অনুদান জটিলতায় ‘পুড়ছে’ বার্ন ইউনিট

বিডিনিউজ২৪
Published : 24 Oct 2011, 04:51 AM
Updated : 24 Oct 2011, 04:51 AM

কামাল হোসেন তালুকদার
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক

ঢাকা, অক্টোবর ২৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- প্রকল্পের অনুদান বন্ধ থাকায় চার মাস ধরে ভুগতে হচ্ছে দেশের একমাত্র বার্ন ইউনিটে রোগীদের। সাধারণ গজ ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে দামি ওষুধ- সবই তাদের কিনতে হচ্ছে নিজেদের পকেটের টাকায়। শুধু তাই নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই ইউনিটের চিকিৎসক ও কর্মচারীরাও গত জুন থেকে বেতন পাচ্ছেন না।

শনি ও রোববার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ৫০ শয্যার এ ইউনিটে তিনশ'র মতো রোগী রয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ কিনতে পারছেন না।

"রোগীরা পোড়া যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এবং স্বজনরা ওষুধ কিনতে কিনতে দিশেহারা। আর কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পোড়া যন্ত্রণার মতো যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করছেন", বললেন প্রকল্প সমন্বকারী সামন্ত লাল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটটি চালু হয় ২০০৩ সালে। বর্তমানে 'বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট' নামে এটি চলছে। প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট হাসপাতালের অংশ হলেও বার্ন ইউনিটটি রয়েছে প্রকল্পের আওতায়।

এ ইউনিটের চতুর্থ তলার অতিরিক্ত-৭ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন কুমিল্লার দাউদকান্দির আমিরাবাদ তিনছিটা গ্রামের গৃহবধূ ডলি আক্তার (৪২)। এক মাস আগে রান্না করার সময় ঝলসে যায় তার সারা শরীর।

ডলি জানান, তার স্বামী প্রতিবন্ধী। ফলে হাসপাতালে তাকে দেখার কেউ নেই। প্রথম দিকে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় দেখাশোনা করলেও এখন আর কেউ আসেন না।

"এখানে কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। বিভিন্ন জনের দান করা টাকায় ওষুধ কিনি", বললেন তিনি।

শুধু ডলি নন, রোগীদের বেশির ভাগই অসচ্ছল। হাফিজা আক্তার (২২) নামে আরেক রোগী জানালেন, চিকিৎসকার যে ওষুধ লিখেদেন, তার সবই কিনতে হয় বাইরে থেকে। এভাবে কতোদিন চিকিৎসা চালানো সম্ভব- তা নিয়ে শঙ্কিত তিনি।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ২৫ নম্বর বিছানায় ভর্তি রয়েছেন কেরানীগঞ্জের শুভাড্যার বাসিন্দা রাজমিস্ত্রী আবদুল খলিল (৫০)। তিনি জানালেন, একমাস হলো ভর্তি হয়েছেন, এরই মধ্যে তার ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।

"একজন রাজমিস্ত্রীর কাছে কতো টাকাইবা থাকে", বললেন খলিল। তার কথা শুনে পাশ থেকে ফরিদ হোসেন (২৪) নামে এক রোগীর মা এলাচি বেগম জানতে চাইলেন, "ভাই, এইটা না সরকারি হাসপাতাল, তাইলে সব ওষুধ কিনতে হয় কেন?"

প্রকল্প সমন্বয়কারী সামন্ত লাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জুনের পর থেকেই এ প্রকল্পে অনুদান বন্ধ রয়েছে। ফলে রোগীদের জন্য ওষুধ কেনা যাচ্ছে না।

আরো 'ভয়ানক' তথ্য দিলেন প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ খন্দকার। বললেন, ইউনিটটি প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে রোগীদের অবস্থা আরো খারাপ হতো।

"আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গজ-ব্যান্ডেজসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ পাই। কিন্তু তা রোগীর প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।"

তবে প্রকল্পের অর্থ পেলে সমস্যা মিটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।

বেতন বন্ধ চার মাস

প্রকল্প নিয়ে জটিলতায় রোগীদের পাশাপাশি পুড়ছেন চিকিৎসক-কর্মচারীরাও। বার্ন ইউনিটের ১০ চিকিৎসকসহ মোট ২৪ জনের বেতন বন্ধ রয়েছে চার মাস ধরে। এ ছাড়া রয়েছেন ৩৭ জন অস্থায়ী কর্মচারী, যাদের বেতনও বন্ধ প্রায় তিন বছর। চাকরি স্থায়ী হবে- এই আশায় বিনা বেতনেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

চিকিৎসক সামিউল আলম সোহান বলেন, "সীমিত বেতনে চাকরি করে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য, আর বেতন না পেলে তো পোড়া যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ মনে হয় জীবন। রোগীর পোড়া যন্ত্রণা দেখা যায়, সহানুভূতি জানানো যায়। কিন্তু আমাদের যন্ত্রণা দেখাও যায় না, সহানুভূতিও পাচ্ছি না।"

তিনি জানান, পঁয়ত্রিশ শতাংশ পোড়া একজন রোগীর প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। অথচ রোগীদের প্রায় সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়।

ক্ষোভ ঝরলো সেবিকা শাহিনুর আক্তারের কণ্ঠেও।

"আমরা বেতন ছাড়া কষ্টদায়ক জীবন কাটাচ্ছি। অথচ আমাদের বড় বড় স্যারেরা ঈদের আগে বিদেশে যায়। আমাদের একটু সমবেদনাও তারা দেখায় না।"

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) মমতাজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে অনেক আগে। এটি সরকারের রাজস্বখাতেও যায়নি। ফলে নতুন করে আবার পাঁচ বছরের প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।"

বিশ্বব্যাংক ও দাতাসংস্থাগুলোর অর্থ না পৌঁছানোর কারণে কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/কেটি/এএল/জেকে/১০৩০ ঘ.