সমুদ্রে কনকোফিলিপস আর ভ্রান্ত তথ্যের সমুদ্রে তরুণদের জিজ্ঞাসা: মোশাহিদা সুলতানা ঋতু

বিডিনিউজ২৪
Published : 4 July 2011, 03:20 PM
Updated : 4 July 2011, 03:20 PM

সম্প্রতি মডেল পিএসসি ২০০৮ ও কনকোফিলিপসকে সমুদ্র ব্লক ইজারা দেয়ার শর্তগুলোকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। প্রথমত, একজন সাধারণ পাঠকের কাছে পিএসসি একটি দুর্বোধ্য দলিল। দ্বিতীয়ত সাধারণ পাঠক যখন একেক জায়গায় একেক বিশ্লেষণ পড়েন তখন স্বাভাবিক কারণে তাদের মধ্যে নানারকম মতামত তৈরি হয়। ভিন্ন মতামত থাকা সমস্যাজনক নয়, কিন্তু সমস্যাজনক হচ্ছে ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মতামত নিয়ন্ত্রিত হয় গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে। কিছু কিছু খবরের কাগজ পরিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন না করে আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

তার নমুনা পাই আমরা যখন দেখি গণমাধ্যমগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করে পাঠকদের মধ্যে অনেক প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখে দেয়। সাধারণ জনগণ যখন কিছুটা হলেও তথ্য খুঁজছে তখন গণমাধ্যমগুলো ভুল ও পরস্পরবিরোধী তথ্য-উপাত্ত হাজির করে জনগণকে আরো বিভ্রান্ত করে তুলছে। আমরা এই লেখাটিতে পিএসসির অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি বিষয়কে তথ্য-উপাত্তসহ সহজভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।

অংশীদারিত্ব
গত ১৬ই জুনে স্বাক্ষরিত পিএসসি চুক্তির আওতায় কনকোফিলিপস কত ভাগ পাবে আর বাংলাদেশ কত ভাগ পাবে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন রকম ধারণা দেয়া হয়েছে জনগণকে। জনগণ কী বুঝবে আর কী বুঝবে না, সেটা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। পেট্রোবাংলার প্রেসনোটে বাংলাদেশ লাভের গ্যাসের ৫৫% থেকে ৮০% পাবে বলে উল্লেখ থাকলেও সরকারের বিভিন্ন মহল এবং বিভিন্ন মিডিয়া মারফত প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বাংলাদেশ নাকি পুরো গ্যাসের ৫৫% থেকে ৮০% পাবে! যেমন: ডেইলি স্টারের ২১ জুনের একটি রিপোর্টের শিরোনাম এবং ভেতরে দুইটি বাক্যে 'লাভের গ্যাস' কথাটি উল্লেখ না থাকায় এই খবরটি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এই বিষয়টি ভালোমত বোঝার জন্য মডেল পিএসসিতে কী আছে, সেটা খতিয়ে দেখা যাক। মডেল পিএসসিতে উল্লেখ করা আছে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ৫৫% কস্ট রিকভারি গ্যাস হিসেবে দাবি করতে পারবে কনকোফিলিপস এবং বাকি ৪৫% হলো লাভের গ্যাস বা প্রফিট গ্যাস, যা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও কনোকোফিলিপসের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। চুক্তির দিন পেট্রোবাংলার দেয়া প্রেসনোট থেকে দেখা যায় উত্তোলিত গ্যাসের পরিমাণভেদে লাভের গ্যাস থেকে বাংলাদেশ ৫৫% থেকে ৮০% পাবে। এখন লাভের গ্যাসের ৫৫% পাওয়ার মানে হলো মোট গ্যাসের ২৪.৭৫% পাওয়া, আর লাভের গ্যাসের ৮০% পাওয়া মানে মোট গ্যাসের ৩৬% পাওয়া। অথচ 'Govt share up to 80pc' শিরোনামে লেখা ডেইলি স্টারের রিপোর্টে লেখক প্রফিট গ্যাস কথাটি উল্লেখ না করে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

এবার একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখা যাক মডেল পিএসসিতে প্রাপ্ত তথ্য এবং সরকারি মহলের বক্তব্য একত্র করলে অংশীদারিত্ব কী রকম দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, নিচে উল্লেখিত উৎপাদন বণ্টন শুধু কস্ট রিকভারি পর্যায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

পিএসসি ২০০৮-এ আরো উল্লেখ আছে, ১০ বছরের আগে কোনোভাবেই পেট্রোবাংলা সর্বমোট বিপণনযোগ্য গ্যাসের ২০% -এর বেশি রাখতে পারবে না। ১o বছর পর পেট্রোবাংলা চাইলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত রাখতে পারে। নিচে পিএসসি ২০০৮-এর ১৫.৫.৪ অনুচ্ছেদটি দেয়া হলো।

কস্ট রিকভারির রাজনৈতিক অর্থনীতি
গ্যাস উত্তোলনের সময়কে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ১. কস্ট রিকভারি পর্যায়, ২. প্রফিট পর্যায়। অংশীদারিত্ব প্রশ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যায় কস্ট রিকভারির সময়সীমা নির্ধারণ ও এই সময়সীমাকে দীর্ঘায়িত করার পিছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা না করলে। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কোম্পানির খরচ উঠে গেলে কস্ট রিকভারি পর্যায় তো একসময় শেষ হয়ে যাবে, তখন তো পুরো উত্তোলিত গ্যাসই হয়ে যাবে লাভের গ্যাস, যার ৫৫% থেকে ৮০% বাংলাদেশ পাবে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত 'পিএসসি সহজ পাঠ' শীর্ষক কলামে ম. তানিমও এরকম আশাবাদ রেখে বলেছেন, কস্ট রিকভারি পর্যায় শেষ হলে বাংলাদেশ লাভের গ্যাসের ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ ও সামগ্রিকভাবে উৎপাদিত গ্যাসের ৫০ শতাংশের বেশি পেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যা আকর্ষণীয় মনে হলেও এর পেছনের ফাঁপা অনুমানটি সহজে সাধারণ পাঠকের চোখে নাও পড়তে পারে। এই অনুমানের ভিত্তি হলো বহুজাতিক কোম্পানির চরিত্র সম্পর্কে একটি 'ইতিবাচক' চিন্তা, যেই চিন্তা আমরা বেশিরভাগ সময় আমাদের নিজেদের সামর্থ্যের ব্যাপারে করতেও ব্যর্থ হই। অনুমানটি হলো, 'কনকোফিলিপস দফায় দফায় তার খরচের হিসেব বাড়িয়ে দেখাবে না।' কিন্তু বাস্তবে তা হয় কি না সেটা বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর আগের নজির।

বাস্তবে তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো নানাভাবে কস্ট রিকভারি পর্যায়কে দীর্ঘায়িত করে। তারা বিনিয়োগকৃত অর্থ পরিমাণ অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দেখায় এবং স্থাপিত যন্ত্রপাতি ও মেশিনপত্রের দাম বেশি দেখায়, পুরোনো মেশিনকে নতুন মেশিন হিসেবে চালিয়ে দেয়। নানা অপ্রয়োজনীয় খরচের হিসাব দাখিল করে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেখিয়ে খরচ বাড়ায় আর এসব খরচ নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খরচের হিসাব বের করা বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পক্ষে করা সম্ভব হয় না; তারা আমলা-এজেন্ট-রাজনীতিবিদদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বাজেট দফায় দফায় পাশ করিয়ে নেয়। এ ধরনের খরচ দেখিয়ে কস্ট রিকভারি পর্যায় দীর্ঘায়িত করার বিভিন্ন নজির আছে, যা চুক্তির গোপনীয়তা রক্ষার নামে সাধারণত অপ্রকাশিতই থেকে যায়। এখানে দুটি নজির উল্লেখ করা যায়।

১. মাগুরছড়ায় অক্সিডেন্টাল ১৯৯৫ সালে সিসমিক সার্ভে এবং তিনটি কূপ খননের জন্য প্রথমে এক কোটি ৮৮ লাখ ডলারের হিসাব দিলেও ১৯৯৭ সাল নাগাদ চারবার সংশোধনের মাধ্যমে তা চার কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার ডলারে পরিণত হয়। এবং এই খরচের হিসাব কূপখননের খরচের হিসাব ছাড়াই।

২. অগভীর সমুদ্রের সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে কেয়ার্নের কস্ট রিকভারির হিসাবটা দেখা যাক। বিডিংয়ের সময় ১০.৮১ মিলিয়ন ডলার প্রকল্প ব্যয় দেখানো হলেও একের পর এক সংশোধনী বাজেট দিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৬৬০ মিলিয়ন ডলার। ফলে এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশ মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস পায়।

পেট্রোবাংলার এপ্রিল মাসের এমআইএস রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, এ বছরের এপ্রিলে মোট ১৩.৮৩৪ এমএমসিএম গ্যাসের মধ্যে কেয়ার্নের ভাগে পড়ে ১১.০৭৫ এমএমসিএম গ্যাস, অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাগে পড়ে মাত্র ২.৭৫৯ এমএমসিএম, যা মোট গ্যাসের মাত্র ১৯.৯৪ শতাংশ।

ফলে যতই গ্যাস উত্তোলিত হউক, কস্ট রিকভারি পর্যায় আর শেষ হয় না। একের পর এক সংশোধনী বাজেটের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান কস্ট রিকভারি পর্যায় বহুজাতিক কোম্পারি জন্য হয়ে ওঠে বিপুল মুনাফা অর্জনের পর্যায়।

রফতানি
চুক্তিতে যে রফতানির সুযোগ রাখা হয়েছে সেটা সরকারও অস্বীকার করছে না; কিন্তু তারা বলছে, এই সুযোগ এমন একটি শর্তের অধীন রাখা হয়েছে যে কার্যত বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে রফতানি করা সম্ভব হবে না। শর্তটি হলো, প্রথমে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির বাধ্যবাধকতা, উত্তোলিত গ্যাস পেট্রোবাংলা কিনতে রাজি না হলেই কেবল এলএনজি আকারে রফতানি করা যাবে। আসলেই কি এটা খুব কঠিন একটা শর্ত? কী করবে পেট্রোবাংলা যদি কনোকোফিলিপস পেট্রোবাংলা তথা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন ও ব্যবহার ক্ষমতার চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করতে শুরু করে? চুক্তিতে বছরে মোট উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের ৭.৫% হারে উত্তোলনের সুযোগ রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজনে সমুদ্রের গ্যাসের ক্ষেত্রে এই হার আরো বাড়িয়ে নেয়ারও সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। সমুদ্রে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে তো এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করলে কোম্পানিকে যেহেতু প্রতিহাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ৪.৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, যেখানে বিদেশের বাজারে রফতানি করতে পারলে ১০-১২ ডলার দামে বিক্রি করা যাবে। বাংলাদেশ নিজে গ্যাস উৎপাদন করলে এর চেয়ে বহুগুণ কম খরচে গ্যাস উত্তোলন করতে পারত বলে এভাবে ৪.৩৫ ডলার হারে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনাটা বাংলাদেশের জন্য বিপুল ক্ষতি সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের বাজারের এই হার আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ কম বলে এক অর্থে এই রেটে গ্যাস বিক্রি করা বহুজাতিক কোম্পানির জন্য 'লস'। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানি ছলে-বলে-কৌশলে নানাভাবে চাইবে দেশের বাইরে গ্যাস রফতানির পরিস্থিতি তৈরি করতে। তাহলে কেন চুক্তিতে সোজা বলে দেয়া হলো না—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখেই গ্যাস উত্তোলন করতে হবে? কেন সরাসরি রফতানি নিষিদ্ধ করা হলো না?

বাংলাদেশের ভর্তুকি, বহুজাতিকের মুনাফা
তর্কের খাতিরে যদি ধরি, গ্যাস রফতানি হলো না, সেক্ষেত্রেও এই ধরনের চুক্তির ফলে আমাদেরকে নিজেদের গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে প্রবাসী ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বাড়তি দামে কিনতে হবে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য স্থলভাগের গ্যাস কেনার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। স্থলভাগে প্রচলিত পিএসসি চুক্তি অনুসারে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বাংলাদেশকে গড়ে প্রতিহাজার ঘনফুট গ্যাস ২১০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে, যেখানে বাপেক্স একই পরিমাণ গ্যাস ২৫ টাকা খরচ করে উৎপাদন করে। কস্ট রিকভারি ও প্রফিট গ্যাস বাবদ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ গ্যাস পায়, তা এভাবে উচ্চমূল্যে বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করে। যেমন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে এযাবৎ বহুজাতিক শেভরনের বিনিয়োগ ২৭ কোটি ডলার এবং ২০০৬-০৭ থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কস্ট রিকভারি ও প্রফিট গ্যাস বাংলাদেশের কাছে বিক্রি বাবদ আয় ১০৫.১৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাত্র ২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে মাত্র কয়েক বছরে শেভরনের লাভের পরিমাণ ৭৮.১৬ কোটি ডলার। শেভরনের যেটা লাভ, বাংলাদেশের সেটা লস। বাংলাদেশকে নিজের গ্যাস শেভরনের কাছ থেকে প্রতিহাজার ঘনফুটে ২১০ — ২৫ = ১৮৫ টাকা বাড়তি মূল্যে, বলা যায়, বহুজাতিককে ভর্তুকি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এভাবে স্থলভাগে উৎপাদিত গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সাগরের গ্যাস কোনকোফিলিপসকে দিয়ে তুললে যার পরিমাণ আরো বাড়বে।

জাতীয় সক্ষমতা
বহুজাতিক কোম্পানিকে এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার টাকার অভাব না হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে সময়মতো প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকা দেয়ার মতো টাকা নাকি আমাদের নেই! প্রশ্ন উঠতে পারে, বাপেক্সকে সময়মতো অর্থ দিলেই কি বাপেক্স এই মুহূর্তে সাগরের গ্যাস তুলতে পারবে? স্থলভাগে বাপেক্সের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকলেও গভীর সমুদ্রের জটিল প্রযুক্তি ও দক্ষতা কি বাপেক্সের আছে? ম. তামিম তার লেখায় তো বলেই বসেছেন: 'সমুদ্রে অনুসন্ধানের টাকা, প্রযুক্তি, লোকবল কোনোটাই তাদের নেই এবং সেটা করতে যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে উড়োজাহাজ তৈরির চেষ্টা করার মতো হঠকারিতা হবে, যাতে বিনা কারণে অজস্র টাকা ও সময় ব্যায় হবে।' এখানে খেয়াল রাখা দরকার, যারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের কথা বলছে, তারা কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় সেমিসাবমারজিবল রিগ, সাপোর্ট ভ্যাসেল ইত্যাদি বাংলাদেশে তৈরির কথা বলছে না; বলছে, এগুলো ভাড়া করে/কিনে তেল-গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যাবহারের কথা। তাহলে উড়োজাহাজ তৈরির উদাহরণটা আসছে কেন? তুলনা করতে গেলে তো উড়োজাহাজ চালনা করার উদাহরণটা দেয়া দরকার। উড়োজাহাজ চালনার মতো জটিল কাজও তো বাংলাদেশের পাইলটদের শিখতে হয়েছে, তাহলে সেমিসাবমারজিবল রিগ কিংবা সাপোর্ট ভ্যাসেল ভাড়া করে এনে সেগুলো কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে পরিচালনা করাটা অসম্ভব কিংবা হঠকারিতা হতে যাবে কেন? বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কি তেল-গ্যাস উত্তোলনে ব্যবহৃত সেমিসাবমারজিবল রিগ, সাপোর্ট ভ্যাসেল ইত্যাদি নিজেরা বানায় বা নিজেরা চালায়? ম. তামিমের তো অজানা থাকার কথা নয়, আশির দশকের সময় থেকেই কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের অনেক কাজ আউটসোর্সিং করতে শুরু করেছে। টেকনোলজি ডেভেলপ করার বদলে টেকনোলজি বিভিন্ন সার্ভিস কোম্পানি, যেমন Schlumberger, Halliburton, Baker Hughes, Oceaneering, Transocean ইত্যাদির কাছ থেকে সুবিধামতো ভাড়া করে তেল-গ্যাস উত্তোলনের কাজটি চালাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বিপি'র কথা বলা যায়।

বিপি মেক্সিকো উপসাগরের যে মাকান্দো কূপে দুর্ঘটনায় ঘটিয়েছে, সে কূপে কাজ করছিল মূলত ট্রান্সওশান, হেলিবার্টন, স্লামবার্জার ইত্যাদি কোম্পানির যন্ত্রপাতি ও সার্ভিস ভাড়া নিয়ে। ডিপ ওয়াটার হরাইজন নামের সেমিসাবমারজিবল রিগটি বিপি ভাড়া নিয়েছে ট্রান্সওশানের কাছ থেকে। এই রিগটি থেকে ড্রিলিংয়ের কাজটি ট্রান্সওশানের কর্মীরাই করছিল, কূপ সিমেন্টিংয়ের কাজটি করছিল হেলিবার্টন এবং সিমেন্টিংয়ের পর তার কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল স্লামবার্জার কোম্পানিটিকে; বিপির কাজ ছিল কেবল এদের কাজ ঠিকঠাকমতো হচ্ছে কি না সেটা তদারকি করা। কাজেই স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনের দক্ষতাকে ব্যাবহার করে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বিষয়ে যথাযথ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বাপেক্সের পক্ষে এই ধরনের তদারকির কাজ করাটা অসম্ভব কোনো বিষয় নয়।

হাজার হাজার বছর ধরে আমরা দেখছি, জ্ঞান ও দক্ষতা যাদের কাছে, ক্ষমতাও তাদের হাতেই থেকে গেছে। পৃথিবীর কোনো জ্ঞান ও দক্ষতা একদিনে গড়ে ওঠে না। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা বিকশিত হয়, পূর্ণতা পায় এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে সেই জ্ঞান জনমুখী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু যেই দেশে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের পথে বাধা তৈরি করা হয় সেই দেশের ক্ষমতাবানেরা যতই জ্ঞান চর্চা ও বিকাশের পক্ষে অবস্থান নেয়ার দাবি করুক না কেন তরুণরা কি আস্থা রাখতে পারে তাদের পরিবর্তনের অঙ্গীকারের ওপর?

তরুণদের ওপর অনাস্থা রেখে, তরুণদের নতুন চিন্তাধারা ও দেশগঠনের আগ্রহকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে, হীনমন্যতা ও মানসিক দৈন্যে ভরা জনমত তৈরি করে, কীভাবে জ্ঞান-সমাজ তৈরি হবে? এদেশের তরুণরা কি বুঝতে পারছে যে, এই চুক্তি তাদের নিজেদের সক্ষমতা তৈরির পথেই অন্তরায়?

মোশাহিদা সুলতানা ঋতু: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট-এর অর্থনীতির প্রভাষক।

(লেখাটি তৈরি করতে কল্লোল মোস্তফার সহায়তা নেয়া হয়েছে ।)

তথ্যসূত্র:
১. মডেল পিএসসি ২০০৮।
২. বাপেক্স ওয়েবসাইট, এমআইএস রিপোর্ট।
৩. ডেইলি স্টার একুশ জুন, ২০১১।
৪. জাতীয় সম্পদ, বহুজাতিক পুজি ও মালিকানার তর্ক, কল্লোল মোস্তফা, অনুপম সৈকত শান্ত ও মাহবুব রুবাইয়াত।
৫. নাইল্যাকাডা, ছোট কাগজ, সম্পাদক: কল্লোল মোস্তফা।