সাম্প্রতিক যে লজ্জাজনক ঘটনাটা বাঙালি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে তা হচ্ছে 'সোনা কেলেংকারি'। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় পর আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দিয়ে একটু অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত সাতটি ধাপে প্রায় আড়াইশ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য এই সম্মাননা দেওয়া হয় এবং প্রত্যেককে একটি করে সোনার ক্রেস্ট দেওয়া হয়।
এরপর জানা গেল সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এ বছর এপ্রিলে এক দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে যে বিদেশি অতিথিদের সোনায় রাঙানো রদ্দিমাল দিয়ে আমরা সম্মানিত করেছি! অভিযোগে জানা যায়, ওই ক্রেস্টে যে পরিমাণ সোনা থাকার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়নি। এমনকি রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত শংকর ধাতু।
এই কেলেংকারির পর দু' দুটো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পর ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পাশাপাশি ২৪ এপ্রিল তিন সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তাদের কারও তদন্তেই এই কেলেংকারির হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থার সুপারিশ এখনও করা হয়নি।
যা হয়েছে তার মধ্যে কোনো মতে ব্যাপারটা সামলানোর একটা প্রক্রিয়ার আভাস মিলেছে। ক্রেস্টের এই দুর্নীতি নিয়ে আইনি নোটিশ দাখিল করা আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে দেওয়া উত্তরপত্রে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে সরকার বিদেশি বন্ধুদের নতুন ক্রেস্ট দেবে। চিঠিতে লেখা হয়, "বিষয়টি সংসদীয় উপ-কমিটির তদন্তাধীনে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সরবরাহকারী কোম্পানিকে পরিশোধিত বিল পুনরুদ্ধার এবং নতুন ক্রেস্ট তৈরি করে বিদেশে বাংলাদেশের হাইকমিশন/রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বিদেশি বন্ধুদেরকে প্রদান করা ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"
কথা হচ্ছে এটি কতখানি সঠিক বিচার! বিদেশি বন্ধুরা জেনেছেন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বাংলাদেশ সরকার সোনার বদলে পিতল ধরিয়ে দিয়ে। সরকারের ভাবমূর্তি এভাবে ক্ষুণ্ন করল যারা তাদের আবার নতুন ক্রেস্ট বানিয়ে দেওয়ার নির্দেশনাই কি যথেষ্ট! এদের কোনো শাস্তি হবে না? এতই ক্ষমতাবান এই সরবরাহকারীর দল যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারও নমনীয়!
অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রচলন রয়েছে। কিন্তু এমন মোলায়েম প্রতিক্রিয়ায় তো অন্যান্য খাতেও দুর্নীতির সম্ভাবনা বাড়বে। কারণ অপরাধী জানছে তার কোনো সাজা হবে না। এর আগে দেশি প্রযুক্তিতে 'দোয়েল ল্যাপটপ' নামে একটি প্রকল্পেও সরকার বিশাল অংকের গচ্চা দিয়েছে। সেখান থেকে যারা টাকা বানানোর বানিয়ে নিয়েছে। এই টাকা কিন্তু জনগণের টাকা। কিন্তু আমরা জানলাম না আমাদের ঘামের টাকা সৎ উপার্জনের টাকাটা কেন কীভাবে জলে গেল!
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার কারণেই আওয়ামী লীগের উপর বড় দায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার। কিন্তু সেই চেতনা নিয়ে কেউ অন্যায় ছিনিমিনি খেলবে আর তা মুখ বুজে সয়ে গেলে তো বিপদ। অপরাধের কালচক্র থেকে কস্মিনকালেও তো আর বেরুনো হবে বাঙালির। লুটেরারা লুটেই যাবে আজীবন। এই চর্চার অবসান হতেই হবে। আর সেটা দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের লজ্জিত করার অধিকার তো রাষ্ট্রের নেই।
অমি রহমান পিয়াল: ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।