রবীন্দ্রনাথ: সৃজনীশক্তির উৎসসন্ধান

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 10 Sept 2011, 09:13 PM
Updated : 8 May 2022, 05:24 AM


আশি বছরের আপাতদীর্ঘ, সৃজনে বিপুল, ফুল্লময় জীবন। এ এমন জীবন, যার তুলনা হয় না। পৃথিবীর দেশে দেশে কালে কালে কত কবি, কত দ্রষ্টা, কত সাহিত্যিক জন্মালেন, কিন্তু একটি জাতির সৃজনবেদনার সকল দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সে জাতিকে, তার সাহিত্যকে পরিপূর্ণ সাবালকত্ব এনে দিয়েছেন-এমন দৃষ্টান্ত আর কোথায় আছে! তিনি রবীন্দ্রনাথ। '…শুধু কবি নন,-বড় কবি, মহাকবি, বিশ্বকবি মাত্র নন-তিনি রবীন্দ্রনাথ, এ কাল পার হয়ে অনন্তকালের দিকে যার স্পর্শ প্রসারিত, নিয়তই আরো সম্পূর্ণতার দিকে যার দৃষ্টি।' (হাসান হাফিজুর রহমান, ১৯৬৪)
তাঁর জীবন যেন এক প্রহেলিকা। জন্মসূত্রে বিলাসপ্রিয় জমিদারনন্দন হবার কথা ছিল। বিলেতফেরত ব্যারিস্টার হয়ে জাগতিক সমৃদ্ধির গজদন্তমিনারে অবস্থানের কথা ছিল। বিত্তবাসনায় ঢেলে দেয়ার কথা ছিল মনপ্রাণ। কিন্তু কিছুই হলো না। হাতে তুলে নিলেন কলম। লিখলেন কবিতা। গান। নাটক। রক্তের অক্ষরে নিজের রূপ দেখলেন। আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায় আবিষ্কার করলেন সত্যকে। সে সত্যই প্রতিভাত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে, গল্পে ও উপন্যাসে। সৃজনীপ্রতিভার এমন বিপুল বিস্তার, এমন অতুলনীয় বৈভব তুলনাবিরল। রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশতাব্দী পেরিয়েও আমরা এখনও তাই বুঁদ হয়ে আছি তাঁর সৃষ্টিতে।

সারাজীবন মানবতার জয়গান গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবন দুঃখময়, কবির জীবনেও বারবার আঘাত হেনেছে মৃত্যুশোক। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই-বোন-জীবদ্দশাতেই একের পর এক নিকটাত্মীয়কে হারিয়েছেন। তবু এরই মধ্যে মেতে থেকেছেন সৃষ্টির সাধনায়। সংসার থেকে সহস্র আঘাত ও যন্ত্রণার পরও এই পৃথিবীর ধুলিকণাকে ভালোবেসেছেন কবি, লিখেছেন-
"এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি-
অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহার
মধুরসে ক্ষয় নাই তার।
তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে-
সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দ বিরাজে।"
কেবল কবিতা আর গান লিখে, ভুরি ভুরি গল্প-উপন্যাস লিখে দায়িত্ব শেষ করলে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হতেন না। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতনের মতো প্রতিষ্ঠান। ছবি এঁকেছেন। দেশেল কল্যাণে কাজ করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচার অনাচরের প্রতিবাদ করেছেন। অনুজ সাহিত্যকদের পথ দেখিয়েছেন। পান্থজনের সখা হয়েছেন, আর্তের বন্ধু, ব্যথিতের সমব্যথী। মনুষ্যত্বের অপমান আর অবহেলা দেখলেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহিত্যসাধনার বাইরেও এক বৃহৎ কর্তব্যের ডাক নিরন্তর শুনেছেন অন্তঃকরণের মধ্যে। সে ডাক তাঁকে স্থির থাকতে দেয়নি। ব্যক্তিজীবনের হাজারও দুর্ভোগ, যন্ত্রণা আর দায়িত্বের মধ্যেও সাড়া দিয়েছেন সে ডাকে। যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরাই অনুভব করেছেন তাঁর দিব্যজ্যোতি। জসীম উদ্দীনের ভাষায়, 'কবি যখন আমার সঙ্গে কথা বলতেন, মনে হইত, তিনি যেন কোনো শিশুর সঙ্গে কথা বলিতেছেন। কখনো তুমি বলিতেন, কখনো তুই বলিতেন। কবির কাছ হইতে যখন ফিরিয়া আসিতাম, মনে হইত যেন কোনো মহাকাব্য পাঠ করিয়া এই ক্ষণে উঠিয়া আসিতেছি। সেই মহাকাব্যের সুরলহরী বহুদিন অন্তরকে সুখস্বপ্নে ভরিয়া রাখিত। তাঁর নিকট হইতে আসিলে মনে হইত, কী যেন অমূল্য সম্পদ পাইয়া আসিয়াছি।' (জসীম উদ দীন, ১৯৬৩)

মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে জীবনদেবতার অন্বেষণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সংসারের মধ্যে ডুবে থেকেও ছিলেন সংসারবিবাগী। জাগতিক কোনো সম্পদ, খ্যাতি বা পদ-পদবির মোহ তাঁকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করতে পারেনি। কেবল সাহিত্যসৃষ্টিতেই ছিল তাঁর পরমানন্দ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তাই সৃষ্টির ক্ষুধা কমেনি তাঁর। জীবনের নানা পর্বে কবিতায়, গানে, গল্পে উন্মোচন করতে চেয়েছেন নতুন দিগন্ত। দুঃখ-দ্বন্দ্বে জর্জরিত বাঙালি এখনও তাই রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় খোঁজে। মানবীয় এমন কোনো আবেগ নেই, নেই এমন কোনো অনুভূতি, যা ধরা পড়েনি রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে। প্রবোধচন্দ্র সেনের ভাষায়, 'আমাদের দুঃখে-সুখে-শোকে-আনন্দে-বিপদে-উৎসাহে-সংকটে-শান্তিতে-সংগ্রামে-বিজয়ে সব অবস্থাতেই রবীন্দ্রসংগীত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে সান্ত¦না, প্রেরণা ও উদ্দীপনা জোগায় তার তুলনা আর কোথাও আছে কি না জানি না। ব্যক্তিজীবনে প্রত্যহের প্রতি অবস্থাতেই এই গানগুলির কাছ থেকে আমরা যে পরম, বান্ধবতার অমৃতসঙ্গ লাভ করি, এই বান্ধবতার মূল্যনির্ণয় করা কি সম্ভব?" (রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য, ২০১৫) অথচ এহেন রবীন্দ্রনাথকেও প্রত্যাখ্যানের চেষ্টা করেছেন তাঁর অনেক সতীর্থ ও অনুজ। রবীন্দ্রপ্রতিভার জ্যোতিসীমার বাইরে গিয়ে নতুন পথ সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন অনেকে। এ যেন সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে সূর্যকে অস্বীকার! রবীন্দ্রপ্রয়াণের আশি বছর পরও বাঙালির জীবনে তাঁর সর্বময় প্রভাবই বলে দেয় সে চেষ্টা কতটা হাস্যকর ছিল।

রবীন্দ্রনাথ অতিমানব ছিলেন না, ছিলেন মহামানব। একারণেই জীবননদীর এত তরঙ্গভঙ্গের মধ্যেও অবিচল নিষ্ঠায় ফুটিয়ে গেছেন সৃজনের ফুল। পুত্র রথীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষিল মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।' (আমার পিতা রবীন্দ্রনাথ, অনুবাদ কবির চান্দ)।

রবীন্দ্রনাথ মানেই অন্তহীন ভালোবাসা। সে ভালোবাসা পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য। এ ভালোবাসাই তাঁকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়েছে অবিস্মরণীয় সব গান আর কবিতা। সৃষ্টিকর্তার কাছে এজন্য কৃতজ্ঞতার কমতি ছিল না তাঁর। 'বিধাতা একদিক দিয়ে দিতে আমাকে কার্পণ্য করেননি,' বলেছেন তিনি। 'এত দিয়েছেন- ঢেলে দিয়েছেন আমায়। যাবার সময়ে এই কথাই বলে যাব যে, ভালো বেসেছিলুম পৃথিবীকে, এমন ভালো কেউ কোনোদিন বাসতে পারে না।' (রানী চন্দ্র, আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪২) আদিঅন্তহীন নিঃশর্ত এই ভালোবাসাই রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তির উৎস, তাঁর সাহিত্যবিশ্বের ভরকেন্দ্র।

সহায়ক গ্রন্থাবলী
* আলাপচারি রবীন্দ্রনাথ। রানী চন্দ। বিশ্বভারতী, ১৯৪২।
* রবীন্দ্রনাথ। সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান। ২০১১।
* আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনুবাদ: কবির চান্দ। ২০১৬।
* রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য। উৎপল ঝা। ২০১৫।