জেনারেল শংকর রায়চৌধুরী ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান। ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কারগিল যুদ্ধের পরপরই পশ্চিম বঙ্গ থেকে ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন তিনি।
রাজ্যসভার সদস্য থাকার সময় ২০০২ সালে পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয় তার সেনা জীবনের স্মৃতিকথা, 'অফিশিয়ালি অ্যাট পিস: রিফ্লেকশনস অন দ্য আর্মি অ্যান্ড ইটস রোল ইন ট্রাবলড টাইমস'। কলকাতার সল্টলেকে নিজের বাসভবনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সাবেক এই সেনাপ্রধান সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাংবাদিক এস এন এম আবদিকে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কোন ছবিগুলো আপনার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে?
উত্তর: বাংলাদেশের কথা মনে এলেই আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের একেবারে ভেতরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে আমি যোগ দিয়েছি মেজর হিসেবে।
প্রশ্ন: কোন অভিযান? অপারেশন জ্যাকপট?
উত্তর: হ্যাঁ, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হামলা করার জন্য তৈরি করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোপন অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল এটা। বলাই বাহুল্য, এ অভিযানটি ছিল খুবই সফল। আমি ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ভারতে ফেরার আগে কুষ্টিয়া, বরিশাল, খুলনা ও যশোরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।
প্রশ্ন: ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আপনার কি কোনো পরামর্শ আছে?
উত্তর: তাদের আগেও সাক্ষাৎ হয়েছে, এটা একটা ভালো দিক। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তাদের মধ্যে একটা সমঝোতা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু ও প্রতিবেশী। এখন সময় এসেছে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার। বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতকে বাংলাদেশের পণ্যের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শক্তিশালী ও আন্তরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই জোরদার করবে। আমি আশা করি, ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেসের মতো ঢাকা-আগরতলা ট্রেনও চালু হবে।
প্রশ্ন: এক থেকে ১০ এর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আপনি কত দেবেন?
উত্তর: বর্তমানের হিসেবে আট বা এর কিছু বেশি। দশে দশ অর্জন করা তো খুবই কঠিন। তাই দুই দেশকেই চেষ্টা করতে হবে তা যেন আটের নিচে না নামে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার আগে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কিন্তু দুই-তিনে নেমে গিয়েছিল। বিএনপির শাসনামলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছিলÑএ বিষয়টি কিন্তু আমাদের এড়িয়ে গেলে চলবে না।
প্রশ্ন: দুই দেশের সীমানায় বাংলাদেশের আড়াইগুণ বেশি ভারতীয় সেনা উপস্থিতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?- না এর মাধ্যমে ভারত তার সামরিক শক্তি দেখাচ্ছে?
উত্তর: বাস্তবতা কিন্তু বলে, এর প্রয়োজনীয়তা আছে। আর সেনাবাহিনী কিন্তু বাংলাদেশের সীমানায় সরাসরি মোতায়েন করা নেই। আমাদের বিএসএফ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। দুই দেশের চোরাকারবারি, অপরাধী ছাড়াও অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী ঠেকাতে বিএসএফ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। তাই বিপুল সংখ্যায় তাদের মোতায়েন করাটা দুই দেশের স্বার্থের জন্যই দরকার। আমি জানি না, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের কতটুকু অংশে এখনও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি। এ কাজটি খুব দ্রুত শেষ করতে হবে। এটা অনেক সমস্যারই সমাধান করবে।
প্রশ্ন: দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক কেমন? আপনি কি মনে করেন, যেখানে কূটনীতিকরা ব্যর্থ সেখানে সামরিক বাহিনী সফল হতে পারবে?
উত্তর: বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অনেক ছোট। ভারতের সেনাবাহিনীর উচিত, তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তান বা চীনের সেনাবাহিনীর মতো একটা হুমকি নয়। যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, দুই দেশের সেনাবাহিনীর সম্পর্কটা ছিল আনুষ্ঠানিক। কিন্তু এখন এ সম্পর্কটা আন্তরিক। মোদ্দাকথা হলো, ১৯৭১ সালের পর আমরা কখনই বাংলাদেশের সীমান্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। কারণ কখনই কোনো বড় ধরনের সহিংসতা দেখা যায়নি। যখন দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকে, তখন কূটনীতিকরা বিবাদ ঘটানোর সুযোগ কম পান।
আমি সেনাবাহিনীর প্রধান থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সামলাতেন। অনেক বার আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ভারসাম্য বজায় রাখার উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সতর্ক থেকে শান্তি বজায় রাখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: ভারতের সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলেন, পাকিস্তান কি বাংলাদেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখার চেষ্টা করছে?
উত্তর: বাংলাদেশে পাকিস্তানের একটা শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থানের পন্থা নিতে পাকিস্তান বাংলাদেশ সেনাবাহনীকে প্ররোচিত করেছে। এই পাকিস্তানের জন্যই একটা সময় বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশী সেনাবাহিনী ভারতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ণয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরামর্শ চেয়েছিল। তাই ভারতীয় সামরিক বাহিনী সবসময়ই ঢাকা-ইসলামাবাদের সামরিক সর্ম্পকর ওপর চোখ রেখেছে।
প্রশ্ন: চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে ঢাকার একটা বিশেষ আগ্রহ আছে বলে আপনি মনে করেন কেন?
উত্তর: চীন বিশাল একটি অর্থনৈতিক শক্তি। তারা বাংলাদেশকে ভারতের চেয়ে বেশি সুবিধা দিতে পারে। চীনারা চাইলে অনেক খোলামেলা হতে পারে। তাদের সামরিক বাহিনী নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু চীন মোটেও বন্ধুভাবাপন্ন দেশ নয়। তারা বাংলাদেশকে অনেক ভর্তুকি দিয়ে সামরিক সরঞ্জাম দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থেই বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার ওপর চোখ রাখতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তর: বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি ভালো পেশাদার বাহিনী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণ জোরালো। ভারতীয় বা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতো বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও খুব ভালো। জনবলের পরিমাণ ভালো। কিন্তু সরঞ্জামের দিক দিয়ে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ধারেকাছেও নেই।
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে পর আপনি কি আর বাংলাদেশে গিয়েছেন?
উত্তর: ৩০ বছর পর আমি আবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম ২০০১ সালে। গিয়েছি সংসদীয় প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে। শেখ হাসিনা তখন ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের সরকার আর জনগণ খুবই আন্তরিক। তারা ভারতের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক তৈরি করতে চায়।
১৯৭১ সালে আমি দেখেছিলাম যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অনুন্নত এক দেশ। তিন দশক পরে বাংলাদেশ নির্মাণ ও স্থিতিশীলতার পথে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বাংলাদেশে এসে মুক্তিবাহিনীতে আমার সঙ্গে থাকা তৌফিক-ই-ইলাহী, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও শফিউল্লাহ – এর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি ভারতের বদলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান হলে কোন কোন বিষয় আপনার উদ্বেগের কারণ হতো?
উত্তর: ভারতের সেনা সক্ষমতা অবশ্যই অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে যেকোনো উপায়ে তার ভূমি রক্ষা করতেই হবে। বাংলাদেশের সব সেনাবাহিনী প্রধান স্বভাবতই এটা মাথায় রেখেই তাদের পরিকল্পনাগুলো করেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, শরীফ উল্লাহ