বিশ্বকাপের ঝলমলে উদ্বোধন

বিডিনিউজ২৪
Published : 17 Feb 2011, 03:44 PM
Updated : 17 Feb 2011, 03:44 PM

ঢাকা, ফেব্র"য়ারি ১৭ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম) – ঝলমলে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে শিল্প ব্যাংক ভবনে টানানো বিশাল পর্দায় ভেসে ওঠে বিশ্বকাপের প্রতিকৃতি। ফুটে ওঠে ক্রিকেট খেলার দৃশ্যও। একটি ছক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে বিশ্বকাপের লোগো।

এরপরই শুরু হয় নয়নাভিরাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রথমে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার শিল্পীরা নেচে গেয়ে তাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরেন। সব শেষে মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের শিল্পীরা।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গৌরবময় ঘটনা প্রবাহ ফুটিয়ে তোলা হয় সঙ্গীত, নৃত্য, কোরিওগ্রাফি ও আলোকরশ্মির মাধ্যমে।

শুরুতেই মঞ্চের মাটি ফুঁড়ে 'রাখালের বাঁশির সুরে'র সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপরে উঠে আসেন শিবলী মোহাম্মদ। সুর থেমে যেতেই রাখাইন, সাঁওতাল ও চাকমারা ১ মিনিট ৪০ সেকেন্ড ধরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর পরিবেশন করা হয় মনিপুরি ও কথক নৃত্য।

দ্বিতীয় পর্যায়ে মহান ২১ ফেব্র"য়ারির স্মরণে মাঠের চারিদিক থেকে শুরু হয়ে যায় 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' স্লোগান ও মিছিল। সে সময় গাওয়া হয় 'ওরা…আমার মুখের ভাষা… কাইড়া… নিতে চায়..' গানটি।

সেই সঙ্গে মাঠজুড়ে আলোক-রশ্মির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলা বর্ণমালা। এরপরই দেখা যায় একটি শিশু গাইছে, 'আমার… ভাইয়ের.. রক্তে রাঙানো.. ২১ ফেব্র"য়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি…'।

তৃতীয় পর্যায়ের শুরু হয় একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনের মুহূর্ত দিয়ে। আলো ও গোলাগুলির শব্দ দিয়ে তুলে ধরা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দিনগুলো।

'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে একদল ছেলে-মেয়ের ছুটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় 'জয়… বাংলা… বাংলার.. জয়..' গানটি। এক পর্যায়ে বেজে ওঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, 'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বঙ্গবন্ধু যখন বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন 'জয় বাংলা' তখন স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের শিল্প ব্যাংকের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ৬০ ফুট পর্দায় ফুটে ওঠে তার ৭ মার্চের ভাষণের মুহূর্তটি।

এরপর কবি নজরুল ইসলামের 'কারার ওই… লৌহ কপাট…' গানটি পরিবেশন করা হয়।
এক পর্যায়ে চারদিক থেকে বাংলাদেশের ম্যাপসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশাল চারটি পতাকা নিয়ে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিশাল আকৃতির মঞ্চটি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ও পরে বর্তমানের লাল-সবুজ পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়।

১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের আনন্দের পাশাপাশি দেশের প্রতি ভালবাসা স্পষ্ট করে তুলতে গাওয়া হয় 'ও আমার দেশের মাটি…তোমার পরে ঠেকাই মাথা…'। এ সময় মঞ্চে ফুটে ওঠে শাপলা ফুল।

শেষ পর্যায়ে সুন্দরবনের গহীন অরণ্য ফুটিয়ে তোলার পর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন ও 'থিম' সঙ্গীতের সুরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) পতাকা মেলে ধরা হয়।

এরপর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পর্বের ইতি টানা হয়।

এ সময় ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ২ হাজার ১০০ ছাত্র-ছাত্রী এবং সশস্ত্র বাহিনীর ৩৫০ সদস্য কোরিওগ্রাফিতে অংশ নেন। পুরো কোরিওগ্রাফি পরিচালনা করেন ভারতের কোরিওগ্রাফার সন্তোষ শেঠজি।

এর আগে শ্রীলঙ্কার কোরিওগ্রাফার ও শিল্পীরা আট মিনিটের 'দি পার্ল অব ইন্ডিয়ান ওশান' পর্বের শুরুতেই আলোক-রশ্মি ও শব্দের মাধ্যমে সাগরের ঢেউয়ের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন। সে সময় মাঠ ও আকাশে ছড়িয়ে পড়ে নীল রঙের ছটা। এক পর্যায়ে সুরের তালে তালে মঞ্চে ফুটিয়ে তোলা হয় বিশাল একটি মুক্তা। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন শ্রীলঙ্কার একজন তারকা অভিনেত্রী।

সন্তোষ শেঠজির পরিচালনায় তার দেশের কোরিওগ্রাফার ও শিল্পীরা পরিবেশন করেন 'সিম্ফোনি অব কালারস'।

১২ মিনিটের এ পর্বে ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে আতশবাজি ও আলোক-রশ্মির খেলা দেখান চীনের বিশেষজ্ঞরা।

কানাডার বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ব্রায়ান অ্যাডামস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'এভরিথিং আই ডু…' পরিবেশন করেন। সর্বশেষ অ্যালবাম 'বেয়ার বোনস' থেকেও একটি গান পরিবেশন করেন তিনি।

এরপর থিম সঙ্গীত 'জিতবে এবার…. জিতবে ক্রিকেট' এবং হিন্দীতে 'দে ঘুমাকে… ঘুমাকে' পরিবেশন করেন ভারতের বিখ্যাত শিল্পী শংকর মাহদেবান ও তার দল। পাঞ্জাবী ভাষায় এই গানটিই 'জিতো, খিলাদি…ওয়াহি…' পরিবেশন করা হয় একই সঙ্গে।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা স্টেডিয়ামে প্রবেশের পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় শুরু হয় মূল পর্বের অনুষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী স্টেডিয়ামে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানায় একটি শিশু। এরপর পরিবেশন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

৬টা ২২ মিনিটে সুসজ্জিত ও হাইড্রলিক পদ্ধতির মঞ্চে স্বাগত সঙ্গীত 'ও পৃথিবী এবার এসে.. বাংলাদেশ নাও চিনে, ও পৃথিবী…তোমায় স্বাগত জানাই এই দিনে..' পরিবেশন করেন ইবরার টিপু ও তার দল। সঙ্গে ছিলেন ৪০ জন যন্ত্রশিল্পী।

এরপর বিশ্বকাপের মাসকট স্ট্যাম্পিকে মাঠে আনা হয় একটি রিকশা-ভ্যানে করে। এরপর 'লিড' নামের রিকশায় চড়ে প্রথমেই বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং মাঠে প্রবেশ করেন। এরপর একে একে প্রবেশ করেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ১২টি দেশের অধিনায়ক। সব শেষে প্রবেশ করেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।

মাঠ প্রদক্ষিণ শেষে মঞ্চে ১৪ জন অধিনায়কের পাশাপাশি দাঁড়ানোর পর সনু নিগম ইংরেজি ভাষায় থিম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময় চলছিল আতশবাজির খেলাও।

পৌনে ৭ টায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি আবু হেনা মুস্তফা কামাল স্বাগত বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন উৎসব আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও কো-চেয়ারম্যান ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার।

৭ টায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতি শারদ পাওয়ার।

৭ টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের ঘোষণা দেন। এর আগে তিনি তার বক্তব্যে ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বাংলাদেশের মর্যাদার পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সকলের সহযোগিতা চান তিনি।

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে সবাইকে স্বাগত জানান। বাংলাদেশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং আটটি খেলা আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী আইসিসিকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, "আমরা বিশ্বাস বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব আরো দৃঢ় হবে।"

বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে শুরু হয় ৫০ মিনিটের প্রথম পর্ব। মুনমুন ও নওশীনের উপস্থপনায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন রিঙ্কু, তপু, বিউটি ও মাহদী।

স্টেডিয়ামে ঢুকতে দুপুর ১ টায় লোকজনের লাইনে দাঁড়ানো শুরু হয়। দুপুর ২টায় গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সারি বেঁধে ঢোকা। এক পর্যায়ে লাইন সচিবালয় পর্যন্ত পৌঁছেছিল।

ক্রিকেটপ্রেমীদের কলরবে সকাল থেকেই স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ছিল। বাজছিল ভুভুজেলাও। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন তৎপর।

এই প্রথম এত বড় আয়োজনের সঙ্গী হলো বাংলাদেশ। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও হবে দু'টি খেলা। ভারত ও শ্রীলঙ্কাতেও খেলা হবে বিশ্বকাপের।

খেলা মাঠে গড়াবে ১৯ ফেব্র"য়ারি। রাজধানীর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী খেলায় বাংলাদেশ লড়বে ভারতের সঙ্গে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এআরআর/এসএইচএ/এমআই/টিআর/২০৫৮ ঘ.