‘ইনার আই’ – নগর-চেতনা, সামাজিক-বুদ্ধিমত্তা, সমাজ-বাস্তবতা নিয়ে তিন কড়চা

ফারসীমমান্নানমোহাম্মদী
Published : 30 Sept 2021, 12:33 PM
Updated : 30 Sept 2021, 12:33 PM


পোড় খাওয়া মানুষের একটা অন্তর্চক্ষু জন্মায় – যা অংশত জৈবনিক অংশত অভিজ্ঞতাজাত। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে শিশু ক্রমে শিক্ষা নেয়, সে হয়ে ওঠে প্রৌঢ়। আলেক্সান্দার দ্যুমার বিখ্যাত উপন্যাস 'কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো'তে আমরা দেখেছি এক সরল পরিশ্রমী সাদাসিধে যুবক-নাবিক এডমন্ড দান্তে কীভাবে একজন ধনী প্রাজ্ঞ ব্যক্তিতে পরিণত হন। জীবনের এক-পর্যায়ে তিনি এক দুর্ভেদ্য কারাগারে আটক হন, এবং সেখানেই আরেক সহ-বন্দীর শিক্ষায় তিনি অন্তর্চক্ষু প্রাপ্ত হন। তিনি ক্রমে বুঝতে পারেন কারা-কেন-কীভাবে তাঁকে বন্দিদশায় পতিত করেছে। এই উপন্যাসটি মানুষের এক অনবদ্য জীবন-পাঠ বলে আমি মনে করি। ওরকম 'ইনার-আই' নিয়ে তো মানুষ জন্মায় না, তাকে অর্জন করে নিতে হয়। গবেষক নিবিড় পাঠের মাধ্যমে অন্তর্চক্ষু উন্মীলন করেন, অর্থনীতিবিদ তন্বিষ্ঠ তথ্যানুসন্ধানের সাহায্যে গভীর বোধে পৌঁছান, বিজ্ঞানী কঠোর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃতির অন্তর্গত অর্থ উন্মীলন করেন, রাজনীতিবিদ বহু অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের এবং জনগণের মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেন। একরকমের 'ইনার আই' আমাদের দরকার হয় বলেই প্রতীতি হয় – জীবনে ও কবিতায়। প্রকৃতিকে বুঝতে হলে যেমন তার কণাগুলো কীভাবে কাজ করে, ভৌত-প্রপঞ্চের যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ, জৈবনিক কর্মকাণ্ডের পর্যবেক্ষণ, পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী মধ্যমেয়াদী প্রভাব ও নিয়ামকদের অনুসন্ধান করতে হয় ইত্যাদি। এভাবে একটা বৈজ্ঞানিক 'ইনার আই' তৈরি হয়। সমাজ নিয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের 'ইনার আই' তৈরি হয় সমাজের ভেতরকার নানা দ্বন্দ্বসমূহকে চিহ্নিত করে, অর্থনীতির ঝোঁকগুলোকে চিনে নিয়ে, তার নিয়ামকগুলিকে মডেল করে, মানুষের আন্তঃসম্পর্কগুলোকে বিশ্লেষণ করে, মানুষের মনোজাগতিক চলাচলকে সমঝে, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রবাহকে আমলে নিয়ে। সমাজ সম্পর্কিত 'ইনার আই' আবার সাহিত্যের অন্তর্চক্ষু নির্মাণে ভূমিকা রাখে। সাহিত্যে আবার ভাষা ও ভাষার সংযোগ, মানুষের আশা-আকাঙ্খার বিম্বিত নির্মাণ, মিথ ও মিথের ভূমিকা, ঐতিহ্যের জিজ্ঞাসা, ইতিহাসের সংযোগ 'সাহিত্যিক ইনার আই' গঠনে ভূমিকা রাখে।
জীবন ও জগতের তিনটি ক্ষেত্রে আমাদের অর্জিত অন্তর্চক্ষু কী বলে তা এই কড়চার বিষয়।


চেতনা বা কনশাসনেস নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। আগ্রহ না-হবারও কথা নয়। কেননা এ এক অদ্ভুত জিনিস – একে ঠিক ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, রক্ত দিয়ে আঁকা যায় না। কেবল অনুভব করা যায়। চেতন এবং অচেতনের পার্থক্য আমরা স্পষ্ট বুঝি। মস্তিষ্কই যে চেতনার পীঠস্থান সেটা আমরা জানি। আগে সেটা জানা ছিল না, দীর্ঘকালের গবেষণায়, অনেক মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই জ্ঞান আমাদের লভিত হয়েছে – মস্তিষ্ক আমাদের জানা-বোঝার প্রতিষ্ঠান। আমাদের অনুভূতির উৎস। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মস্তিষ্কের কোন জায়গায় এই চেতনা প্রস্ফুটিত হয়? কেননা, আমরা জানি যে দেখার জায়গা মোটামুটি নির্দিষ্ট আছে, কথা বলার জায়গা আছে, তাহলে চেতনা বা কনশাসনেসের জায়গাও থাকার কথা। কিন্তু সেটা কোথায়? এখনকার বিজ্ঞানীরা বলছেন, চেতনা হল এক এমার্জিং প্রপার্টি বা স্ব-উদ্ভূত প্রপঞ্চ। অনেক জটিল নেটওয়ার্কে যেমন দেখা যায় – সম্পূর্ণটা মিলিত যোগফলের চাইতে বেশি (দ্য হোল ইজ গ্রেটার দ্যান দ্য সাম)। আমাদের মগজের বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরনের মধ্যকার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সংযোগ থেকেই এটা উদ্ভূত হয় – তড়িত-রাসায়নিক ঝড়ের মত একটা মৃদু অস্পষ্ট ব্যাপার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন তাঁদেরও বড় জানা প্রয়োজন, চেতনা কী এবং কোথায়। আরেকটা প্রশ্ন, মানুষের মগজ এত বড় হয় কেন? সেটার একরকমের উত্তর আমরা পাই ছোট্ট একটি সুখপাঠ্য বই 'দি ইনার আই'-এ।


লেখক নিকোলাস হামফ্রে। ২০১২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বেরিয়েছে। বইটি মনন ও চেতনার বিষয় নিয়ে লেখা। একটি জটিল বিষয়কে এত সুন্দর ও সুখপাঠ্য করে পরিবেশন করা হয়েছে, মনেই হবে না যে একটি জটিল বিজ্ঞানের বই পড়ছি, তাও আবার বেশ ছোট। লেখক একজন কৃতবিদ্য সাইকোলজিস্ট, লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের 'স্কুল প্রফেসর'। মাত্র ১৮৮ পৃষ্ঠার এই বইটিতে দশটি অধ্যায়ে লেখক চেতনার উৎস ও তার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ১৯৭১ সালে লেখক রোয়ান্ডার একটি গরিলা রিসার্চ কেন্দ্রে তিন মাস গবেষণার সুযোগ পান। পার্বত্য গরিলাদের খুব কাছ থেকে লেখক পৰ্যবেক্ষণ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখক বুদ্ধিমত্তা ও চেতনার বিবর্তন নিয়ে তাঁর তত্ত্ব নির্মাণ করছেন। মধ্য আশির দশকে চ্যানেল ফোর টেলিভিশনে তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে জড়িয়ে পড়েন। সেই ডকুমেন্টারি নির্মাণের পাশাপাশি লিখিত হয় এই বইটি। হামফ্রে'র বইটির আরও একটি আকর্ষণ মেল কালমানের সুন্দর সব কার্টুন। এই কার্টুনগুলো বড়ই মনোগ্রাহী। কার্টুনগুলো নিজেই একটা সমান্তরাল বক্তব্য দেয়। সার্বিকভাবে এই বইটি বিজ্ঞানকে, এবং মনোবিজ্ঞানকে, খুব আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে। ভ্রমণে নির্ভার পঠনের জন্য এই বইটি সহায়ক হতে পারে নির্দ্বিধায়।
লেখক মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তন ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ঐতিহ্যগতভাবে মস্তিষ্ক ও চেতনা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অগ্রসর হয়েছে। দেকার্তের লেখা তুলে তিনি দেখিয়েছেন, মনন ও চিন্তনের উৎস হিসেবে মানুষ কীভাবে মস্তিষ্কের দিকে তাকাতে শিখেছে। বলা বাহুল্য, হৃদয়ের উৎস একসময় বুক ও বুকের হৃৎপিণ্ড ছিল। এখনো আমরা 'বুকে হাত' রেখে কথা বলি, প্রেমে ব্যর্থ হলে 'বুকে ব্যথা' পাই, হঠাৎ আঘাতে 'বুকটা টনটন' করে ওঠে। কিন্তু বহু বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও শারীরতাত্ত্বিকের গবেষণা থেকে আমরা স্পষ্ট জানি, আমাদের সারা দেহে জালের মতো বিস্তৃত স্নায়ুর কেন্দ্রস্থল হল মাথার করোটির মধ্যে রক্ষিত মস্তিষ্ক। অর্থাৎ মগজই আমাদের আমিত্বের কেন্দ্রস্থল। দেকার্তে ও দ্য ভিঞ্চির লেখা ও ছবিতে আমরা দেখি, কীভাবে রেনেসাঁর যুগের চিন্তাবিদেরা বুঝতে পারছিলেন মগজ আসলে অনেকখানি মেশিনের মতো কাজ করে। দেকার্তে আরও একধাপ এগিয়ে কোনো প্রাণীকে 'আনকনশাস অটোম্যাটা' বা 'স্বয়ংক্রিয় অচেতন মেশিন' বলে অভিহিত করেছিলেন। দার্শনিকেরা নানাভাবে চেতনার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। দেহ ও মনের দ্বৈততা নিয়ে তারা নানাবিধ প্রশ্ন তুলেছেন। বহু চিন্তা করেছেন, অসংখ্য লিখিত মতামত দিয়েছেন, কিন্তু কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। পারার কথাও নয়। কারণ স্টিফেন হকিং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, 'দর্শন মৃত' (- দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন)। দর্শন জীবিত না মৃত, সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো দার্শনিক কূটকচালি দিয়ে একটা পুরোদস্তুর সায়েন্সের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কিনা! প্রচুর পর্যবেক্ষণ ও তাত্ত্বিক গবেষণার একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প দর্শন দিতে পারে কিনা!

মানুষের মনোজগতের হদিস পেতে বিজ্ঞানীরা প্রায়শই বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও ওরাংওটাং নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। মানুষ ও হায়ার প্রাইমেটদের (উচ্চতর নরবানর) মধ্যে মিল অনেকখানি দেখা যায়। সময়ের সাথে মস্তিষ্কের কী ধরনের অদলবদল ঘটেছে, সেটা জানতেও ওই সব হায়ার প্রাইমেটকে নিয়ে নাড়াচাড়া জরুরি। পূর্ব-ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কোনো না কোনো সময়ে আজকালকার হায়ার প্রাইমেটদের মধ্যে দৃশ্যমান বুদ্ধিমত্তার তুল্য বুদ্ধিমানতা মানুষের কোনো ঊর্ধ্বতন পূর্বসুরীরও নিশ্চয় ছিল। লেখক যখন পার্বত্য গরিলাদের খুব কাছ থেকে দেখছিলেন, তখন একথা তাঁর কাছে খুব স্পষ্ট হয়েছিল। তাঁর মনে একটা প্রশ্ন খেলছিল। গরিলাদের জীবন বেশ নিস্তরঙ্গ– খাওয়াদাওয়া, দলবেঁধে ঘোরা, আর ঘুম। তাহলে ওদের অত বড় একটা মগজের কী কাজ? তিনি নিজেই তার উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, দলবদ্ধভাবে থাকার জন্য যে দক্ষতার দরকার, যে ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন, সেটা কিন্তু জরুরি। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে সবাই দলবেঁধে থাকতে পারে না। আমরা মানুষেরাই আমাদের সামাজিক সম্পর্ক থেকে এটা বেশ বুঝতে পারি। কী করলে আমার স্ত্রী রেগে যাবেন, কী করলে বস খুশি থাকেন, কী না-করলে বন্ধুরা সন্তুষ্ট থাকেন – এসব সর্বক্ষণ আমাদের মাথায় খেলতে থাকে। কিংবা আরো স্পষ্ট হয় যদি আমরা এই সময়ের টিভি সোপ-অপেরাগুলি দেখি – কীভাবে কার সর্বনাশ করা যায়, কীভাবে একে অপ্রস্তুত করে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে দ্রুত ওঠা যায় সাফল্যের শিখরে – এসবই সর্বদা কেউ না কেউ ভাবছেন। এসব আন্তসম্পর্ক বিষয় মাথায় খেলানোর জন্য আমাদের এত বড় একটা মগজ লাগে। দলবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ না-থাকলে আমাদের বেঁচে থাকার ব্যাপারটা অনেকটাই সমস্যাসংকুল হয়ে যায়। এই ব্যাপারটাকেই লেখক বলেছেন সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স বা সামাজিক বুদ্ধিমত্তা। সামাজিক দলবদ্ধতা বজায় রাখাই হায়ার প্রাইমেটদের একটা বড় সার্থকতা। এটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়ে তাদেরকে একটা বড় সাহায্য এনে দেয়। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে আজকাল বহু গবেষণা হয়েছে। আজ মস্তিষ্ক সম্পর্কে আমরা আগের থেকে অনেক বেশি জানি এবং ভাল করে জানি। ফ্রান্সিস ক্রিক, কলিন ব্লেকমোর, ক্রিস্টফ কখ, জেরাল্ড এডেলমান, ভি এস রামাচান্দ্রান, ডিক সোয়াব, মাইকেল গাজানিকা, লিসা ফেলডম্যান বারেট, জিউলিউ টোনোনি প্রমুখের গবেষণায় মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশের কার্যকারিতা আমরা জেনেছি। এই মুহূর্তে মানব মস্তিষ্ক মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল বস্তু। কিন্তু এও আমরা জানি, মস্তিষ্কের কোন অংশের কী কী ফাংশন, কোথায় দৃষ্টির স্থান, কোথায় কথা বলার অংশ থাকে, কোন কোন জায়গায় চেতনা বৃদ্ধি পায়। কাজেই মানবচেতনা একটা জটিল জিনিস, কিন্তু এ বইটি অত্যন্ত সহজভাবে চেতনার কিছু অংশ সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।


লেখক বইটি শুরু ও শেষ করেছেন তাহিতির দ্বীপে পল গগ্যাঁর গল্প দিয়ে। গগ্যাঁ নির্ভেজাল মানবজীবনের খোঁজে তাহিতি দ্বীপে গিয়েছিলেন। আদিম নির্ভেজাল মানুষ আর আধুনিক মানুষের সমাজের মধ্যে তফাত আছে, সেটা আমাদের চেতনার ক্রমপরিবর্তনের একটা ইতিহাস দেয়। সেই ইতিহাসের সাপেক্ষে লেখক অন্তর্চক্ষুর ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন – সময়ের সাথে মানবমস্তিষ্কের আকার অন্তত দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, আর সেটাই হলো 'ইনার আই' এর উদ্ভবের ব্যাখ্যা। মানুষের মগজ এতটা বড় না হলে অন্তর্চক্ষু হতে পারত না। মাথার সাইজ বেঢপ হওয়ার এবং 'হোমো সেপিয়েন্সের' মানুষ হবার মূল্য চুকাতে হয়েছে দুটো জায়গায় – মানুষীর বার্থ-কানাল মগজের সাইজের চেয়ে ছোট হওয়ায় জন্মকালীন মৃত্যু-ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া এবং মানুষের সুদীর্ঘ শৈশব।


'ইনার আই' বা অন্তর্চক্ষু একটা অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। আমরা অবশ্য ধর্মশাস্ত্রে এবং সাহিত্যে অন্তর্চক্ষুর কথা শুনেছি। এটা একটা দিব্যচক্ষুর মত ব্যাপার। মস্তিষ্কের কোন কোণায় কী ধরণের ইলেকট্রো-কেমিকাল ঝড়ের ফলে এই দিব্যচক্ষুর ব্যাপারটা উদ্ভূত হয় সেটা স্পষ্ট না জানলেও অন্তর্চক্ষু থাকাটা খারাপ নয়। সেটা শুধু বিজ্ঞান বা সাহিত্যে বা ধর্মে নয়, জাগতিক অন্যান্য ক্ষেত্রেও অন্তর্চক্ষু থাকলে অন্তর্গত অর্থ বিনির্মাণ সহজ হয়। গবেষকের সেজন্য 'ইনার আই' থাকতে হয়। 'ইনার আই' না থাকলে সমাজ বাস্তবতার অর্থ করা যায় না। কেননা উপরতলে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যার প্রকৃত কারণ লুকিয়ে থাকে গভীর অন্তঃস্থলে। সমাজের ওপরতলায় আমরা দেখি অপরাধ বাড়ছে, কিন্তু বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখি আসলে পুলিশের সংখ্যা কমছে, কিংবা কোনো একটি বিশেষ আদালতী রায় সমাজের উপর এমন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে যার ফলে এক দশক পরে কোনো শহরে অপরাধ কমে শান্তির বাতাস বইছে।

অর্থনীতি ও সমাজবাস্তবতায় অন্তর্চাক্ষুস বিশ্লেষণ নিয়ে এক অসাধারণ বর্ণনা আমরা পাই 'ফ্রিকোনমিকস' নামক বইটিতে। বইটির লেখক স্টিভেন লেভিট, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। তাঁর সহ-লেখক স্টিভেন ডাবনার নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার লেখক। দুজন মিলে এই অসাধারণ বইটি লিখেছেন।
বইটির কাহিনি শুরু ২০১৩ সালে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে স্টিফেন ডাবনার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মশাই স্টিভেন লেভিটকে ইন্টারভিউ করেন। বেশ কদিন ধরেই ডাবনার অর্থনীতিকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তো তিনি দেখলেন, একমাত্র লেভিটই সাধারণ মানুষের বোধগম্য সহজ ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসেন, যদিও তখনই লেভিট বেশ নামজাদা (হার্ভার্ডের স্নাতক, এমআইটি ডক্টরেট ইত্যাদি)। কিন্তু লেভিটের ধাঁচটি বেশ অন্য রকম, ঠিক প্রথাবদ্ধ ইকোনমিস্টের মতো নয়। লেভিটের সাদাসিধে স্বীকারোক্তি, 'ইকোনমিকসের ব্যাপারগুলোয় আমি ততটা সিদ্ধহস্ত নই। আমি অঙ্কে ভালো না, ইকোনমিকস জানি না। স্টক মার্কেটের উত্থান-পতন সম্পর্কে বা জাতীয় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি কিছু বলতে পারব না'। তাঁর আগ্রহের বিষয় দৈনন্দিন জীবনের গতি-প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনাচার, আর সব নিচুতলার ধাঁধা যা আর্মচেয়ার ইকোনমিস্টের কাছে বড়জোর ফুটনোট। এই সব আর্থ-সামাজিক ফুটনোট নিয়েই ফ্রিকোনমিকস বইটি সাজানো হয়েছে।

আপনি জানেন কি, ড্রাগ ব্যবসায়ীরা কেন তাদের মায়েদের সঙ্গে থাকে? গত দশকে আমেরিকায় ক্রাইম রেট কমে গেল কী করে? রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ও সুমো কুস্তিগীরদের ব্যাপার-স্যাপার কেন একরকম? কৃষ্ণাঙ্গ পিতা তাঁর সন্তানের এমন নাম কেন রাখেন, যা তাদের ক্যারিয়ারে সাহায্য করে না?
স্কুলশিক্ষকেরা কীভাবে চিট করেন? এইসব মজার মজার প্রশ্নের দারুণ সব উত্তর আছে, যে-উত্তর শুধু ভাসাভাসা চটুল কৌতুক নয়, বরং তাতে মিশে আছে সমাজ-বাস্তবতার রূঢ় সত্য এবং গূঢ় রহস্য। এই প্রশ্নগুলোই স্টিভেন লেভিটের প্রশ্ন আর এইরকম অজস্র প্রশ্ন আর তার তথ্যসমৃদ্ধ উত্তরাবলি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে 'ফ্রিকোনমিক্স' বইটি। চমৎকার এই বইটি যে পাঠকপ্রিয়তা পাবে, সে বিষয়ে অবশ্য লেখকদ্বয় সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু এ বইটি যে কী পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তা বোঝা যায় ২০০৫ সালে প্রকাশিত বইটির পরিমার্জিত সংস্করণ বের হতেই। বর্তমান সংস্করণে বইটিতে ছয়টি অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। সঙ্গে আছে অতিরিক্ত মেটেরিয়াল — 'ফ্রিকোনমিকস' ব্লগ ও একই নামের কলাম থেকে সংগৃহীত নির্বাচিত অংশ।

এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত বিষয়টি, যা সংক্ষেপে আমি বলতে চাই, খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। এটি যদি পাঠকের কাছে মজাদার মনে হয়, তাহলে বইটি কিনে পাঠক বাকিটুকু পড়ে বুঝে নেবেন। এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তু মার্কিন মুলুকের ক্রাইম রেট। যদিও গল্পের শুরু রোমানিয়ার একনায়ক নিকোলাই চসেস্কুকে দিয়ে। ১৯৬৬ সালে, কম্যুনিস্ট-শাসিত রোমানিয়ার শাসন-ক্ষমতা পাওয়ার এক বছর পর চসেস্কু ঘোষণা দিলেন সকল ভ্রূণ-হত্যা অবৈধ। তিনি বলেন, এদের ওপর পুরো সমাজের অধিকার আছে। এই ঘোষণার পরবর্তী বছরেই জন্মহার দ্বিগুণ হলো। আর এরপর থেকেই রোমানিয়ায় জনসংখ্যার বিস্ফোরণ দেখা দেয়। কিন্তু বর্ধিত এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সম্ভব হয়নি। কারণ, তখনকার রোমানিয়ান সমাজে চসেস্কুর আত্মীয় বা কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য না হলে চাকরিবাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল না। এই বর্ধিত জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সাধারণ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। ১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সব অস্থির মানুষ চসেস্কুর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে। এদের হাতেই ক্রিসমাস দিনে প্রাণ হারান চসেস্কু ও তাঁর স্ত্রী। চসেস্কু ওই আইনটি না-করলে যারা তাঁকে হত্যা করল, তারা জন্মাতেই পারত না। এ সেই তরুণ সমাজ, যারা চসেস্কুর অ্যাবরশন-বিরোধী আইনের সরাসরি ফল।
১৯৯০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ক্রাইম রেট কমতে থাকে, তখন তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে বেশ উত্তেজনা দেখা দেয়। কেন এই সংখ্যা কমছে সেটা খোঁজা দরকার। এর আগের দশকগুলোতে দেখা যায় ক্রাইম রেট সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এমন সময় ছিল যখন নিউ ইয়র্ক শহর ছিল সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ শহর, এখনো তাই কিনা বলতে পারি না। কিন্তু সবার দুশ্চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিয়ে এই ক্রাইম রেট পড়া শুরু করল। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত হয়, যা প্রত্যক্ষভাবে অপরাধ কমাতে সাহায্য করেছিল। সেগুলো হলো পুলিশের দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি, কারাগারের ভূমিকা, ড্রাগ মার্কেটের পরিবর্তন, দুষ্ট তরুণদের বয়োবৃদ্ধি, বন্দুক আইনের প্রয়োগ, অর্থনীতির চাঙা ভাব, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি। লেখকদ্বয় এই সব কারণকে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁরা বলছেন, একটি যুগান্তকারী আদালতের রায়ের কথা। ১৯৭৩ সালের ২২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ের সাহায্যে (রো বনাম ওয়েড) সারা দেশে অ্যাবরশন আইন বলবত করে দেন। লেখকদ্বয়ের মতে এই একটি কলমের খোঁচায় একটা বড় জাতি তার একটি দীর্ঘমেয়াদি কষ্টের বোঝা থেকে অবশেষে মুক্তি পায়। লেখকদ্বয় যুক্তি দেখিয়েছেন, একজন মা যখন সন্তান না-চান, তার যথেষ্ট কারণ থাকে। সে হয়তো গরিব থাকে, সে জানে, সে বাচ্চাকে ঠিকভাবে মানুষ করতে পারবে না। সে জানে, হয়তো তার বিয়ে টিকবে না, বা সে প্রতারিতও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তার জীবন খুব উঁচুনিচুর মধ্য দিয়ে যায় – অনেক রকম টানাপোড়েন আর উথালপাতাল অবস্থা তাকে সইতে হবে। সন্তানকে ভালো ভাবে মানুষ করার জন্য পর্যাপ্ত সময়-অর্থ কিছুই তার থাকে না। তখন সে সন্তান নিতে চায় না। যখন সন্তান নিতে তাকে বাধ্য করা হয়, অথচ সে নিতে অপারগ, তখন আকস্মিক ওই সন্তানের প্রতি মায়ের অযত্ন-অবহেলা বেশ প্রকটভাবে দেখা যায়। ওই সন্তানটির তখন অপরাধ-জগতে যাওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক থাকে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পরের বছরই সারা আমেরিকায় সাড়ে সাত লাখ অ্যাবরশন সংঘটিত হয়। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা ষোলো লাখে উন্নীত হয় । অর্থাৎ প্রতি ১৪০ জনে একটি অ্যাবরশন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত সন্তান জন্ম না-নেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ক্রাইম থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে লেখকদ্বয় প্রমাণ করেছেন।

সমাজের এ রকম নানান অসংগতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে লেখকদ্বয় সমাজের গতি-প্রকৃতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এর ফলে নীতি-নির্ধারকদের বুঝতে সুবিধা হয়, কখন কী সামাজিক নীতি নেওয়া প্রয়োজন। নীতি গ্রহণে দূরদর্শিতার প্রয়োজন। সেই জন্য চাই পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান, ডেটার প্রকৃত ব্যবহার, তার যথাযথ মোহমুক্ত ব্যবহার। লেখকদ্বয় তাদের সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন, আমাদের সমাজেও এমনিতরো নানা সমস্যা আছে, যার কারণ নিহিত সমাজের গভীরে। আমাদের যদি এমন সমাজ বিশ্লেষক থাকত, তাহলে আমরা জানতে পারতাম, কেন আমাদের দেশে এই সময়ে ইভ-টিজারদের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কেন ধর্ষণ বেড়েছে, কেন হত্যা বেড়েছে ইত্যাদি। আমরা দশ বছর পরপর শুমারি করি, এত তথ্য আমাদের হাতে, অথচ এই ডেটার সুব্যবহার হয় কি?

অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করতে হবে সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে। তথ্য বা ডেটা শুধু অর্থহীন সংখ্যা নয়, সমাজবৈজ্ঞানিক এবং নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সে তথ্যের অর্থ করা জরুরি। সমাজের ছোট ছোট পাজল বা হেঁয়ালির মাঝে লুকিয়ে থাকে সমাজেরই অন্য কোনো অসুখের কথা, যেটা হয়ত উপরিতলে শোনা যায় না। কিংবা হয়ত আমরা শুনতে চাই না, কিংবা ধামাচাপা দিয়ে রাখি। সেসব প্রপঞ্চ আমাদের সমাজকে যাতে আন্দোলিত না করে তোলে সেইদিকে সমাজ-আর্থনীতিকদের দৃষ্টি রাখা চাই। একথাই লেভিট ও ডাবনারের লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য। লেভিট ও ডাবনারের যুগল লেখনিতে আমরা আরেকটি বইও পেয়েছি – 'সুপারফ্রিকোনমিক্স'। সেটিও কম মজার নয়। বাংলায় এই দুই বইকে উপজীব্য করে মহামতি আকবর আলি খান রচনা করেছেন সরস আরেক বই – 'আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি' (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩)। বাংলা বইটি অবশ্যই 'ফ্রিকোনমিকসের' প্রত্যক্ষ অনুবাদ গ্রন্থ নয়, এখানে ড আকবর আলি খান তাঁর নিজস্ব অধীত বিষয় এবং পর্যবেক্ষণ ও পাঠের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন, সেই সাথে লেভিট ও ডাবনারের বিষয়বস্তু ও পর্যবেক্ষণও উঠে এসেছে। সরস ও জ্ঞানগর্ভ বই তিনটিই পাঠ করলে সমাজ, অর্থনীতি, তথ্য ও তার বিশ্লেষণ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারব, আমাদের 'ইনার আই' সূক্ষ্মতর হবে।


অন্তর্চক্ষু বা ইনার আই-এর আরেকটি উদাহরণ নগরের সংস্কৃতি অবলোকন এবং অনুধাবন। নগর কী বলে, তার নাগরিক কীভাবে চলেন, কেন চলেন, কী দেখেন, কী খান, কী বলেন – এসবের একটা অর্থ আছে। সেই অর্থ জানা দরকার এই কারণে যে তাহলে ঐ নগরের বা নগরকে ঘিরে সৃষ্ট সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনকে বোঝা যায়। এটা একটা দর্পণের মত যাতে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব সত্তার অর্থ-দ্যোতনা স্পষ্ট করে কিংবা বয়ানের অন্তর্গত বয়ান পাঠ বা 'বিটুইন দ্য লাইনস' পড়বার মত একটা ব্যাপার। আমরা ঢাকাবাসী, ঢাকাই আমাদের নগরীতমা! এই নগরে, এবং পার্শ্ববর্তী শহরতলীতে, বাস করে প্রায় দুই কোটি মানুষ। ঢাকা একাই দেশের সমগ্র বিদ্যুতের ৪৬-শতাংশ ভোগ করে। ফলে বোঝা যায়, নগরী একটা দেশকে চেনার জন্যও কতখানি জরুরি।

নগরের সংস্কৃতি বোঝবার জন্য একুশে বইমেলা ২০১১-এ অনেক নতুন বইপত্রের মাঝে একটি ব্যতিক্রমী বই পেয়ে গিয়েছিলাম। বইটির নাম 'কানার হাটবাজার', লেখক তখন অস্ট্রেলিয়ায় ডক্টরেট-গবেষণারত বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টসের অধ্যাপক ড সুমন রহমান। লেখক বাংলার ব্লগগুলোতেও সুপরিচিত একটি নাম। একটি গানের কথা থেকে ধার করে বইটির নামকরণ হয়েছে, আবার বিষয়বস্তু চিন্তা করলে এই নামটি কতই না সার্থক হয়েছে! ছয়টি পর্বে ভাগ করে এ বইয়ের তেইশটি প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। পর্বান্তরগুলো আগে একটু বলে নিই — ভয়ের স্বরলিপি, টানাপোড়েন, মৃত্যুর টেক্সচুয়ালিটি, টেলি-রিয়াল খোয়াবনামা, সেলুলয়েড জাতীয়তাবাদ এবং আর্টের নিম্নবর্গীয়পনা। এই ষড়পর্বের নামগুলোই আগ্রহী পাঠককে টেনে ধরতে যথেষ্ট। নামকরণের ভিন্নধর্মিতাতেই লুকিয়ে আছে বইটির টান।
বইটির বিষয়বস্তুও ভিন্ন প্রকৃতির। বইটির নামের নিচে যে সাব-টাইটেল দেওয়া আছে, তা এই রকম – 'নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম পঠন'। এই বইয়ের রচনাসমূহ নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের টেক্সচুয়াল যোগাযোগের একটি সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন-প্রচেষ্টা — বইটির প্রথম ফ্ল্যাপে এমনটিই লেখা হয়েছে। নগর ও নগরাশ্রয়ী পপ-কালচারকে নিয়ে এ এক অন্যতর সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন। বইটির প্রকৃতিও প্রচলিত বইগুলোর মতো নয়। অনেকটা অ্যালবামধর্মী, সাধারণ আর্ট গ্যালারির ক্যাটালগগুলো যেমন হয় আরকি। পুরো বইতে অনেক সাদাকালো ছবি থাকলেও একটিমাত্র রঙিন ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। তেরো পৃষ্ঠার এই রঙিন ছবিটির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। এটি একটি আলোকচিত্র এবং তার পাঠ, যেখানে একজন বক্তা এবং একজন শ্রোতা দেখা যাচ্ছে, আর কেউ নেই। বাকি সবই ব্যাকগ্রাউন্ড। প্রয়াত রাজনীতিক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার স্মরণে 'শহীদ আসাদ পরিষদের' ডাকা শোকসভার চিত্র। এই ছবির আলোচনায় লেখকের সিদ্ধান্ত: "এই আলোকচিত্র কী সিগনিফাই করে?… চিহ্নশাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে, এটা বাস্তবের বিবৃতি নয়, বরং এই ছবি যে বাস্তবতাকে 'উৎপাদন' করছে, তার বিবৃতি। এক-এগারোর ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। তেমনি সুফল এনে দিয়েছে আনুগত্যের রাজনীতির জন্য"। একটি ছবি কীভাবে একটি জনপদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অর্থবহ করতে পারে, তার একটি সম্ভাব্য বয়ান কীভাবে রচনা করা যেতে পারে তার উদাহরণ আমরা এভাবে পেলাম। এই বই সেই কারণে তথ্যবহুল। প্রয়োজনীয়ও বটে, কেননা বাস্তবের প্রত্যক্ষতার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা 'ইনার আই' কী বলছে, কী দেখাচ্ছে, কী বোঝাচ্ছে, এসবের অর্থ জানাটা দরকার। নইলে আমরা নগর-রাজনীতির সদর্থকতার অর্থ খুঁজতে ব্যর্থ হব, নগর ব্যর্থ হবে। কেননা নগরের অর্থ নাগরিক না বুঝলে নগর কি সুনগর হয়, নাকি ভাবনগরে পর্যবসিত হয়! অর্থাৎ নগরের যে বয়ান তার টেক্সট, তার ভাষা, তার নাগরিক এবং তাদের পরিধেয়, ফ্যাশন, কবিতা, সংবাদ, সিনেমা, স্লোগান, বাজার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে, সেই বয়ানের একটি অন্তর্গত অর্থ থাকা প্রয়োজন।

নগরের আরেকটি পরা-আধুনিক সংযোজন, 'সেলিব্রিটি উৎপাদন': 'তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটিই পাঠককে একটা জোর ধাক্কা দেয়। 'আপনি কি সেলিব্রিটি?'- প্রশ্ন অদ্ভুত হলেও অবান্তর নয়। কারণ দুই-ডজনের বেশি টেলি-চ্যানেলের অর্ধশত রিয়েলিটি শো'র যেকোনো একটিতে হাজির হয়ে আপনিও হতে পারেন সেরা তরুণ 'গানরাজ,' 'সেরা সুন্দরী', 'ম্যাজিক তিন চাকার তারকা' ইত্যাদি। লেখকের প্রশ্ন হচ্ছে গণমাধ্যম হঠাৎ করে আমজনতার মধ্যে এমন গরু খোঁজার মতো তারকা খুঁজতে শুরু করল কেন? এর সম্ভাব্য একটি উত্তর লেখক এখানে দিয়েছেন, কৌতূহলোদ্দীপক এই ব্যাখ্যা পাঠককে অনুপ্রাণিত করবে, "প্রথমত, আমজনতা থেকে প্রতিনিয়ত তারকা উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া গণমাধ্যমে বিদ্যমান রিয়েলিটি শো-গুলিকে স্থায়িত্ব দেয়। ফলে সে একদিকে যেমন ব্যয়-সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে তার দর্শকের মধ্যে উচ্চাভিলাষ জাগানোর মাধ্যমে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন তারকাপ্রবাহ গণমাধ্যমকে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণের স্বাধীনতা দেয়। কারণ এই নতুন সেলিব্রিটিরা স্বীয় গণমাধ্যমের পতাকা বাই-ডিফল্ট বহন করেন, ক্ষীণ আয়ুর কারণেই হয়ত তাদের ব্যক্তিত্ব গণমাধ্যমের রাজনীতির জন্য নিরাপদ থাকে। এভাবে, নতুন নতুন তারকাপ্রবাহের মাধ্যমে গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত নিজের ভেতরে ঢুকে নিজেকেই পুনঃনির্মাণ করে চলেছে … সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে সে নিজে-নিজেই"।

আমজনতার এই 'তারকালীলা' যদিও এ দেশেই প্রথম নয়, কিন্তু লেখক মনে করেন, সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণ নিয়ে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের মধ্যে এই বিসম্বাদ উত্তরোত্তর বাড়বে। বলা বাহুল্য, লেখকের এই ব্যাখ্যা বর্তমানের সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত গজিয়ে ওঠা ক্ষণস্থায়ী সেলিব্রিটিদের সাংস্কৃতিক প্রভাবের এবং/অথবা অনলাইন সংস্কৃতির অসম্পূর্ণ খোলকের ভঙ্গুরতার আভাস দেয়।
ভূমিকম্প এখন নগরের জনসংস্কৃতিতে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই তারও একটি বয়ান এই বইতে ঠাঁই পেয়েছে। লেখক কিছুটা শ্লেষভরে বলেছেন, "টিভির পর্দায় হাসি-হাসি বিশেষজ্ঞ, অবলীলায় বলেন, সিচুয়ান-স্কেলে নয়, বরং মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনই ঢাকা শহরকে ধবংসস্তুপে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। … একটা ভবন থেকে যেখানে রেসকিউ সম্ভব হয় না, সেখানে দেড় কোটি মানুষের ঘিঞ্জি একটা শহরের রেসকিউ!" নগরের এই ভয়ের সুরে মিশে আছে আরেক ভয় – 'তরল ভয়ের স্বরলিপি'- বখাটেদের ভয়। নগরীর মেয়ের বাপেরা এই ভয়ে যারপরনাই আক্রান্ত। এ এমন এক শক, যার আবাস ব্যাকগ্রাউন্ডে, হঠাৎ সামনে এসে আপনাকে গুলি করে আপনার মেয়েকে বলবে, 'তোর বাপ-মা'কে মেরে ফেললাম, এখন একলা থাক!' সেই আসামি আবার জামিনে বেরিয়ে এসে আপনার বড় ছেলেকে ভয় দেখাবে। এই বিষচক্রের খবর আমরা পত্রিকাতেই পড়েছি। এই 'ভয়' নিয়েই আমরা নাগরিকেরা মেট্রোপলিটান শহরে বাস করছি। এই ভয়ার্ত নগরে বাস করেও মানুষ জীবন থেকে পুষ্টি টেনে নেয়। ড. সুমন রহমান আমাদের দেখান, কীভাবে তারুণ্যের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় ব্লগে ব্লগে ছদ্মনামের ছেলেমানুষি ডিজিটাল তাণ্ডবে অথবা কানসাটে বিদ্যুৎ আন্দোলনকে ঘিরে। প্রযুক্তি (ডিজিটাল কিংবা এনার্জি ক্রাইসিস) কীভাবে বয়ানের বিভিন্নতা সৃষ্টি করে এবং তা নগরবাউলদের কীভাবে মেরুকরণ করে, তা দেখা যায় এই বইটিতে।

গত ২০০৯ সালে বীভৎস বিডিআর বিদ্রোহে কানে আসে নতুন এক শব্দ – 'টেলিভিজুয়াল'। কোনো এক দর্শক জানাচ্ছেন, বিদ্রোহসংক্রান্ত তার অভিজ্ঞতা 'টেলিভিজুয়াল' অর্থাৎ টেলিভিশন থেকে জানা-দেখা-বোঝা। এই নতুন টার্মটির সুন্দর প্রয়োগ করেছেন লেখক তাঁর দুই-পর্বের ('টেলিরিয়াল খোয়াবনামা' ও 'সেলুলয়েড জাতীয়তাবাদে') সাতটি প্রবন্ধে। আমরা দেখি, সেন্টিমেন্টাল জাতীয়তাবাদ কীভাবে ক্রিকেটে ঢুকে পড়ে, আর সিঁদেল চোর কিংবা নিঃশব্দ মাতালের মতো করপোরেটও চুপিসারে কব্জা করে সেই ক্রিকেটকেই। তারই সম্প্রসারণ দেখি আমাদের জাতীয় সংগীতের বিকল্প গায়নও হচ্ছে আজকাল 'একালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিদের' (যাদের বিকল্প নাম 'বহুজাতিক করপোরেট') বদৌলতে। আরও অনেক কিছুই ড. সুমন রহমান আমাদের দেখান পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে।
এই বইটি আমাদের শেখায়, কীভাবে ঘটনার অর্থ করতে হয়ত। টেক্সট কীভাবে পড়তে হয়, বিনির্মাণের রাজনীতির প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ ইত্যাদি। 'কানা' নগরবাসীর 'হাটবাজারে' কীভাবে সদাই করতে হয়, সেটাই 'কানার হাটবাজার' শেখায়। এই সুন্দর বইটি পাঁচ বছর ধরে দৈনিক পত্রিকার পাতায়, অনলাইনে, নিউজপেপারে, জার্নালে, ইয়াহু গ্রুপে, ব্লগে, ফেসবুক নোটে লেখকের লেখার বিভিন্ন অংশ থেকে সংকলিত হয়েছে। লেখক জানাচ্ছেন, "এগুলো লিখিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিসরে বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদে। কোনোটা লেখা হয়েছে সাহিত্য-সম্পাদকের তাগাদায়, যদিও সাহিত্য সমালোচনা হয়নি। কোনোটা এসেছে রাষ্ট্রে বিদ্যমান কোনো বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, কোনোটা ফেসবুকে নোট আকারে সবই কোনো না কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা এবং এর সাংস্কৃতিক পরিবেশনাকে ঘিরে"। যাহোক, দুয়েন্দে পাবলিকেশন্সের পাঁচশত টাকা মূল্যের একানব্বই পৃষ্ঠার এই ব্যতিক্রমী বইটি চোখের ঠুলি খুলে আমাদের কানা চেনাতে সাহায্য করে বৈকি! আমার মতো কলাবিদ্যায় অ-পারদর্শী ব্যক্তি যদি বোঝে, নগরকে বুঝতে পেরেছে বলে মনে করে, তাহলে আপনি বুঝবেন না কেন? আমি অধম তাই বলিয়া আপনি উত্তম না হইবেন কেন? এই টেক্সট দ্বারা বঙ্কিম কী বুঝিয়েছেন সত্যিকারে, বইটি পড়ে আপনিও সেটা বুঝে নিন।

অতএব, এটুকু বোঝা গেল, 'ইনার আই' আমাদের একটা অন্তর্গত অর্থের দিকে নিয়ে যায়। অন্তর্চক্ষু প্রস্ফূটিত থাকলে সমাজের-মগজের-অর্থনীতির-নগরের এমনকি আরো অন্যান্য জটিল সিস্টেমের মূল রহস্যটা ধরিয়ে দেবে। এজন্যই বিশ্লেষণ করতে শিখুন, যাচাই-বাছাই করুন, আমাদের মগজের দীর্ঘ জৈব-ইতিহাস সে শিক্ষাই দিয়েছে।
মনে রাখবেন, 'নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোক রেখা'। কবির এই 'ধেয়ান'ই আধুনিক নিউরোসায়েন্সের 'ইনার আই'।