহের কারণে দেশের ঋণবোঝা এসবের মাধ্যমে আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে তৈরি হয় দুর্নীতিগ্রস্ত সমর্থক গোষ্ঠী, মেধাশক্তির দূষিতকরণ ঘটে। এসব সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতিবাজ বিদেশি কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। দুর্নীতি বিরোধী বাগাড়ম্বর করলেও দুর্নীতিবাজ সরকার, আমলা, কনসালট্যান্ট ও ব্যবসায়ীরাই তাদের কার্যক্রমের ভিত্তি।
৪. চাপ, হস্তক্ষেপ ও লবিং। সকল সাধারণ সম্পত্তি মুনাফামুখি তৎপরতায় দিয়ে দেয়া এবং দারিদ্রবৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, খাদ্য ও জ্বালানী নিরাপত্তা বিনষ্ট করবার মতো প্রকল্প গ্রহণের জন্য এইসব সংস্থা হস্তক্ষেপ, ব্ল্যাকমেইল, চাপ ও লবিংএর নানাপথ অবলম্বন করে। জ্বালানী খাতে বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য তৈরি, চিংড়ি ঘের, বন, পানি প্রকল্প, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট, সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম, পিএসআই চুক্তি, গ্যাস রফতানি ও উন্মুক্ত খনি প্রকল্প বাস্তবায়নের অপচেষ্টা, তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এর অবিরাম দামবৃদ্ধির চাপ এসবের কিছু দৃষ্টান্ত।
৫. জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল, পঙ্গু বা বিলুপ্তকরণের মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতার বিনাশ। আদমজী পাটকল, চট্টগ্রাম স্টীল মিল, রেলওয়ে, পাবলিক হাসপাতাল, বিএডিসি, পিডিবি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর ইত্যাদির দুর্বলতা বা বিলুপ্তি এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের ফলাফল।
৬. সংকটের অজুহাতে অধিকতর সংকট সৃষ্টি। বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং সেই অজুহাতে সেসব সংস্থা বন্ধ করা বা বেসরকারিকরণ এদের বিভিন্ন প্রকল্পের লক্ষ হিসেবে প্রমাণিত। পাটখাত প্রকল্প তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ। গ্যাসখাতে উৎপাদন অংশীদারী চুক্তি এবং বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি কোম্পানির মালিকানা উৎসাহিত করে রাজস্ব ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ সৃষ্টি এবং সেই অজুহাতে আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং গ্যাস বা কয়লা রফতানির চাপ সৃষ্টি এগুলোর অব্যাহত প্রকল্প।
৭. জাতীয় অর্থনীতির পরিমাপযোগ্য ও অপরিমাপযোগ্য বিপুল ক্ষতি সাধন। এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি খাতে বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান হ্রাস, পরিবেশ দূষণ, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, জাতীয় উদ্যোগ বিনষ্টকরণ, মেধা পাচার, শিক্ষা চিকিৎসা ইত্যাদিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকোচন ও ব্যয়বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যুক্তিযুক্ত বেতন ও ন্যূনতম মজুরির বিরোধিতা করে জনগণের উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও জীবন দুর্বিষহ করাতেও তাদের ভূমিকা প্রধান।
৮. অপরাধ করেও আইনের আওতামুক্ত থাকবার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বিপর্যয় সৃষ্টিতে সরকার ও সমর্থকদের সহযোগে এই সংস্থাগুলো প্রত্যক্ষভাবে দায়ী; তারা যে তাদের অপরাধ সম্পর্কে সচেতন তার প্রমাণ পাওয়া যায় 'দায়মুক্তি' বা ইমিউনিটির জন্য বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত অপচেষ্টায়। একইভাবে জরুরী অবস্থার সুযোগ নিয়ে আইএমএফ যে পিএসআই স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিচ্ছিল সেটাও তাদের খুটি ধরে রাখার অপচেষ্টা ছিল। জনগণের প্রতিরোধের মুখে এই দুটি ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু তারা তাদের অপরাধমূলক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

অগ্রাধিকার ও জাতীয় সক্ষমতা
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর একদিকে কাউকে কাউকে দেখছি মুরুব্বী হারানোর আশংকায় কাতর, অন্যদিকে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখছি নিজের ক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে নতুন করে অনুসন্ধানের তাগিদ। যারা মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঋণের কোন বিকল্প নেই, এই ঋণ উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য তাদের মূল যুক্তি হল বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের হার। তাঁরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের সুদের হার বা সার্ভিস চার্জ দেশি বিদেশি অন্য যে কোন ঋণদাতা সংস্থার তুলনায় অনেক কম। শুধু যদি ঋণের বাজার দেখি, তাহলে ঘটনা তাই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বা এডিবি যেমন কোনভাবেই দাতা সংস্থা নয়, তেমনি এগুলোকে শুধু ঋণদানকারী ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করলেও ভুল হবে। বিশ্বজুড়ে বহু দেশে এসব সংস্থার বিভিন্ন ভূমিকার বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে এগুলোর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র দেশগুলোর রাজনীতি ও ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত।

তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণে পরিচালিত প্রকল্পগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যায় তাদের প্রস্তাবিত পণ্যক্রয়, কনসালট্যান্ট আমদানি, অপ্রয়োজনীয় সাজসজ্জা, বিদেশ সফর, স্টাডি, ইত্যাদি কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ বাড়তি খরচ তৈরি করে। এই বাড়তি খরচকে ঋণের খরচ হিসেবে বিবেচনা করলে সুদের হার হবে সর্বোচ্চ। উপরন্তু এই ঋণের শর্তাবলীর কারণে অন্য বহুখাতের কাজ বিলম্বিত হয়, খরচ বাড়ে, জনগণের ওপর বোঝা বাড়ে। শুধু তাই নয় আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি, এসব ঋণ প্রকল্প দেশের নীতি কাঠামোকে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে বিন্যস্ত করায় ব্যবহৃত হয়। যার পরিণতিতে পুরো দেশই জনগণের হাত থেকে ক্রমে কতিপয় দেশি বিদেশি গোষ্ঠীর করায়ত্ত হয়।

এটা প্রমাণিত যে, বিশ্বব্যাংকের রোডম্যাপে চললে কখনোই জাতীয় সক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়। পূর্বএশীয় দেশগুলোসহ পুঁজিবাদী পথেও যারা শক্তিশালী উৎপাদনশীল ভিত্তি তৈরি করেছে তারা বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর পথে হাঁটেনি। আর জাতীয় সক্ষমতা মানে শুধু অর্থায়ন নয়। এর অর্থ প্রথমত, জাতীয় উন্নয়নের একটি স্বাধীন রূপরেখা তৈরির ক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, মতাদর্শিক আধিপত্য থেকে মুক্ত জনগণের প্রয়োজনে অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষমতা। তৃতীয়ত, লুটেরা শক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা হরণ করে জনগণের মালিকানার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এগুলো সম্ভব হলে প্রয়োজন ও সাধ্যমতো অর্থসংস্থান করা কঠিন নয়। প্রতিষ্ঠান ও জনবল তৈরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিকাশ এর মধ্য দিয়েই সম্ভব।

বাংলাদেশকে সবসময় বলা হয় গরীব। কিন্তু তা ঠিক নয়। মানুষ, পানি, উর্বর ভূমি তো বটেই, এমনকি স্থলভাগ ও সমুদ্রে খনিজ সম্পদেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের পাট ও পাটশিল্প বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাতে পারে; বাংলাদেশের সীমিত তেল-গ্যাস, কয়লা -খনিজ-সম্পদ নিজেদের কর্তৃত্বে থাকলে তা এদেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে; সবার জন্য শিক্ষা চিকিৎসা ও বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব যদি বিদ্যমান বাজারমুখি মুনাফামুখি নীতি পাল্টানো যায়; মানুষ, মাটি ও পানির সার্থক সমন্বয়ে এদেশ নতুন যাত্রা শুরু করতে পারে। এসবই সম্ভব বাংলাদেশের জনগণের জীবন ও সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে। আর তা সম্ভব করবার প্রথম শর্ত বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির মতো সংস্থাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবার শক্তি অর্জন করা। বিশ্বের বহুদেশ এখন এভাবেই নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করছে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব এদেশে তার দেশি ভাগীদার বা পঞ্চম বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই।

ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট হয় প্রয়োজনে তার 'না' বলার শক্তির মধ্য দিয়ে, একটি জনগোষ্ঠীর শক্তিও স্পষ্ট হয় সে দখলদার , দুর্বৃত্ত আধিপত্যকামী অপশক্তিকে প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা অর্জন করেছে কিনা তার উপর। জাতীয় সক্ষমতার সকল সুপ্ত সম্ভাবনাগুলো তখনই কেবল বিকশিত হতে পারে।

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।