করোনাভাইরাস: আমাদের আশা কতটুকু?

নিশম সরকার
Published : 10 Jan 2012, 12:00 PM
Updated : 1 April 2020, 02:47 PM

কী করলে কী হতো, কী করা উচিৎ ছিল, সে সময়টা খুব সম্ভবত আমরা পার করে চলে এসেছি। ডেংগু নিয়ে আমি যতোটা উচ্চকিত ছিলাম, লেখালেখি, লাইভে আসা, করোনাভাইরাস নিয়ে ততোটাই নিশ্চুপ। এর একটাই কারণ, আমি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে কম জানি। কোনও কিছু সম্পর্কে না জেনে বিস্তর বলতে বা লিখতে গেলে ভুল হয়, সে ভুলের মাশুল দেয়া লাগতে পারে আমার কিংবা অন্য অনেক অনেক মানুষের, এ কারণে এসব ব্যাপারে রিস্ক নেয়া যাবে না, যাওয়া উচিৎ না।

আমি আসলে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম আপনাদের সাথে। আলোচনা ধরনের। ধরে নিতে পারেন, আমরা সবাই তিন ফুট ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তে তিন ফুট দূরে দূরে বসে আছি, আর কেন্দ্রে একটা টং এর দোকান, আমাদের হাতে চা, দুষ্ট লোকেদের হাতে চা এর সাথে টা। এতে গল্পটা জমে ভালো। আমরা যদি একটু খেয়াল করি, দুঃখজনক দেশ ইতালি, আমেরিকা, স্পেন, জার্মানির মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলো প্রথম কেস আইডেন্টিফাই করবার পরে লকডাউন করতে সময় নিয়েছে যথাক্রমে- ৩৩দিন, ৬৫দিন, ৫২ দিন, ৪৯ দিন। অর্থাৎ, এক থেকে দুই মাস পরে। এর ফল হাতেনাতে টের পেয়েছে তারা। এখন আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশ, আমাদের পিপিই নাই, আমরা ইতালি থেকে লোক আসতে দিয়েছি, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারিনি– অনেক অনেক অসামঞ্জস্যতা আমাদের কাজে। একটু পজিটিভ কিছু যদি খুঁজতে যাই, আমাদের প্রথম কেস আইডেন্টিফাইড হয়েছিলো ৮ মার্চে, এবং আমরা 'কার্যত' লকডাউনে গিয়েছি ঠিক তার ১৬দিন পরে। আমরা জানি, এর মধ্যে ফেরি-তে, বাসে, ট্রেনে করে হাজার হাজার, লাখ খানেক মানুষ বাড়ি ফিরেছি, মসজিদে গিয়েছি, ওয়াজে গিয়েছি, পুণ্যস্নানে গিয়েছি। এদেরকে 'ইতরশ্রেণি' বলে আমরা প্রচুর গালমন্দও করেছি। শুধু আমরাই কি এমন? ইতালিতে প্রথম কেস আইডেন্টিফাই হয় ৬ফেব্রুয়ারি। লকডাউন হয় ৩৩দিন পরে- ৯মার্চ, আর ১৮ মার্চ মানে ৯দিন লকডাউনের মধ্যে ৪০ হাজার লোককে লকডাউন না মানবার জন্য জরিমানা করা হয়েছে। তার মানে, আমরা একাই এমন না।

সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশ সরকার এর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা আমরা লক্ষ্য করেছি এবং এর ফলে যে কার্টুন দৌড় আমরা দেখেছি, এর মধ্যেও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা খুব দ্রুত লকডাউন এ যেতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা একটু আশাবাদী হতে পারি যে, লকডাউন প্রোপারলি মেইনটেইন করতে পারলে ইতালি, স্পেনে যে ম্যাসাকার চলছে, আমরা সেটা হয়তো একটু হলেও কাভার দিতে পারবো।

এখন আরেকটা ব্যাপারে আসি। এতোদিনে আমরা জেনে গেছি যে, সংক্রমণের পরে উপসর্গ আসতে ১৪দিন লাগে, তবে সব কিছু অংক মেনে হয় না। প্রতি ১০০জনে ১জন এর ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রকাশ পেতে ১৯-২০দিনও সময় লাগতে পারে।  সে ক্ষেত্রে এই ১ শতাংশ যারা তারা রাস্তাঘাটে বের হয়ে একদম সেই বিখ্যাত পেশেন্ট-৩১ হতে পারেন, হাজার হাজার মানুষকে সংক্রমিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে সেইফ হিসেবে ইনকিউবেশন পিরিয়ড ধরা যেতে পারে ২১দিন।  উপসর্গ প্রকাশ থেকে রোগী ভালোর দিকে যাচ্ছে নাকি মৃত্যুর দিকে সেটির জন্য সময় লাগে আরও প্রায় ১৯ দশমিক ৯ বা ২০ দিন।  অর্থাৎ, এই ১৯+২১ = ৪০দিন যদি লকডাউন করে রাখা যায়, তবে সেটি খুবই কাজে আসবে ধারণা করা যায়, তবে সে ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনীতির কি অবস্থা দাঁড়াবে এখানে সেটি চিন্তার বাইরে রাখা হচ্ছে।

এখন আপনি বলতে পারেন, কোন আশার বাণী কি নেই আপনার কাছে? এক্ষেত্রে আশার বাণী বলতে সংখ্যা দিয়ে আশা দেয়া যায়, মুখে সামান্য হাসি আনানো যায়, তবে প্রতিটা সংখ্যার পেছনে আসলে আমাদের কারো না কারো প্রিয় মুখ লুকিয়ে আছে। ইতালির দিকে যদি আমরা আবার তাকাই, ২০১৮ সালে দেশটির ২২ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মানুষের বয়স ছিল ৬৫ বছর বা তার ওপরে৷ অপরদিকে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৬৫ বা তার চেয়ে বয়স্ক মানুষের হার কেবল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ৷ এটা একটা আশার বাণী হতে পারে।

যুক্তরাজ্য প্রথম কেস যখন আইডেন্টিফাই করে, তখন তারা দিনে পরীক্ষা করতো কয়টি করে জানেন? ৩১টি, পরদিন ৫২টি, তারপরে ৭৩টি, এরপর থেকে কিছুদিন ১৫০ করে। আজকে দুই মাস পরে এসে তারা প্রায় এক লাখ ৩০হাজার জনের পরীক্ষা করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিট সংকট নিয়ে আইইডিসিআরকে গাল-মন্দ করা যায়, আমি নিজেও করি- কারণ ১৪ মার্চ শনিবার আমি গ্লাভস পরে ডিউটি করেছিলাম, ছবি দিয়েছিলাম ফেসবুকে। বুধবার থেকে আমার তুমুল কাশি শুরু হলে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই, হটলাইনে যোগাযোগ করে আইইডিসিআরে গেলেও আমার পরীক্ষা করা হয়নি। আমি ধৈর্য ধরেছি, ওষুধ খেয়েছি, এখন ভালো আছি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নই, কাশির ধরনে। তবুও, আমি নিজ বাসায় একদম সত্যিকারের কোয়ারেন্টিনে থেকেছি, আলাদা খেয়েছি, আব্বা-আম্মার কাছে যাইনি। এখন আরও ল্যাব করা হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা করা শুরু হয়ে যাবে। আমরা প্রথম দিকে লেজে-গোবরে করে ফেলেছি সন্দেহ নেই, কিন্তু এরপরে যে যে স্টেপ নেয়া হয়েছে, আপনি যদি উন্নত বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর সাথে তুলনায় যান, আমরা খুব খারাপ অবস্থানে নেই। এখন প্রথম দিকের লেজে-গোবরের জন্য যে মাশুল আমাদের দেয়া লাগবে, সেটা হলো বড় কথা। সে মাশুল সব দেশকেই দেয়া লাগছে। সব দেশই লেজে-গোবরে করছে, কারণ এটা এই পৃথিবীর কাছে নতুন, কেউই জানে না কি করতে হবে, সবাই 'ট্রায়াল অ্যান্ড এরর' এর মাধ্যমে আগাচ্ছে। যুক্তরাজ্য 'হার্ড ইমিউনিটি'-র পথে এগিয়ে বুঝতে পেরেছে, তারা শুধু লেজে-গোবরেই না, 'লেজে-গোবরে-চনায়-পায়খানায়' সব এক করে ফেলেছে। সে ভুলের মাশুলও এখন তাদের দিতে হচ্ছে।

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বা তার শেষে হয়তো আমরা একটা সার্জ দেখতে পেতে পারি, হুট করে কয়েকজন মারা গেল, এরপরে একটা কন্সট্যান্ট রেট এ মারা যাচ্ছে। নাও হতে পারে, ডিপেন্ড করে কোয়ারেন্টিন কতোটা ভালোভাবে মেইনটেইন হচ্ছে তার উপর। অনুরোধ থাকবে কয়েকটি, একদম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে না থাকলে ঘর থেকে বের হবেন না। আর যে সার্জ এর কথা বললাম, হুট করে মৃত্যু হার বেড়ে যাওয়া দেখে আতংকিত হয়ে 'কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন পথে যাই'- ভেবে কোন ভুল করে বসবেন না, আপনাকে তখনও ধৈর্য ধরে ঘরেই অবস্থান করতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রথম কেস ধরা পরে ২৫ জানুয়ারি। তারা লকডাউনে যায় ৫৪ দিন পরে, অর্থাৎ প্রায় দুই মাস পরে। মার্চের ১৮ থেকে তাদের নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ২০০-৩০০ এর ঘরে উঠা নামা করছিল, এরপরে হঠাৎ করেই ২২ মার্চ একটা 'সার্জ' ঘটে, প্রায় ৬০০ এর কাছাকাছি।

উত্তরণের উপায়, একজন সিভিলিয়ান হিসাবে একটাই, বাড়িতে থাকুন। কারও বাড়িতে যাবেন না, নিজের বাড়িতেও কাউকে ঢুকতে দিবেন না। আমি জানি, সাইকোলজিক্যালি আমরা সবাই অনেক ভেঙ্গে পড়ছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, বেঁচে থাকলে আকাশ ভরা তারা, মাঠ ভরা ফুল, টং এর চায়ের ঘ্রাণে আমরা আবার সবুজ হয়ে উঠবো, সতেজ হয়ে উঠবো, কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

আপনি এখন বলতে পারেন, আপনি না কয়েকদিন আগেও পিপিই নিয়ে সরকারকে কয়েক হাত দেখে নিলেন? আমি এখনও দেখে নিচ্ছি, এবং এই মহামারীর দিনে যারা যারা স্টুপিড কথা বলেছে, আমাদেরকে জনগণের মুখোমুখি করে আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করতে চেয়েছে তাদের সবার কথা আমি মনে রাখবো; যদিও এতে তাদের কিছুই যায় আসে না। পিপিই সংকট আশা করি দ্রুত কেটে যাবে। এখন একটা কথা বলুন, ইতালিতে কি ডাক্তারেরা পিপিই না পরে কাজ করেছে? সেখানে ৬০ জনেরও বেশি ডাক্তার মারা গিয়েছে, স্পেন এর মোট রোগীর ১২ শতাংশই মেডিকেল স্টাফ। পিপিই একটা সাপোর্টিভ গিয়ার, কোন রক্ষাকবচ না।

তবুও কি আপনি আশার বাণী দেখেন ভাই? আমি ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত যুক্তিবাদী একজন মানুষ। তবুও, চারদিন আগে এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই কেনো যেন মনে হলো, এই যাত্রায়ও আমরা হয়তো বেঁচে যাবো অল্পের উপর দিয়ে। কিচ্ছু জানি না কেন এমন মনে হলো। ২৫শে মার্চে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যতো ঋজু, অনুজ্জ্বল লেগেছিল, ৩১ মার্চ প্রতিটি জেলার প্রশাসনের সঙ্গে লাইভ ভিডিও আলোচনায় তাকে ততোটাই কনফিডেন্ট এবং সপ্রতিভ লেগেছে। খুব নিজস্ব একটি সূত্র থেকে জানি, নিজেদেরকে হর্তা-কর্তা ভাবা কিছু লোকদেরকে ওভারলুক করে তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে, মাঠ পর্যায়ে লোক নিয়োগ দিয়েছেন সঠিন ইনফরমেশনের জন্য, এবং এ কারণেই লাইভে সেদিন অনেক পজিটিভ রেসপন্সই আমরা পেয়েছি- পহেলা বৈশাখ পালন থেকে বিরত থাকা, খুব সম্ভবত সাধারণ ছুটি (কার্যত লকডাউন) আরও দীর্ঘ করা ইত্যাদি। এখন বাকিটা আমাদের হাতে। এই দুর্যোগের দিনে সবাইকে ভিন্ন ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সেটা হলো আলাদা আলাদা ভাবে, নিজ নিজ গৃহে।

বাঙালি জাতির পিতার অমোঘ এক বাণী দিয়েই তবে শেষ করি, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো'। এ যুদ্ধেও, জয় আমাদের হবেই, সে স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।