আত্মঘাতী তারুণ্য: সাবধান বাংলাদেশ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 10 Sept 2011, 09:07 PM
Updated : 8 July 2016, 11:36 AM

মন ভালো হবার কোনো কারণ নেই। বরং সব দেখেশুনে জেনে ভালো থাকাটাই দায় হয়ে উঠছে আমাদের। এমন দেশ কি হবার কথা ছিল? নাকি এমন দেশের জন্য লড়াই করেছিল আমাদের অগ্রজেরা?

জানি এসব কথার এখন আর কোনো মূল্য নেই। জীবন যেখানে অনিরাপদ, পশু জবাই করার মতো তাদের জীবন জবাই করছে কসাই যুবকেরা, কী করে ভালো থাকবে মানুষ? এ কেমন সমাজ নির্মাণ করেছি আমরা? কখন কবে কীভাবে পাল্টে গেল বাংলাদেশ? আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা যেখান থেকে পেছন ফেরার মানে হল দেশের বিনাশ অথবা জাতিগত আত্মহত্যা। আমরা কি তাই করব? না, আমরা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াব?

এখন তো ব্লেইম-গেইমের সময় নয। কেন আমরা বলছি সব দায় ভারত, আমেরিকা বা মোসাদের? কেন আমরা ধরে নিচ্ছি মদদদাতা পাকিস্তান? আমাদের কি এটা ভাবতে হবে না যে, নিজেদের দোষ কোথায়? কেন আমাদের তারুণ্য আজ বিপথগামী? কোন রাজনীতি, কোন অন্ধবিশ্বাস এখানে কাজ করছে?

আজ যখন দেশ বিপদে, আজ যখন সমাজ আক্রান্ত, আমাদের সামনে আসছে লোমহর্ষক সব খবর। কেন এতদিন এসব কথা জানা ছিল না? কেন সমাজ জেনেও ঘুমিয়ে ছিল? এই যে ছেলেরা পালিয়ে গেছে বা ঘরছাড়া এটা তো সহজ কোনো ঘটনা হতে পারে না। পরিবার এতদিন ধরে কী করেছে?

আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবারপ্রথা কি এমন যে, একটা জিডি করলেই দায় চুকে যায়? এটা কি সে দেশ নয়, যেখানে একটি বালক হারালে এলাকাজুড়ে মাইকিং হয়? আশপাশের মানুষ পরিচিতজনদের ঘুম ছুটে যায়? এমনও দেখেছি, মায়েরা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেন। পাগলের মতো হয়ে যান। পিতাদের কাজকর্মে মন লাগে না। ভাইবোনেরা কান্না আর আতংকে দিন কাটায়।

এইসব যুবকরা কি তবে পরিবারের কেউ নয়? কেন তাদের খোঁজার বেলায় এত দীনতা ছিল?

সমাজের এই দিকটা কেন আমরা ভাবছি না? আমাদের পরিবারের ভেতরেও যে হিংসা আর বিদ্বেষের বীজ তাতে সেখানে ঢুকে গেছে ধর্মের নামে মারাত্মক সব বিপদ। হয়তো তার একটা নেতিবাচক প্রভাব এসব তরুণদের ওপর পড়েছিল।

আগেও লিখেছি প্রস্তুতিহীন যে কোনো কিছুই ভয়ংকর হতে পারে। এই যে আমাদের তরুণদের হাতে তরুণীদের কাছে ওপেন মিডিয়া, এর যেমন পজিটিভ দিক আছে, তেমন নেগেটিভ দিকটা ভাবাও জরুরি। তারা আন্তর্জাতিকতার নামে আন-এডিটেড মিডিয়ার গুজবের শিকার। আমেরিকা, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান, আইএস মিলে এ এমন এক জগত যেখানে নিত্যনতুন গুজব আর নানা ধরনের উস্কানি। যে কোনো ঘটনা মাথায় রক্ত তুলে দেওয়ার মতো করে প্রচার চলছে চারদিকে।

মুশকিল এই, যার যার দায় তার তার এ কথা ভুলে বিশ্বসংসারের মুসলমানের দায় মাথায় নেওয়ার এক আজগুবি চক্রান্তের শিকার এই তারুণ্য। খেয়াল করলে দেখবেন যে, মাদ্রাসার নিরীহ সাধারণ ছাত্ররা এর ভেতর নেই। তাদের চালায় দেশের রাজনীতি। নিয়ে এলে শাপলায় আসে। পুলিশ বাতি নিভিয়ে দিলে গোলাগুলি দূরে থাক, বাড়ি ফিরতেও জানে না। এরা ধার্মিক তবে জঙ্গি নয়। কেন?

কারণ আজকের জঙ্গিদের দরকার ট্রেনিং– তাদের হাতে থাকবে আধুনিক অস্ত্র– তারা জানবে কী করে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। তাদের মাথা ও মগজে নানা কৌশল– বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যাওয়া কিংবা গলা-কাটার নিয়ম-কৌশল সব ঢোকানো হয়। অল্প বা ধর্মীয় লেখাপড়া জানা তরুণরা তা পারবে না। এখন আর স্লোগান বা রাস্তা বন্ধ করে চিৎকার করার দাপটে কাজ হয় না। তাই এদের দরকার লেখাপড়া জানা তারুণ্য।

এই সহজ হিসাবে মাথা পচে-যাওয়া বিপথগামী যুবকরা দেশে দেশে নিজেদের জীবন হারিয়ে সন্ত্রাসের শিকার। আমরা বাদ যাব কোন দুঃখে?

যে কারণে বলছিলাম, এখন নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। দুনিয়ার সব দেশ সব জাতিতে সমস্যা আছে। থাকবে। ইন্দোনেশিয়ার স্বল্পকালীন সময়ের প্রেসিডেন্ট ইসলামিক স্কলার আবদুর রহমান ওয়াহিদ বলতেন, ফিলিস্তানি সমস্যার দায় তিনি নেবেন না। তিনি সাহায্য করবেন বটে, ঝামেলায় জড়াবেন না। কথাগুলো এখন খুব দরকারি। বিশ্বসংসারের দায় বাঙালির হাতে দেয়নি কেউ। যার যার সমস্যার সমাধান করবে তারা নিজেরা নিজেরা।

জঙ্গি হয়ে দু চারটে মানুষ বা কিছু লোকসান করে কেউ কোনো দিন পৃথিবীর কিছু থামাতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এটা ইসলামস্বীকৃতও নয়। তবু আজ এর দায় চুকাচ্ছি আমরা।

আমি বলব এর জন্য আমাদের সমাজের সুশীল নামে পরিচিতজনরাও কম দায়ী নয়। একটা সময় ছিল যখন সংস্কৃতি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। সুবিধাবাদ তাকে গিলে খেয়েছে। যৌবনের প্রাক-পর্বে মানুষের মন ও মননের পরিচর্যা করে সংস্কৃতি। আমাদের দেশের শিশু সংগঠনগুলো মৃত। কিশোর-কিশোরীদের জন্যও কোনো সংগঠন নেই। যৌবনে নেই উজ্জ্বলতা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া তাদের যাবার জায়গা কোথায়?

যারা এসবে যায় না তাদের জন্য বাকি থাকল অনলাইন-নির্ভর নীল পর্দার জগত যেখানে একদিকে অতল আহ্বান আরেক দিকে এখন উন্মাদনা। এইসব তরুণরা শেষেরটার শিকার। বিকৃত বুদ্ধিজীবী ও সুশীলদের এক দল সরকারের নামে সুবিধাবাদের শিকার। অন্য দল আছে ভারত ও হিন্দু-বিদ্বেষের নামে জামাত-তোষণে ব্যস্ত।

এই বদলে যাওয়া সুশীলরা যেখানে নিহত ফারাজের জন্য কেঁদে বুক ভাসায়, আবার দায় নিতে চায় না। তখন তাদের বলার সুর পাল্টে যায়। বলেন, সব নাকি চাপিয়ে দেওয়া অন্য কারও কারসাজি। কোথায় মূলে গিয়ে কারা ট্রেনিং দিল, কারা এসব আস্তানা চালায় বা কেন এমন হচ্ছে, তা নিয়ে জনমত গড়ে তুলবেন– তা না করে এরা আছেন আত্মপ্রশান্তির এক কঠিন স্বার্থপর অবস্খানে। এভাবে চললে এ সমস্যার সমাধান মিলবে না।

যেসব তরুণ বা যুবক হারিয়ে গেছে বলে বলা হচ্ছে বা যাদের ফিরে আসার জন্য রেডিও-টিভিতে ডাক পাঠানো হচ্ছে তারা কি আসলে পলাতক? তারা তো স্বেচ্ছায় লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে অাছে বলাটাও ঠিক নয়। এরা কিলিং মিশনের সদস্য, আত্মঘাতী। জীবনকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কেউ পালায় না। তারা গেছে নিজেদের অন্ধবিশ্বাস ও জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য। সুবোধ ডাকে বা সরকার কিংবা জনগণের ডাকে ফেরার মগজ তারা হারিয়েছে অনেক আগে। যারা মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের কথা মনে রাখেনি তারা শুনবে সাধুবচন! ডাকলেই চলে আসবে তারা!

আসবে না জেনেও এই প্রচারের একটা ভালো দিক তাদের চিহ্নিত করা। আরেকটা যেটা মন্দ সেটা হচ্ছে, তারা যদি জেনে যায় সময় কম, আরও হিংস্রতাই হয়তো ডেকে আনতে চাইবে। তাই এখন সাবধানতার সময়। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় গলিতে গলিতে মানুষ যদি কারও আচরণ বা স্বভাবে পরিবর্তন দেখে ভয় পায়, জানাতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজে বাঁচুন, অপরকে বাঁচান, এই বাণীর বিকল্প নেই আজ।

সবার আগে পরিবারে চাই শুদ্ধতা। মনের কোণে বা চিন্তায় যে কোনো ধনের সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ পুষে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বিরোধিতার নামে উস্কানি বা প্রশ্রয় দিলে এ কাজ হবে না। আমরা এমন দেশে থাকার কথা ভাবিনি। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদেরও এমন দেশে থাকার কথা ভাবি না। মানুষ কি এরপরও চুপ থাকবে? চাইবে কি এদেশ বাংলাস্তানে পরিণত হোক?

আজ যে ঘর বা বাড়ি নিরাপদ, কাল যে তা রক্তাক্ত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সাবধান স্বদেশ। সাবধান রাজনীতি। সাবধান বাঙালি।