ঈদে হাসপাতালে মেহেদি, নেপথ্যে সড়ক দুর্ঘটনা

বিডিনিউজ২৪
Published : 31 August 2011, 02:21 PM
Updated : 31 August 2011, 02:21 PM

নুরুল ইসলাম হাসিব
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

ঢাকা, অগাস্ট ৩১ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- অন্য সব কিশোর-কিশোরীরা যখন ঈদের আনন্দে মশগুল, হাসপাতালের বেডে কাটা পা নিয়ে শুয়ে আছে ১৪ বছরের মেহেদি হাসান।

গত ১ অগাস্ট খুলনা শহরের আল ফারুক স্কয়ারে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পা কাটা পড়ে।

অন্য দিনের মতোই ওই দিন দুপুরেও সাইকেল চালিয়ে বড়ি ফিরছিলো মেহেদি। পথে আল-ফারুক স্কয়ারে দ্রুতগামী একটি বাস সাইকেলটিকে ধাক্কা দিয়ে তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়।

প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকা মেহেদিকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পরদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর থেকে তার দিন কাটছে এ হাসপাতালের ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বিছানায়।

আতঙ্কিত মেহেদি এখন তার বাড়ি ফিরে যেতে চায় না। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে সে বলে, "আমি বাড়ি যাবো না।"

তার মা জাহানারা বেগম বলেন, হাসপাতালের ওয়ার্ডে কেউ জোরে কথা বললে চিৎকার করে ওঠে মেহেদি।

ছেলের দুর্ঘটনার খবরটি জাহানারার জন্য ছিলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ওই সময় ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। গৃহবধূ জাহানারা চাটনি ও মাটির পাত্রও বানিয়ে থাকেন, যা তার স্বামী বাজারে বিক্রি করেন।

চোখে পানি নিয়ে তিনি জানান, দুর্ঘটনার প্রায় ১২ দিন পরে ঘটনার বর্ণনা দিতে পারে মেহেদি।

ঢামেক হাসপাতালের অস্থিরোগ (অর্থোপেডিক) বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পায়ের সঙ্গে মাথায়ও গুরুতর আঘাত পেয়েছে সে।

চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান বলেন, "মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে সে। পুরো পা থেতলে যাওয়ায় সবগুলো প্রধান টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তার পা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না আমাদের।"

তবে বিপদ এখনো কাটেনি বলে জানান তিনি। মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ায় তার কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না। এজন্য তার পায়ের অপারেশন করতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের উদ্যোক্তা চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "আমরা কখনোই এটা চাই না। আমাদের 'সফল সরকারের' কারণে একটি ছেলে কৈশোরেই তার পা হারাচ্ছে।"

সড়ক দুর্ঘটনায় কাঞ্চনের স্ত্রী মারা যান বেশ ক'বছর আগে। তিনি বলেন, "এটা দেখার কেউ নেই। এখন সবাই তাকে বোঝাবে এই বলে যে, এটা তোমার ভাগ্যে ছিলো, এবং তাকে এটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু এটা বন্ধ হওয়া দরকার।"

মেহেদির জন্য ক্ষতিপূরণও দাবি করেন কাঞ্চন।

তিনি বলেন, "ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমরা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি নেই।"

"এমনকি এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ীরা বিনা শাস্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"

মেহেদির বাবা জাকিরুল ইসলামের জানান, স্থানীয় লোকজন ওই বাসচালককে ধাওয়া করে আটক করে পুলিশের হাতে দেয়। কিন্তু পরে আমরা শুনেছি তাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

তিনি জানান, সাইকেল চালাতে ভালোবাসতো তার ছেলে, এবং প্রতিদিন ওই পথ দিয়েই স্কুলে যাওয়া-আসা করতো।

অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, রোগীকে কতোদিন হাসপাতালে থাকতে হবে তা অনিশ্চিত।

"তার কিডনি কী অবস্থায় আছে তা জানতে যেসব পরীক্ষা করা দরকার সে খরচ করার সামর্থ এ পরিবারের নেই। পরিবারটির সহায়তা প্রয়োজন।"

এই হতভাগ্য কিশোরকে বরিশালে তার দাদাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বাবা-মা। যদি সে সুস্থ হয়ে ওঠে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিট্যাশনের একটি জরিপে দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের ৫৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ছয় হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আহত হয় এর আট থেকে ১০ গুণ বেশি মানুষ।

গত ১৩ অগাস্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক আশফাক (মিশুক) মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পরে সড়কপথে নিরাপত্তার দাবি আরো জোরদার হয়ে ওঠে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এনআইএইচ/কিউএইচ/পিডি/১৭১৫ ঘ.