হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 7 April 2015, 07:00 AM
Updated : 27 Oct 2012, 01:25 PM

দু'হাজার বারো সালের অক্টোবর মাসের শেষার্ধ। প্রায় এক পক্ষকাল জুড়ে বাংলাদেশ, তথা এ উপমহাদেশ, তথা এ গ্রহের তিন-তিনটি ধর্মের অনুসারীরা তাদের তিনটি প্রধান ধর্মাচার পালন করছেন উৎসবের প্রণোদনায়। ইতোমধ্যেই হিন্দুধর্মের মুখ্য দেবী দুর্গতিনাশিনী মা-দুর্গার পূজা শেষ হয়েছে। তাঁকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর অসুরনাশিনী মাতৃশক্তির উৎস ও বিবর্তনকে গ্রাহ্যতায় এনে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশদভাবে উদযাপিত হয়েছে শারদীয় উৎসব। সবশেষে মা-দুর্গা জগতের সকল মানব-মানবীর সত্য, ন্যায় ও শুভবুদ্ধির বিজয় ঘোষণা করেছেন। আমরা তাকেই বলছি 'শুভ বিজয়া'।

তার পরপরই এসেছে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মোৎসব ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ। এরপর ২৯শে অক্টোবর পালিত হতে যাচ্ছে মহামতি বুদ্ধের সংযম ও সাধনা-উত্তর জ্ঞানলাভের আনন্দোৎসব 'প্রবারণা পূর্ণিমা'। বিরাজমান বৈশ্বিক নৈরাজ্য ও হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে এ তিনটি ধর্মাচারের অন্তর্নিহিত সাযুজ্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, দুর্গা পূজা ও প্রবারণা পূর্ণিমার ধর্মাচার বা রিচ্যুয়াল সম্পর্কে কারও তেমন আপত্তি না থাকলেও ঈদ-উল-আজহায় মুসলমানদের নির্বিচার পশুহত্যা সম্পর্কে অনেকেরই অসন্তুষ্টি আছে। এ পরিপ্রেক্ষিত বিশেষভাবে আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে।


হত্যা তথা প্রাণ-উৎসর্গের আচারটি বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়সহ অনেক প্রাচীন ধর্মেই কম-বেশি প্রচলিত আছে। ইসলামের ইতিহাস বলে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের প্রিয়তম সন্তান হযরত ইসমাইলকে (আ.) আল্লাহর রাহে কোরবানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে তদীয় পুত্রের স্থলে একটি দুম্বা প্রতিস্থাপন করেন।

তারই অনুসরণে মুসলমানরা এ দিনে তাদের সামর্থ্য অনুয়ায়ী উট, দুম্বা, গরু,, মহিষ, ছাগল জাতীয় প্রাণি কোরবানি করে থাকেন। এর মূল উদ্দেশ্য হল, পশু-উৎসর্গের মাধ্যমে তাঁরা তাদের তাবৎ ক-ুপ্রবৃত্তিকে সংহার করে তাঁদের অন্তর্লীন ন্যায়পরায়ণতা ও স্রষ্টা-নিমগ্ন মানবিক শুদ্ধতাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেবেন। অর্থাৎ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একে কেবল 'অনাবশ্যক পশুহত্যা' মনে না করে অসত্যের নিধন ও সত্যের উদ্বোধন মনে করাই যথাযথ।

বাংলার বিদ্রোহী কবি তথা সারা বিশ্বের মানবিক অভেদ-সৌন্দর্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ-কারণেই বলেছেন, 'ওরে, হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ, শক্তির উদ্বোধন'। ফলত শুদ্ধ চিত্তে যিনি কোরবানি দেন তিনি শুধু অনাবশ্যক পশুহত্যা করেন না, বরং তিনি সত্যসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই তিনি তার আরাধ্য ও প্রার্থিত শুভশক্তির উদ্বোধন করেন।

কথা হচ্ছে, শুভ বা সত্য-শক্তির উদ্বোধনের জন্যে হয়তো আরও অনেক সহজ-সরল পথ আছে। তবে হযরত ইব্রাহিমের কাল থেকে তাঁর অনুসারীরা একেও একটি প্রধান পথ বলে মনে করেছেন। কিন্তু এই পথের অন্ধ অনুসরণ করে যারা ইব্রাহিমের চিত্তশক্তির শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা না করে নিজের অমিত বিত্ত, প্রতিপত্তি, সামাজিক প্রাধান্য, নির্বিচার রসনাতৃপ্তি কিংবা এ ধরনের অন্য কোনও জাগতিক প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে কোরবানির নামে বাছবিচারহীন পশুহত্যা করে থাকেন, তারা কোনওমতেই ধর্মাচারী বা শুদ্ধাচারী মানুষ নন। ইসলামের পরিভাষায় তারা মোমিন মুসলমানও নন।

অতএব তাদের এই হত্যা যেমন ইসলাম সমর্থন করে না, তেমনি তা মেনে নিতে পারে না জগতের কোনও নৈয়ায়িক মানব-মানবী। একইভাবে বলা যায়, যারা শুদ্ধচিত্তে কোরবানি করছেন, তাদের কটাক্ষ করার বিষয়টি অবশ্যই অনভিপ্রেত।

পাশাপাশি আরেকটি সহজ সত্যও অস্বীকার করার মতো নয়। আমরা বিস্মৃত হতে পারি না যে, কেবল রসনাপূর্তির নামে অথবা ব্যবসায়িকভাবে বা অন্য কোনও ওজরে প্রতিদিন বিশ্বে অগণিত পশুপাখি আইনি ও বেআইনি পথে নিধন হয়ে চলেছে। প্রতিদিন এভাবে কত নিরীহ পশুপাখি হত্যা হচ্ছে তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য হিসেব আমাদের কাছে নেই। তবে একটি সাধারণ হিসাব করা যেতে পারে। কোরবানির তিনদিন বাদ দিলে (কেননা পরপর তিন দিন কোরবানি দেওয়া যায়) বাকি ৩৬২ দিনে সারা বিশ্বে অন্য অছিলায় যে পশুপাখি হত্যা করা হয়, তা নিশ্চিতভাবেই কোরবানি-কৃত পশুপাখির চেয়ে কয়েক-গুণ বেশি হবে!

আমরা যারা জীবে দয়া করে ঈশ্বরকে সেবা করতে চাই, তাদের প্রথম নৈতিক কর্তব্য হচ্ছে প্রতিদিনের এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধের জন্য সোচ্চার হওয়া। পাশাপশি, এর সপক্ষে বিশ্বব্যাপী সব সম্প্রদায়ের মিলিত ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাই সব ধরনের জীবহত্যা বন্ধের দাবি তোলার আগে কোরবানি তথা যে কোনও ধর্মের ঐতিহ্যবাহী আচারের বিরোধিতা করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না।

কে না জানে, ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ (স.) নিজে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত অন্যকে মিষ্টি খাওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দেননি। তাই আমাদেরও উচিত জীবহত্যা থেকে পুরোপুরি বিরত থেকে বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে নিরামিষভোজী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া। তারপর সব প্রাণিহত্যার বিরোধিতা করা।

তবে প্রশ্ন ওঠে, গাছপালা-লতাগুল্মেরও তো প্রাণ আছে। তাহলে এ ক্ষেত্রে প্রাণির সংজ্ঞা থেকে আমাদের সুবিধার্থে গাছপালা-লতাগুল্ম ইত্যাদি নৈসর্গিক দ্রব্যাদি বাদ রাখতে হবে। সে যা-ই হোক, এভাবে আমরা যদি সব প্রাণির জন্য এ গ্রহকে একটি অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেই, তাহলেই কেবল আমরা শতভাগ বৈধ যুক্তির মাধ্যমে ত্যাগের নিদর্শন হিসেবে কোরবানি উপলক্ষে প্রাণিহত্যার বিরোধিতা করতে পারি। তেমন বিরোধিতা করা হলে বিশ্ব অনিয়ন্ত্রিতভাবে বর্ধনশীল প্রাণিকুল নিয়ে কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, তা বিবেচনা করার বিষয়টিও এড়ানো যাবে না।

অবশ্য এর সঙ্গে সঙ্গে আসে মানবহত্যার বিষয়ও। শক্তিমান সমরাস্ত্রধারীর হাতে বিশ্বের অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর মানুষ যুদ্ধে বা বিনা-যুদ্ধে, ন্যায়-যুদ্ধে বা অন্যায়-যুদ্ধে যে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে, এটিও আমাদের অজানা নয়। এই হত্যা বন্ধ করা বা পৃথিবীকে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক বা তার চেয়েও হিংস্ররতর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর সব সনাতন ও সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ধ্বংস করা একটি বৈশ্বিক দাবি।

সমরাস্ত্রের মালিকরা যদি তাদের সব অস্ত্র কেবল মানবিক শুভবুদ্ধির স্বার্থে জলাঞ্জলি দেন, তাহলে সেটিই হবে মানবতার অস্তিত্বের খাতিরে শ্রেষ্ঠ কোরবানি। এখানে কোনও ধর্মের আচারের প্রয়োজন নেই, আছে বিশ্বমানবতার চিরকালীন দোহাই। এভাবে মানুষ তার ভেতরের সদা-শিঙ-উঁচানো পশুটিকে কোরবানি দিতে পারে। তাহলে আর উট-দুম্বা-ভেড়া-ছাগল-মহিষ-গর" কোরবানির প্রশ্ন উঠবে না। তবে যতক্ষণ তা করা সম্ভব না হবে, ততক্ষণ যে কোনও দোহাই দিয়ে কোরবানির পশুহত্যার বিরোধিতা করাও এক ধরনের 'অনৈতিক স্ট্যান্টবাজি' বলে মনে হবে।


এবার আসা যাক মহামতি বুদ্ধের প্রবর্তিত প্রবারণা পূর্ণিমার প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গটি এ-কারণেই জরুরি যে, বুদ্ধ তাঁর প্রবর্তিত এই কর্মাচারেও একধরনের ত্যাগের শিক্ষা দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে প্রাণিহত্যার কোনও সম্পর্ক নেই। বুদ্ধ যদি সেই প্রাচীনকালেই এর অনুশীলন করতে পারেন, তাহলে আমরা এ যুগের সুশীল মানবতাবাদীরা কেন পারছি না? পারছি না, কেননা আমাদের সব কাজের মধ্যে আত্মকল্যাণই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

প্রবারণা পূর্ণিমা আসলে গৌতম বুদ্ধ ও তার অনুসারী ভিক্ষুদের নিঃসঙ্গ ও ধ্যানমগ্ন বর্ষাবাসের পর এক সর্বজনীন উৎসব। এ ধ্যানে তাঁরা যে জ্ঞান বা বোধি বা আলোক লাভ করেন তা আশ্বিনী পূর্ণিমার অবারিত ধারার মতো সর্বসাধারণের মধ্যে বিতরণের আনন্দ উৎসব। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র এ তিনমাস বর্ষাকাল হওয়ায় ভিক্ষুরা ঘুরে-ঘুরে ধর্মপ্রচার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। এই কর্মকালকেই তারা যৌক্তিকভাবে ধ্যানের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নেন। অহিংসার ব্রত বাস্তবায়নে বনজঙ্গলের কোনও নির্জন স্থানে বা কোনও বিহারে এই মানব-সং¯্রবহীন বর্ষাবাসও আত্মত্যাগের এক অনুপম দৃষ্টান্ত।

আমরা একালের হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিস্টানসহ যে কোনও ধর্মাবলম্বীরা, কিংবা নাস্তিকরাও, এ ধরনের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত খুব কমই স্থাপন করেছি। এর জন্য সাধারণ মানুষকে মহামতি বুদ্ধ বা তার অনুসারী ভিক্ষু হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, সম্প্রদায়-স্বার্থ, ধর্ম-স্বার্থ বা জাতিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সব মানুষের কল্যাণে হিতকরী জ্ঞানসাধনা ও জগতের সব মানুষের মধ্যে তার সুবন্টন। কোনও বিশেষ গোষ্ঠী, দেশ বা মহাদেশ বা ধর্ম-বর্ণের বিশেষ স্বার্থে মানবজ্ঞানের অপব্যবহার করার মানসিকতাকে কোরবানি করতে না পারলে কেবল পশু-কোরবানি থেকে বিরত থাকলেই মানুষ এগোবে না।

উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম বা সাদা-কালো-তামাটে নয়, পৃথিবী হোক মেরুহীন আচারহীন বর্ণহীন মানুষের কর্মমুখর অবারিত আবাসভূমি। তাহলে কোনও প্রাণ আর অন্য প্রাণকে অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না, আমরা যার অন্য নাম দিয়েছি 'হত্যা।' সবার অস্তিত্বের স্বার্থে এক প্রাণ অন্য প্রাণকে ধারণ করবে।

এ ধারণের নাম হত্যা নয়, সুসম্পর্ক; এর নাম সত্যাগ্রহ; এর নাম বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যময় মানবশক্তির শুভ উদ্বোধন। সেই সম্প্রীতিময় মানবসাম্যের জয় হোক।

মুহম্মদ নূরুল হুদা : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।