স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ হলেই মহাসড়ক পাব না

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 2 August 2011, 08:39 PM
Updated : 6 August 2015, 12:56 PM

যেটুকু মহাসড়ক আমাদের রয়েছে, তাতে যান চলাচলে শৃঙ্খলা এনে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে যখন একটিমাত্র পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার আর তা নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তখন মনে পড়ে গেল একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনের কথা। এদেশের মহাসড়ক যে আদৌ মহাসড়ক নয়, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার বরাত দিয়ে এমন খবর অনেক দিন ধরেই প্রকাশ পাচ্ছে। এ অবস্থায় ওই পত্রিকার স্নেহভাজন প্রতিবেদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সে আমার ইনবক্সে তার চারটি প্রতিবেদনের লিঙ্ক পাঠায়। এ নিবন্ধে সেগুলোয় পরিবেশিত তথ্য উদারভাবে ব্যবহার করব, এটা আগেই বলে নিচ্ছি।

আমরা কজন জানি যে, আজ থেকে ৯০ বছর আগে, ১৯২৫ সালে 'হাইওয়ে অ্যাক্ট' নামে একটি আইন প্রণীত হয়েছিল, যা ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি? ব্রিটিশ সরকার প্রণীত জরুরি ওই আইন বাংলায় অনুবাদ করে কার্যকর করা হয়েছে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে। অত আগে প্রণীত আইনটিতে মহাসড়কের যেসব অপরিহার্য শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেগুলো একে একে পড়লে অবাক হয়ে যেতে হয়। তারা এত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন!

সে তুলনায় আমরা বলা যায় দৃষ্টিশক্তিহীন। এ জন্যই তো আমাদের গড়ে তোলা মহাসড়কের ৯৬ শতাংশ এখন পর্যন্ত দুই লেনের আর তাতে কোনো ডিভাইডার নেই। মাত্র ১ শতাংশ মহাসড়কের দুপাশে রয়েছে বেষ্টনি। আমাদের দুটি মাত্র মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। তা কবে শেষ হবে, কেউ বলতে পারে না।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, সব মহাসড়কই হতে হবে অন্তত চার লেনবিশিষ্ট। খালি লেন বাড়ালে আর ডিভাইডার দিলেই হবে না; বাড়তে থাকা যানবাহনের জন্য মহাসড়কগুলো প্রশস্ত করাও দরকার। দেশের ভেতর দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের তিনটি রুট গেছে। এর মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক, একটি আঞ্চলিক। আমাদের সড়ক অবকাঠামো এর উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এশিয়ার অনেক দেশ, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও নাকি এ ক্ষেত্রে দ্রুত এগোচ্ছে।

চলতি বছরের জানুয়ারির একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম: 'এশিয়ান হাইওয়ে মানের কোনো সড়ক নেই দেশে'। আক্ষরিক অর্থেই এক কিলোমিটারও নেই এশিয়ান হাইওয়ে মানের সড়ক। ওই মানে উন্নীত হতে গেলে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, সে আলোচনা স্থগিত রাখাই ভালো। অত দূর পৌঁছাতে আমাদের কত সময় লাগবে, কে জানে।

সরকার তো মহাসড়কে তিন চাকার স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ করতেই হিমশিম খাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে সরকার ঝটপট যেভাবে এটা করতে চাইছে, তা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। কথিত মহাসড়কে যা খুশি তা-ই করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সত্যি বলতে, কেন্দ্রে অবস্থানকারী সরকার এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে ছিল আর স্থানীয় সরকার এতে বোধহয় উৎসাহ জোগাচ্ছিল– নির্লিপ্ত থেকে।

অটোরিক্সাসহ তিন চাকার নানা রকম যানবাহন দেশে আছে ১৩ লাখেরও বেশি। এর বেশ কিছু দেশেই তৈরি হয়, কিছু করা হয় সংযোজন আর কিছু হয় আমদানি। যাত্রী ও পণ্য-পরিবহনে এগুলোর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সে দিক বিচারে অর্থনীতিতেও এর অবদান রয়েছে। সমস্যা হল, এগুলো অনেক আগে থেকেই বাধাহীনভাবে মহাসড়কে চলছে। মানুষের কাছে এগুলো সহজলভ্য ও আকর্ষণীয়। এগুলোর চাপে মহাসড়কে লোকাল বাস চলাচলও কমে এসেছে।

বাইসাইকেলসহ সব রকম অযান্ত্রিক যানবাহন পর্যন্ত চলছে মহাসড়কে। গরুর গাড়ি দেশ থেকে উঠে গেছে বলা যায়। নইলে এটাও চলত। মানুষজন হেঁটে যাচ্ছে মহাসড়কের ধার দিয়ে। তারা নিশ্চিন্ত মনে ওইসব রাস্তা পার হচ্ছে। স্বভাবতই এরা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার।

মহাসড়কে ধান শুকানো বা খড় বিছিয়ে রাখার দৃশ্যও কম দেখা যায় না। আমাদের ২১ শতাংশ মহাসড়কের পাশেই রয়েছে বসতভূমি। খুব সম্ভবত তারাই এমন কাজ করছে সুবিধাজনক বলে বা অভ্যাসবশত। নিশ্চিতভাবেই এদের শিশু-কিশোর ও গরু-বাছুর মহাসড়কে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে বেশি।

১৯২৫ সালে প্রণীত অ্যাক্ট অনুযায়ী, মহাসড়কের পাশে ১০ মিটারের মধ্যে কোনো ধরনের স্থাপনা থাকতে পারবে না। এটা নাকি আমরা কার্যকর করতে পারিনি প্রায় ৫০ শতাংশ মহাসড়কে। তাও ভালো, বাকি ৫০ শতাংশ মহাসড়ক এ শর্ত পূরণ করছে। এগুলোর আশপাশে যাতে বসতবাড়ি, হাটবাজার, কল-কারখানা বা স্কুল-কলেজ গড়ে না ওঠে, সরকার কি তা নিশ্চিত করতে পারবে? গত বছরের ডিসেম্বর থেকে যে আইন কার্যকর হয়েছে, তাতে বলীয়ান হয়ে উঠলে সরকার নিশ্চয়ই এটা করতে পারবে। সে জন্য স্থানীয় সরকার, প্রশাসন আর জনপ্রতিনিধিদেরও রাখতে হবে ভূমিকা। এদেশে জমি কম, মানুষ বেশি আর রয়েছে সুশাসনের ঘাটতি। একে তাই বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হচ্ছে।

বাকি যে ৫০ শতাংশ মহাসড়কের পাশেই কোনো না কোনো স্থাপনা রয়েছে, সেগুলো সরকার সরাবে কীভাবে? এটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। মহাসড়কগুলো একে একে চার লেনবিশিষ্ট করা হলে এমনিতেই অবশ্য আশপাশের জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। যে কোনো অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে দিন দিন এটা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সরকার ওইসব স্থানে উড়ালপথ বানাতে উদ্যোগী হবে কিনা, কে জানে। তার ব্যয়ের দিকটিও বিবেচ্য।

আইনবলে সরকার মহাসড়কের পাশ থেকে সব রকম স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারে বৈকি। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটা বিরোধে যেতে হবে তাকে। সরকারি স্থাপনাও কম নেই মহাসড়কের পাশে। কলকারখানা সরালে তাদের আবার জমি পেতে হবে উপযুক্ত কোথাও। অর্থনীতি, বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ে হাটবাজারেরও ভূমিকা রয়েছে। কম জমি আর বেশি মানুষের দেশে এসবের কাম্য পুনর্বিন্যাস তো সহজ নয়। আর ধাপে ধাপেই কাজটি করতে হবে।

৫০ শতাংশ মহাসড়কের আশেপাশে এ ধরনের স্থাপনা না থাকলে স্বল্প দূরত্বে সার্ভিস দেওয়ার জন্য লোকাল বাসেরও অত প্রয়োজন পড়ত না। তিন চাকার স্বল্পগতির যানবাহনও এত এসে ভিড় করত না মহাসড়কে। এটাই হল মূল কথা।

এ জন্যই নিবন্ধটি শুরু করেছি হাইওয়ে অ্যাক্ট ৯০ বছর ধরে অকার্যকর থাকার খবর দিয়ে। অকার্যকর ছিল বলেই আমাদের মহাসড়কের ৭৩ শতাংশ মানহীন। আদর্শ মহাসড়কের শর্ত পূরণ করে, এমন সড়ক আমাদের নেই বললেই চলে। এখন কথা হল, যেগুলো আদৌ কোনো মহাসড়ক নয়– সরকার চাইছে সেগুলোয় স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ করতে। কিন্তু কড়া মনোভাব নিয়ে সরকার সেটা করতে সক্ষম হলেও মহাসড়কগুলো মহাসড়ক হয়ে উঠবে না। তাকে আরও বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে।

এটা ঠিক, সরকার একযোগে সব শর্ত পূরণে উদ্যোগী হতে পারবে না। তবে কথিত মহাসড়ককে সত্যিকারের মহাসড়ক করে তোলার অংশ হিসেবেই তিন চাকার যানবাহন বন্ধ করা হচ্ছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী কোন বিষয়টি। অযান্ত্রিক ও স্বল্পগতির তিন চাকার যানবাহন যে দায়ী, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এগুলো মহাসড়কে দ্রুত চলাচলও বিঘ্নিত করছে। জায়গায় জায়গায় যানজট তৈরির কারণ এগুলো।

এদিকে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন ফিটনেসবিহীন যান ও নিয়মবহির্ভূতভাবে লাইসেন্স গ্রহণকারী চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। দেশের সড়ক ব্যবস্থায়, বিশেষত মহাসড়কে এ্রগুলো যে দুর্ঘটনার বড় কারণ, সেটা অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা হল, সরকার সব ফিটনেসবিহীন যান আর আনফিট চালক ধরতে গেলে সড়কে যান-চলাচলই দুম করে কমে যাবে। যাত্রী ও পণ্য-পরিবহন ব্যাহত হবে তাতে। জনঅসন্তোষ বেড়ে উঠবে আর পণ্যবাজারে দেখা দেবে সরবরাহ সঙ্কট। জনমতের পরোয়া করে চলতে হয় যে সরকারকে, তারা দেশজুড়ে এ কাজে নেমে পড়বেন বলে মনে হয় না।

তাহলে সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ তিন চাকার সব রকম যান মহাসড়কে চলাচল বন্ধে সরকার দেশব্যাপী একযোগে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন? মহাসড়কে না হলেও তারা আঞ্চলিক ও স্থানীয় সড়কে সার্ভিস দিয়ে উপার্জন করতে পারবে, যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কিন্তু মহাসড়কে এগুলোর ওপর যেসব যাত্রীর নির্ভরশীলতা রয়েছে, তাদের কী হবে? দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা নাকি এখন লোকাল বাসের সঙ্কটে পড়েছে। মহাসড়কে চলাচলকারী তিন চাকার যানবাহনের মালিক ও চালকদের বিক্ষোভে এদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে বলেই মনে হয়।

স্থানীয় অর্থনীতি ও জনজীবন সচল রাখতে এ ধরনের যান চলাচলের একটা ব্যবস্থা রাখা হয় মহাসড়কের বেষ্টনির বাইরে। ওটা রীতিমতো পৃথক সড়ক ব্যবস্থা। আমাদের দেশেও উত্তরবঙ্গের একটি স্থানে এমন ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানি। নিজ চোখে দেখিনি। এখন কথা হল, মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এমন বিকল্প ব্যবস্থা করেই কি মূল সড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করতে হবে? তার আগে নয়?

সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে তেমন কোনো পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে শুনতে পাইনি। সব মহাসড়ককে পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীতকরণের কথাই সরকার বলে চলেছে। সম্প্রসারিত দুই লেনেও বাস-ট্রাক ও কনটেইনারবাহী যানবাহন চলবে। প্রাইভেট কার ধরনের ছোট যানও মহাসড়কে নিরুৎসাহিত করার কথা। প্রাইভেট কারসহ যাত্রী-বহনকারী মাইক্রোবাসগুলো মুখোমুখি সংঘর্ষের শিকার হচ্ছে বেশি। তবে রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা হয়ে গেলে এমন ঘটনা অনেক কমে আসবে।

তার আগ পর্যন্ত মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁকগুলো দূর করার একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাতে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। 'মৃত্যুকূপ' বলে পরিচিত হয়ে ওঠা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। বিপজ্জনক তথ্য হল, মহাসড়কে অবস্থিত ৯৫ শতাংশ কালভার্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ৭৩ শতাংশ মহাসড়কে বাতি নেই। সর্বোচ্চ গতির কথা প্রায় সবখানে লেখা থাকলেও তা মানানোর ব্যবস্থা নেই। আমরা তো এখনও কার্যকর করতে পারিনি হাইওয়ে পুলিশকে।

আইনবলে সরকার অনেক কিছুই করতে পারে। এ অবস্থায় কোনটা আগে আর কীভাবে করবে, সেটা স্থির করতে হবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে। মহাসড়ক নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় জড়িত সব পক্ষের প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত না করে এগোনোরও সুযোগ নেই।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।