বিধান সভার নির্বাচন: ভোটের রাজ্যে জামাই-আদর

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 4 Sept 2011, 08:23 PM
Updated : 26 April 2016, 07:18 PM

ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ভোট যত এগিয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়েছে শাসক তৃণমূলের পরাজয়। আর এই পরাজয় যত স্পষ্ট হচ্ছে ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে তৃণমূল্যের নেতা-কর্মী সংগঠকরা। পাঁচ দফা ভোটের মধ্যেই প্রাণ গেছে চারজন নিরপরাধ সাধারণ ভোটকর্মীর। সোমবারের ভোট হল বাংলাদেশ-লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলায়। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এজেন্সিগুলির সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের জামাতপন্থীদের এপারে নিয়ে এসেছে শাসক তৃণমূলের নেতারা। উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকারগুলি লুটের মূল কারিগর হবে এরাই।

বাংলাদেশ থেকে আসা এই বিশেষজ্ঞ দুস্কৃতিদের এপারে ডাকা হচ্ছে 'জামাই' নামে। গত তিন-চার সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় 'জামাই'দের নিয়ে আসা হয়েছে এপার বাংলায়। বনগাঁ, বসিরহাট, স্বরূপনগর, হাওড়া হয়ে এই জামাইদের নিয়ে আসা হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দরের লাগোয়া বাগুইআটি এবং কেষ্টপুর অঞ্চল পর্যন্ত। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে সারা বছর যারা চোরাচালান করে তারাই এখন কিছুদিন চোরাচালানের কাজ বন্ধ রেখে ভোটের কাজ করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে আসা জামাইদের নিরাপদ জায়গায় রাখা, তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় দেখভালের দায়িত্বে এখন চোরাচালানকারীরাই।

সীমান্ত পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এজেন্সিগুলির বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছর ধরেই বাংলাদেশি জামাইদের ভোটের সময় নিয়ে এসেছে তৃণমূল। আর সে কারণেই বাকি সময়টা জুড়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগও রেখে চলেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা এ-ও জানতে পেরেছেন যে, জামায়াত সূত্রেই কয়েকশ কোটি টাকা পৌছেছে তৃণমূলের হাতে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ধরে এসেছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ।

ভোট ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর থেকে নানাভাবে কাজে লাগানো হয়েছে জামাইদের। ভোটারদের ভয় দেখানো, বুথ দখল করে রিগিং এবং ভোট লুঠ। এমনকি নির্বাচনী প্রচার মিছিলগুলির আয়তন বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশি জামাইদের। এর পাশাপাশি দিনের বেলা বাইক-বাহিনী তৈরি করে এলাকার পর এলাকায় ভয় দেখিয়ে ঘুরে বেড়ানো আর রাতের বেলা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হুমকি দেওয়ার কাজও রয়েছে। হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে ভোটের দিন বুথমুখো হলেই গুলি বা বোমা খেতে হবে। প্রত্যেকটা কাজই জামাইরা করছে অত্যন্ত পেশাদারি ভঙ্গিতে।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অন্তত আটটা জেলায় জামাইরা কাজ করছে। ২০১১ সালের বিধান সভায় এই আটটি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সীমান্তে কর্মরত এই শীর্ষ পুলিশ কর্তা জানিয়েছেন, মানুষ, জামাকাপড়, মাদক, সোনা, গরু পাচার করার আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট রয়েছে সীমান্তে। সারা বছর যাতে এই সিন্ডিকেটগুলো মসৃণভাবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করেন রাজনীতিকরা। পরিবর্তে ভোটের সময় ঐ রাজনীতিকদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য দিনরাত এক করে দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এখানে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। যা রয়েছে তা হল নিখাঁদ এক পেশাদারি সম্পর্ক।

পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ইট-বালি-চুন-সরবরাহের সিন্ডিকেট কাজ করে, সেভাবেই কাজ করে সীমান্তের চোরাচালানের সিন্ডিকেটগুলো। একটি স্টিং অপারেশনে বিধান নগরের মেয়র স্বীকারও করে নিয়েছেন যে, সারা বছর তিনি সিন্ডিকেটকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। আর বছরে একবার ভোটের সময় এই সিন্ডিকেটই তার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মূল কাণ্ডারি হিসেবে কাজ করে। যোগাযোগ করা হলে এমনই এক সিন্ডিকেট সদস্য জানিয়েছেন, 'দাদা বলেছে ভোটের সময় কাজ বন্ধ রেখে জামাইদের পরিচালনা করতে'।

গোয়েন্দা কর্তারা জানিয়েছেন, জামায়াতপন্থী বলে নয়, এরা বাংলাদেশ থেকে ডেপুটেশনে কলকাতার এসে যে পরিমাণ খাতির-যত্ন পায় সেই জায়গা থেকেই এদের 'জামাই' বলে ডাকা হয়। সীমান্ত পার করিয়ে নিয়ে এসে জামাইদের নিয়মিত কাজে লাগিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির বনগাঁ অঞ্চলের নেতা কে ভি বিশ্বাস জানিয়েছেন, এদের ওপর যাতে সন্দেহ না হয় সে কারণে জামাইদের জাল পরিচয়পত্র ও ভোটার কার্ডও তৈরি করিয়ে দেয় তৃণমূল।

জামাই পারাপার করানোর এক তৃণমূলী নেতা জানিয়েছেন, ক্যারিয়ার বা লিংকম্যানরাই জামাই আনতে সাহায্য করে। নদীপথে নৌকো করে নিয়ে আসা হয় এদের। নৌকোর কাঠের পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখা হয় জামাইদের। তারপর ছোট ছোট দল তৈরি করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সীমান্তের গ্রামগুলিতে। সেখানে তাদের জামাই-আদরের সব রকম ব্যবস্থাই থাকে। সেখানে দিন কয়েক থেকে বিশ্রাম নিয়ে নেমে পড়ে কাজে। সে সময় তারা থাকে শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন তৃণমূলী নেতার আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে। আটটি বিধান সভা কেন্দ্রের ৩৬৫ কিলোমিটার এলাকায় কোনো কাঁটাতার নেই। সে পথেই আসেন তারা।

আর তাছাড়া জামাইদের আটকাতে পারে– জামাইদের এত সাধ্য কই?