‘অযোগ্য’ কোম্পানিকে কাজ দিতে বলছে বিশ্বব্যাংক

বিডিনিউজ২৪
Published : 27 August 2011, 02:09 PM
Updated : 27 August 2011, 02:09 PM

আমিনূর রহমান রাসেল
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক

ঢাকা, অগাস্ট ২৭ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- সিদ্ধিরগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শর্ত ভেঙে বিদেশি এক ঠিকাদারকে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে স্পেন-দক্ষিণ কোরিয়ার আইসোলাক্স-স্যামসাং জেভি নামের এক কোম্পানিকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এবং বিশ্বব্যাংকের জ্বালানি বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশে ওই বিদেশি কোম্পানি স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন যার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা সংসদ সদস্য মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আর যোগাযোগমন্ত্রীর স্ত্রী ও দুই মেয়ে এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন পরিচালক হিসেবে।

দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও আইসোলাক্স-স্যামসাংকেই কাজটি দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মো. ইকবাল। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্রজেক্টের টাস্ক টিম লিডারও।

এদিকে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বলছে, বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ মেনেই কাজ করছে তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি) দরপত্র ডাকে। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর কোবরা ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং আইসোলাক্স-স্যামসাং ৩৪২ মিলিয়ন ডলারে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দরপ্রস্তাব জমা দেয়। দুটি প্রতিষ্ঠানই একই প্রস্তুতকারকের যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা উল্লেখ করে।

কিন্তু দরপ্রস্তাবে 'অপ্রয়োজনীয়' তথ্য উল্লেখ করায় সর্বনিম্ম দরদাতা কোবরার এবং শর্ত অনুযায়ী এ ধরনের কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় আইসোলাক্স-স্যামসাংয়ের প্রস্তাব 'অযোগ্য' বিবেচনা করে গত ১৩ জানুয়ারি এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের মতামত চায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।

এরপর কয়েক দফা চিঠি চালাচালি ও বৈঠকের পর ৩১ মার্চ বিদ্যুৎ সচিব বরাবরে পাঠানো এক চিঠিতে সর্বোচ্চ দরদাতার 'পূর্ব অভিজ্ঞতার' বিষয়টি ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানায় বিশ্বব্যাংক। এ ব্যাপারে সচিবকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে বলা হয়।

এরপর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ব্যাখা চেয়ে চিঠি পাঠালে সর্বনিম্ম দরদাতাও তাদের প্রস্তাবের বিপরীতে ব্যাখা চাওয়ার সুযোগ চায়। কিন্তু ২৪ জুন বিদ্যুৎ সচিবকে পাঠানো লিখিত মতামতে সর্বনিম্ম দরদাতার প্রস্তাবের ব্যাপারে কোনো সুযোগ না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি সর্বোচ্চ দরদাতার প্রস্তাবটি বিবেচনার সুপারিশ করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকে পাঠানো মূল্যায়ন কমিটির মতামতে বলা হয়, সর্বোচ্চ দরদাতার অভিজ্ঞতা না থাকার বিষয়টি 'আমলে না নিলে' তাদের প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।

এই পর্যায়ে এসে ৫ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে লিখিত অভিযোগ করে সর্বনিু দরদাতা কোবরা। দরপ্রস্তাব বিবেচনা প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে নিরপেক্ষ মূল্যায়নের জন্য অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় প্রতিষ্ঠানটি।

অর্থমন্ত্রী বিষয়টি পর্যালোচনা করে বিদ্যুৎ সচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর কাছে সে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। বরং ১০ অগাস্ট বিশ্বব্যাংকের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মো. ইকবাল এক চিঠিতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিকে জানান, তাদের প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়েছে এবং আইসোলাক্স-স্যামসাংকে কাজটি দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংকের আপত্তি নেই।

অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান ও ইজিসিবির পরিচালক (টেকনিক্যাল) শান্তি রাম রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সব করা হচ্ছে।"

উভয় দরপ্রস্তাব অযোগ্য বিবেচনার পরও সর্বোচ্চ দরদাতাকে কেন কাজ দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যারা অর্থ দিচ্ছে (বিশ্বব্যাংক), তাদের সুপারিশেই আমরা কাজ করছি।"

সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে কেউ ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়েছেন কি না জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি ইজিসিবির পরিচালক।

ইজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন, এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি।"

ঠিকাদার নিয়োগের চুক্তি করতে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর আইসোলাক্স-স্যামসাংয়ের সঙ্গে আলোচনা হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশে আইসোলাক্স-স্যামসাংয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।"

আর বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ বলছেন, অনিয়ম হয় এমন কোনো কাজ করা হবে না।

কোবরার অভিযোগের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মো. ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেকটর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দরপত্রের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সর্বনিু দরদাতা হওয়ার পরও কোবরার প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়নি বলে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি বিশ্বব্যাংককে জানিয়েছে। আর আন্তর্জাতিক ক্রয় মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ায় আইসোলাক্সের প্রস্তাবের বিষয়ে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ সরকার ইজিসিবির মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চুক্তি করলে বিশ্ব ব্যাংকের কোনো আপত্তি থাকবে না।"

২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দুই হাজার ৭৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকার 'সিদ্ধিরগঞ্জ ৩০০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্প' অনুমোদিত হয়।

পরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ মেগাওয়াট করার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ও বেড়ে দ্বিগুণ হয়।

সংশোধিত প্রস্তাব অনুয়ায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ৩ হাজার ৪১ কোটি ১৯ লাখ টাকা দেবে ঋণ হিসেবে। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এআরআর/জিএনএ/১৯১৩ ঘ.