পথে, প্রদেশে (পর্ব-৬)

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 3 Sept 2015, 07:42 AM
Updated : 3 Sept 2015, 07:42 AM

(পূর্ব-প্রকাশিতের পর)

ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের যৌথবাহিনী

বহুদিন ধরে হকসেদের জ্ঞানকাণ্ডীয় উৎপাতে অতিষ্ঠ ও অপমানিত এলাকার মাতব্বর- ও পণ্ডিতকুল। তারা ঠিক করেছে আজ ঠ্যাক দেবে হকসেদকে। ঠ্যাঙানিও দেবে ভাবমতন। এ কাজে যুব-সিন্ডিকেটের কয়েকজন মাস্তানও জোগাড় করা হয়েছে চুক্তি ভিত্তিতে। সবাই মিলে যুক্তি করে ওঁৎ পেতে বসে আছে হকসেদের প্রস্থানপথের পাশে।
নেতা-গোছের যে, তার নাম ফয়সাল করিম, লোকে ডাকে 'ফয়সালা করুম'। সে একইসঙ্গে হাঁটুভাঙ্গা বহুমুখী ভুবনবিদ্যায়তনের পণ্ডিতসংঘের সভাপতি, আবার নাম্বার-ওয়ান লোকাল মাতবর, আবার তেল ও ভুসিমাল ব্যবসায়ী সমিতির সম্মানী উপদেষ্টাও। খুব রাগ আর খালি প্যাঁচ আর পলিটিকস। চলাফেরা ক্ষমতাকাঠামোর আশেপাশে। এক অসাধারণ গিরগিটি-প্রতিভার অধিকারী, ক্ষমতার রং বদলে গেলে তালে-তালে নিজের রঙও বদলে ফেলতে পারে দ্রুত। সবসময় পাওয়ারের লোকজনদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, আশনাই ও মিথোজীবিতা।

তো, সেই নেতা-ফয়সাল কয়েকজন চ্যালাসহ ঠ্যাক-বাহিনীর অগ্রবর্তী মারমুখী দল হিসাবে ধেয়ে আসে হকসেদের দিকে। অবস্থা বেগতিক আঁচ ক'রে সামনে ওঁৎ-পেতে-থাকা ঠ্যাক-ও-ঠ্যাঙানি-পার্টিতে আগাম ভীতিসঞ্চারের উদ্দেশ্যে হকসেদও তেড়ে যায় কয়েক কদম, বেশ আগ্রাসী ভঙ্গিতে।

হাউৎ করে ওঠে হকসেদ, "এই! ব্যাটা ফাউল ফয়সাল! হটাৎ গর্মা জাগো দিছে দেখতাছি, আয় দেহি ফয়সালা করি তোর।" বলেই থাবড়া দিয়ে ধরে ফেলে ফয়সালের চকরাবকরা গিরগিটি-আঁকা শার্টের কলার। ধরেই ঠাসঠাস করে দেয় কয়েকটা কানসা বরাবর। জোরে জোরে বলতে থাকে,
"পাওয়ারের আশেপাশে মেনি বিলাইয়ের মতন ঘুরঘুর করোস, উটাকাঁটা যা ছিটায় তা-ই খাস আর ভাব দেখাস চরম বুদ্ধিজীবী, না? চুরিদারি টাউটারি ছাইড়া দিয়া অটো-সাইজ হয়া যা কইলাম। নাইলে কিন্তুক খবর আছে, হুঁ! জব্বর খবর!"

এইভাবে নেতা-ফয়সাল ধেয়ে গিয়ে পেয়ে যায় হকসেদীয় ফয়সালা। হকসেদের রাম-ঝাড়ি আর জাম্বো-মার খেয়ে রাগে রীতিমতো কাঁপতে থাকে সে। তোতলাতে তোতলাতে নালিশ দেয় ওঁৎ-পেতে-থাকা পণ্ডিত- ও মাতব্বর-সমাজে,
"দ্যাখেন দ্যাখেন, আমি কিন্তু কি-কি-কি-কিচ্ছু করি নাই, আমি আসতিততিততিতচ্চি আর হা-হা-হারামজাদা হকসেদ হামাক খালি মারতিততিততিতচ্চে… আমি আসতিততিততিতচ্চি আর হকসেদ মারতিততিততিতচ্চে…।"

ঠ্যাক-ও-ঠ্যাঙানি-রেজিমেন্টের মধ্য থেকে কেউ একজন উত্তেজিত হয়ে যেই কিছু একটা বলতে গেছে, অমনি গর্জে ওঠে হকসেদের বিস্ফোরক কণ্ঠ,
"খা-মো-শ!" হাঁক দিয়ে ওঠে হকসেদ, "খবরদার! আর একটা আওয়াজও হবে না কইলাম। কী হবে না?
–আ-ও-য়া-জ।"

তারপর সমবেত ঠ্যাক-পণ্ডিত ও ঠ্যাক-মাতব্বরদের উদ্দেশে বলতে থাকে,
"ভাইসব, আপনারা শান্ত হন। নো উত্তেজনা, একদম চুপ। আর একখান কথা কই আপনাগো, টাল্টিবাল্টি বাদ দিয়া টাইম থাকতে পিওর হন। ধুমায়া আসিচ্চে কিন্তু জনগণ। খালি পাওয়ার-পলিটিক্স কইরেন না, পাবলিকের পাল্সও বোঝার চেষ্টা কইরেন। যহন যেইদিক মধুবৃষ্টি, ছাতি ধরেন খালি হেইদিক, না?"

একটু ঢোক গিলে আবার বলতে থাকে,
"আপনাগো একেকজনের বিশাল বিশাল জ্ঞানকাণ্ড গজাইছে, মাগার কাণ্ডজ্ঞান গজায় নাইক্কা। কইতাছি-কি, খালি পাওয়ারের দিকে ঝুঁইকা থাইকেন না কইলাম, পাবলিকের দিকেও থাইকেন। আপস করতে করতে তো ময়লা পাপোশ হয়া যাইতেছেন-গা, হেই হুঁশ আছে? হুঁশে ফেরত আসেন, ঠিক হয়া যান। নাইলে কিন্তুক হাচাই খবর আছে কইলাম।"

এরই মধ্যে দেখি সফরসঙ্গী আলে-খাটোটা বেশ স্মার্ট হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেবার উদ্দেশ্যে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ঝটপট ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে, "উপস্থিত সুধী ও সুশীলবৃন্দ, দয়া করে শান্ত হন আপনারা। উত্তেজনা ভালো না, আয়ু কমায়, হার্টফেল ঘটায়। আজ আপনাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন বিশ্ববিশ্রুত জাঁহাবাজ পণ্ডিত, জাঁদরেল বক্তা, ওলামাশ্রেষ্ঠ, আপনাদের আমাদের সবার প্রিয় আল্লামা হকসেদ।"

এরকম এক সঙ্কটমুহূর্তেও কৌতুকে কুঁচকে ওঠে হকসেদের বিরলকেশ জোড়াভুরু। বিড়বিড় করে বলে, "আল্লামা!? ওলামাশ্রেষ্ঠ!? হায় হায় এগুলা আবার কোন গজব? কী-কস-না-কস ব্যাটা আলে-খাটো! এ দেহি আস্ত বিখাউজ একখান!"

আলে-খাটোর ঘোষণা চলতেই থাকে, "…আর এটাই হবে আমাদের প্রাণপ্রিয় আল্লামা হকসেদের বিদায়ী ভাষণ, আখেরি ওয়াজ। মনোযোগ দিয়া শুনবেন সবাই, কাজে লাগবে।"

হকসেদ আর তার বাহিনীর অতিশয় স্মার্ট কাণ্ডকারখানা দেখে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা তাকে ঠেক দেবে কি, ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে তুরুপ জব্দ হয়ে বসে থাকে… কেউ-কেউ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা…।

চমক ছাড়তে থাকে হকসেদ একের পর এক। সবাইকে হতচকিত ও খামোশ করে দেবার অভিপ্রায়ে প্রথমেই সে বলে ওঠে,
"ভাই ও বোনেরা আমার, বিসমিল্লাতেই কইয়া নেই, মাই স্পিচ কনটেইনস সাম ফাউল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড র্কোস কনোটেশন্স। লিসনারস ডিসক্রিশন ইজ হাইলি অ্যাডভাইজড।"

তারপর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চালাতে থাকে তার এলোমেলো চাপা ও চোয়াল।

"হোনেন, ফ্রেডরিখ নিৎশে কী কইছিল জানেন? কইছিল, 'গড ইজ ডেড।' আর ওই দুরমুশা দার্শনিকটা মরছিল যেইদিন, হেইদিন গডে কী কয় জানেন নি? কইতে পারবেন কেউ? হাত তোলেন।"

বড়-বড় সব পণ্ডিত ও প্রফেসরদের নিরুত্তর দেখে হকসেদ ঝাড়ি মেরে বলে ওঠে,
"কী লেখাপড়া করছেন আপনেরা? আর পড়ানই-বা কোন ঘোড়ার আণ্ডা! হোনেন, নিৎশে যেদিন মরে, হেইদিন গডে কয়, 'নাউ, নিৎশে ইজ ডেড অ্যান্ড আই অ্যাম স্টিল অ্যালাইভ। অ্যান্ড আই উইল রিমেইন অ্যালাইভ ইন সো মেনি ওয়েজ হিউম্যানস ক্যান নেভার ইম্যাজিন ইভেন।' এক্কেরে নাক্কিন কথা একখান, কী কন আপনেরা? এই যে নাকচুলকানি ফিলোসফির প্রফেসার, কথা কন না ক্যান? আজব!"

দুঃশীল পণ্ডিতের উপর্যুপরি ঝাড়ি খেয়ে কোনো কোনো সুশীল পণ্ডিত কাচুমাচু, কোনো কোনোজন আবার 'জি'-'জি'-মাথাঝাঁকানি…। হকসেদ বলে যায় একনাগাড়ে,
"এই যে দ্যাহেন, এই নয়া জমানায় গড নাইমা আইছে 'ট্যাকা'-র রূপ ধইরা। হোনেন, কলিযুগের অবতার হইছে-গিয়া মুদ্রা-অবতার। মানি ইজ গড, অ্যান্ড ইন গড উই ট্রাস্ট। তাইলে বোঝেন! আবার ওইদিকে দ্যাহেন, বাঘা-বাঘা সব কমুনিস্টরা গড-ফড ধর্ম-টর্ম কাঁহা কুচ্ছু মানে না, কিন্তুক মার্ক্সিজমকে ঠিকই রিলিজিয়াসলি মানে, বিশেষ কইরা স্ট্যালিনের কিত্তি-কারবারগুলা দ্যাহেন। হেই জন্যেই তো কই, ক্যাপিটালিজমও ধর্ম, কম্যুনিজমও ধর্ম, নাৎসিবাদও ধর্ম, নাস্তিক্যও ধর্ম, আবার ধর্মও ধর্ম… এই তো? সবতেই হইল-গিয়া ধর্মেরই নিত্তিনোতুন লীলা… আর ধর্ম টানলে তো গড আসেই অটোমেটিক্যালি। ঠিক কিনা? তাইলে, 'গড ইজ ডেড' এই কথা কয় ক্যামনে?"

এরপর আরো বেশ কিছু বিষয়ে জ্ঞান ঝাড়তে থাকে হকসেদ। সেগুলির দু-একটি প্রাসঙ্গিক, বেশিরভাগই অপ্রাসঙ্গিক, অসংলগ্ন। মাঝে-মাঝে দুম করে ধরে বসে কঠিন-কঠিন সব ধাঁধা। যেমন,
"কন তো দেহি, 'হটেনটটেন টেনটেন টেনটুসটেলিং' কথাটার মানে কী?",
"সব মাছ যায় উজান দিকে, কোন মাছ ভাটির দিকে?", কিংবা,
"'আমি মিথ্যা বলিতেছি' এই বাক্যটা যদি সত্য হয়, তাইলে আমি কি সত্য বলতেছি, নাকি মিথ্যা?" বা
"পিটারের বয়স ১৯৮৫-তে আছিল ২৫ বছর আর ১৯৯০-এ ২০। কন দেহি, পিটারের জন্ম কত সালে?"
ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমন সময় হকসেদের নজর গিয়ে পড়ে এক কাহিল যুবকের ওপর। সুবল লাল বসু। নবীন প্রভাষক। শান্তশিষ্ট, ভদ্র। তবে মাথা ন্যাড়া-করা, গলায় পৈতা, পরনে একপ্রস্থ সেলাইবিহীন শ্বেতবস্ত্র। কয়েকদিন আগে বাবা মারা গেছে বেচারার। অশৌচ শেষ হয়নি, এই অবস্থাতেই বাধ্য হয়ে তাকে যোগ দিতে হয়েছে ঠ্যাক-ঠ্যাঙানি-বাহিনীতে। বেচারা!

তাকে দেখেই কৌতুকের সুরে বলে ওঠে হকসেদ,
"কি রে সুবল, মুণ্ডিতমুণ্ডু… দোস্তো, নতুন-নতুন বাপ মরল, খাওয়ালু না তো কিছু। খাওয়াবু লয়?" তারপর বলে, "হোন, মনোযোগ দিয়া অশৌচ পালন করবু, পিতৃতর্পণ করবু, শ্রাদ্ধ করবু, আমাগো খাওয়াবু দাওয়াবু…তা লয়, আইসা যোগ দিছোস অগো ওই ঠ্যাংঠ্যাঙানি পাট্টিত, হামাক ঠ্যাঙ্গাইবার লাইগা, না? দোস্তো সুবল, তোর কথা আর কী কমু! তোর নাম ধইরা সোজা রাখলেও তুই যে সুবল লাল বসু, উল্টাইলেও হেই সুবল লাল বসু, যে-কে-সেই। আর তোর দুলাভাই রমাকান্ত কামার, হেইটাও তা-ই… হি হি হি…।"

উপস্থিত সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। দেখাদেখি সুবলও হেসে ওঠে শুকনামুখে, এত কষ্ট ও শোকের মধ্যেও।

আরো কিছুক্ষণ লাগামছাড়া মুখ বাজানোর পর একপর্যায়ে বলে ওঠে হকসেদ,
"ওই, ওই দ্যাহেন, দ্যাহেন, পিছন ফির্যান চান, পাওয়ার বেশি হইলে মানষে কী করে দ্যাহেন? কী করে জানেন নি?"

সবাই পিছন ফিরে তাকায়, কিন্তু জবাব আর কেউ দিতে পারে না হকসেদের প্রশ্নের। সবাইকে নিরুত্তর দেখে হকসেদ আবার গজগজ করতে থাকে,
"এই যে দ্যাহো এহন আর কেউ জবাব দিবার পারে না, সব চুপ মাইরা রইছে। আপনেরা সব প্রফেসর, নাকি প্রসেসর? মাতব্বর, নাকি প্রসেসার্ভার? ধ্যাৎতেরি, এইটা হইল কিছু! হোনেন, বেশি হইলে পাওয়ার/ বানায় উঁচা টাওয়ার//। কে কত উঁচা বানাইতে পারে তার পাল্লা লাইগা যায়। টাওয়ারগুলা দেখবেন খুব টানটান, খাড়া। ফ্যালাসের লাহান। আবার দেখবেন, টাওয়ারের আগার দিকে আস্তে-আস্তে ক্যাংকা-জানি চোকখা হয়া গ্যাছে।"

এরপর জিজ্ঞেস করে, "টাওয়ারগুলা ক্যান বানায় জানেন?"

সবাই চুপচাপ পূর্বাপর। হকসেদ নিজেই উত্তর করে, বলে,
"উঁচা-উঁচা সব টাওয়ার বানায় অন্যরে ডর দেহাইবার লাইগা। দুনিয়ার পাওয়ারফুল দ্যাশগুলার কিত্তি দ্যাহেন… কেউ বানায় টুইন টাওয়ার, কেউ বানায় সিএন টাওয়ার, কেউ আবার বুর্জ খলিফা… শা-লা! আমাগো ভয় দ্যাহাইবার লাইগা এইগুলা বানাও, না? খাড়াও দিতাছি… এই কয়া দিছে গুঁড়ামুড়া কইরা ওই খাড়া-করা টুইন ফ্যালাস… যাহ্! খাল্লাস! দিছে এক্কেরে খাল্লাস কইরা…"

"ওই দ্যাহেন দ্যাহেন, স্ট্যাচু দ্যাহেন, জলজ্যান্ত লাফাইন্যা-ঝাঁপাইন্যা স্ট্যাচু। দ্যাহেন খাড়ায়া আছে হিটলার-ইন-স্পেশাল-অ্যাকশন…না না…হিটলার-অন-স্পেশাল-ডিউটি…অন-ইটারনালি-স্পেশাল-ডিউটি… হা হা হা…," মুখবাজানো চলতেই থাকে হকসেদের।

আবার পেছন ফিরে তাকায় সবাই। দ্যাখে, দিনদুপুরে এক আজব কীর্তি। হ্যাট ও হাফপ্যান্ট-পড়া অপরূপ এক জীবন্ত ভাস্কর্য– গর্জনকুর্দনশীল, পেশিবহুল, সদামুখর।

হিটলার-অন-স্পেশাল-ডিউটি… অন-ইটারনালি-স্পেশাল-ডিউটি

ঘুঘুডাঙ্গা পরগনার চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন। যেমন সে উঁচালম্বা, তেমনই তার ফিগার, তেমনই তার গায়ের রং। যেন সাক্ষাৎ কার্তিক, কিংবা মূর্তিমান অ্যাপোলো দেবতা। এমএ পাশ। ডবল এমএ। তার ওপর 'শান্তি ও সংঘর্ষ'-এ এমফিল। আগে ছিল আন্তঃদেশীয় ডাকাতদলের ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার। দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির এক ডাকাত-সর্দার। খুনখারাবিতেও ওস্তাদ। ভয়ে কাঁপত আশেপাশের দশ-বিশ পরগনা। প্রচলিত আছে নানা কিচ্ছা-কিংবদন্তি তার নামে। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করত সে। খুনশিকার মানুষটি লোকমানের সৌন্দর্য আর দেহসৌষ্ঠবে এতটাই সম্মোহিত হয়ে পড়ে যে খুন সম্পাদনাকালে নড়াচড়া দূরে থাকুক, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ডাকাতের দিকে আর এদিকে আরামসে খুনকৃত্য সম্পন্ন করে লোকমান ডাকাত। কোনো মায়ামমতা, ভয়-ডর কিচ্ছু নাই লোকমানের। ভয় শুধু আরশোলা আর মাকড়শায়।

ডাকাতদলে যোগ দেবার ব্যাপারেও আছে এক কাহিনী। রাজধানীতে গিয়েছিল সিনেমার নায়ক হওয়ার জন্য। সিনেমায় চান্স না পেয়ে নানা ঘটনাচক্রে শেষপর্যন্ত সে গিয়ে চান্স পায় আন্তঃদেশীয় ডাকাতদলের নায়কের ভূমিকায়। শিক্ষিত, সৌম্যকান্ত, দুর্ধর্ষ এক ডাকাত। দেশের ভেতর তো বটেই, দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে করতে চলে যেত সীমানা ছাড়িয়ে, দূর-দূরান্তে। কোথায় সেই গুয়াহাটি, ধর্মনগর, আগরতলা, মায়ানমার!

পরে অবশ্য কোনো এক ঘটনায় হোঁচট খেয়ে ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে হজ ওমরাহ সব সেরে-টেরে আত্মনিয়োগ করেছে জনসেবায়। দাঁড়িয়েছে নির্বাচনে, হামানদিস্তা মার্কায়। ভয়ে বসে পড়েছে অন্যসব ক্যান্ডিডেট। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি লোকমানের, অপমানকর ঠেকেছে। তার কথা হলো, চ্যালেঞ্জ নাই তো চার্ম নাই। তাই সেও উঠিয়ে নিয়েছে মনোনয়নপত্র।

যথারীতি পুনর্নিবাচন। এবার লোকমান ছাড়াও আরো জনা তিনেক প্রার্থী। কালাম বিএসসি, জোবদুল হাজি, মোজাহার মণ্ডল। চার প্রার্থীরই প্রচার-প্রচারণা বেশ জোরদার। কারণ কয়েকদিন আগে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদেরকে শাসিয়ে এসেছে লোকমান,
"খবরদার! এইবার কইলাম বইসা যাইয়েন না। এইবার ওয়াকওভার দিলে কিন্তুক খবর আছে। জানেনই তো, চ্যালেঞ্জ ছাড়া লোকমান কোনো খেলা খেলে না।"

আর অন্যদিকে জনগণকে ভয় দেখিয়েছে এই ব'লে, যে,
"হজ করছি দুইবার, ওমরাহ্ চাইরবার। ডবল এমএ পাশ। তার উপর এমফিল। আর আপনাগো জন্যে খাইটা বেড়াই রাতদিন। সবই তো জানেন, সবই দেখতেছেন। তয় হামাক যদি ভোট না দ্যান, তাইলে কী ঘটবো হেই কতা আর নাই-বা কইলাম, আকলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি। অহন বিচার-বিবেচনা আপনাগো।"

ভোটের ফল যখন হলো দেখা গেল সব ভোট একাই পেয়েছে লোকমান। অন্য প্রার্থীরা সব জিরো ভোট। জিরো মানে জিরোই। লোকমান ভাবে– 'তাজ্জব ব্যাপার! আরে! কালাম, জোবদুল, মোজাহার… হেরা কেউই হালার নিজের ভোটটাও নিজেরে দেয় নাই নিকি? ঘটনা কী! হামাক তাইলে পাবলিকে এত্তো ভালবাসে!' ভেদকথা না বুঝেই আত্মতৃপ্তিতে ডগমগ করতে থাকে লোকমান। এবং এভাবেই এককালের দুর্ধর্ষ লোকমান ডাকাত রূপান্তরিত হয় 'লোকপ্রিয়' লোকমান চেয়ারম্যানে।

চেয়ারম্যান হবার পর অবশ্য এলাকায় বেশ কিছু কাজটাজ করেছে সে। গরিব-গুর্বাদের টাকাপয়সা, দান-খয়রাত দিয়ে সাহায্যও করে মাঝেমধ্যে। তবে, পরগনার তাবৎ মানুষকে সে ভাবে তার প্রজাস্য প্রজা। আর তার সন্ত্রাসীবাহিনী গিয়ে কখন যে কাকে ছোবল মারে, কার মাথা ফাটায়, কার লাশ ফেলে দেয় সেই ভয়ে চুপ থাকে পাবলিক। লোকমানের নামে তারা গোপনে চালু করেছে এক জাঁদরেল খেতাব– 'হ্যান্ডসাম হিটলার'।

পরগনা-পর্ষদ অফিসে মানুষের উপচে-পড়া ভিড়। দানখয়রাত করছে লোকপ্রিয় লোকমান চেয়ারম্যান। খয়রাত পাবার যোগ্য পরিবারগুলিকে টোকেন দেওয়া হয়েছে আগে থেকে। পরিবারপ্রতি ধার্য করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ কেজি ইরির চাল ও এক কেজি খেসারির ডাল। অফিসের মাঠে সারি সারি বস্তার মধ্যে রাখা হয়েছে চাল ও ডাল। বস্তার মুখ খোলা। মাঝে মাঝে দাঁড়ানো দাঁড়িপাল্লা, বাটখারাসহ।

মাঠে ঢোকার গেটটার কাছেই ঢাউস এক রঙিন ছাতা খাটিয়ে তার নিচে চেয়ার-টেবিল ও খাতাপত্র নিয়ে বসেছে চেয়ারম্যান। চেয়ারে বসে আছেন চেয়ারম্যান। মাথায় কাউবয় হ্যাট, পরনে চক্রবক্র শার্ট ও থ্রি-কোয়াটার্স প্যান্ট, পায়ে বুটজুতা আর হাতে মেহগনি কাঠের রুলার। সঙ্গে রাখেনি কাউকে, নিজেই তদারকি করছে একা বসে। পরগনার নানা প্রান্ত থেকে খয়রাতপ্রার্থীরা আসছে দলে দলে। চেয়ারম্যানকে টোকেন দেখিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে মাঠে ঢুকে পড়ছে লাইন ধরে একে একে। বরাদ্দ-পাওয়া চাল-ডাল নিজে-নিজে মেপে নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে যার-যার মতো। সেল্ফ-সার্ভিস সিস্টেম।

এমন সময় মোবাইলে কী একটা খবর আসে। মাটিতে গোঁজা তার সেই চন্দনকাঠের বিখ্যাত সুরভিত ত্রিভঙ্গ-আকৃতি লাঠিটার মাথায় হ্যাটটা রেখে, বিতরণকাজ অরক্ষিত ফেলে রেখে উঠে চলে যায় চেয়ারম্যান। গিয়ে ওঠে তার পাজেরো জিপে। কোন গ্রামে কী যেন এক গণ্ডগোল বেঁধেছে। নিজেই জিপ চালিয়ে চলে যায় চেয়ারম্যান সেই গ্রামের দিকে।

চেয়ারম্যান নাই, অন্য কোনো লোকও নাই, সিসি ক্যামেরা নাই, এমনকি চেয়ারম্যানের সেই মেহগনি রুলারটাও নাই। পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে-থাকা কাঙাল খয়রাতপ্রার্থীদের ওপর নজরদারির ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকুও রাখা হয়নি। অথচ অবাক, ঠিক আগের মতোই তারা সুশৃঙ্খলভাবে চেয়ারম্যানের বদলে তার কাউবয়-হ্যাটটাকেই টোকেন দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছে মাঠের মধ্যে। বরাদ্দপ্রাপ্ত চাল-ডাল মেপে নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে যার-যার মতো সেল্ফ-সার্ভিস সিস্টেমে আগের মতোই। কোনো গোলমাল নাই, হাউকাউ নাই, মাপজোকে ভুল নাই, একদম পারফেক্ট। দিনশেষে দেখা গেল-যার যতটুকু প্রাপ্য, ততটুকুই পেয়েছে, কম পড়েনি একটুও।

স্বয়ংক্রিয় অথচ নিখুঁত এক ব্যবস্থাপনা। এর আগেও এরকম হয়েছে বেশ কয়েকবার। এই প্রায়-অলৌকিক ব্যবস্থাপনা-প্রক্রিয়াটি পরবর্তীকালে ব্যবস্থাপনাবিদ্যায় সংযোজিত হয় এক অভিনব ফেনোমেনন হিসাবে। ব্যবস্থাপনাবিজ্ঞানে এর নাম দেওয়া হয়েছে 'কাউবয়-হ্যাট ম্যানেজমেন্ট', বা ভাষ্যান্তরে 'ইনভিজিবল লোকমানিক ম্যানেজমেন্ট'। পড়ানো হয় বিশ্বের বড়-বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, উচ্চতর পর্যায়ে।

নির্মাণকাজ চলছে লোকমান চেয়ারম্যানের কোল্ড স্টোরেজের, বিশাল জায়গাজুড়ে। মোট জমির এক-তৃতীয়াংশ নিজের, বাকি জমির কিছুটা অন্যের জায়গা অবৈধ দখল করে-নেওয়া, আর করতোয়ার বেশ কিছু অংশ ভরাট করে নিয়ে বানিয়েছে মোট ১২ একর জায়গা। জমির মালিকানা নিয়ে মামলা হয়েছে গঞ্জের দেওয়ানি আদালতে। যার জমি বেদখল হয়েছে, সে মামলা করেনি, করেছে "নদী বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও" আন্দোলনের নেতারা।

আদালত থেকে 'স্ট্যাটাস কো' জারি করা হয়েছে নির্মাণকাজের ওপর। কাজের হালনাগাদ অবস্থা সরেজমিনে রেকর্ড করার জন্য সাইটে লোক এসেছে আদালত থেকে। মৌজার নামধাম, জমির দৈর্ঘ্য প্রস্থ চৌহদ্দি, কাজের বর্তমান স্ট্যাটাস… সবকিছু টুকে নিচ্ছে তারা। "কাজের স্ট্যাটাস" এর জায়গায় লিখেছে "আন্ডার কনস্ট্রাকশন"; আরো দু-এক লাইন লিখতে চেয়েছিল কিন্তু লিখতে দেয়নি লোকমান। বলে, "আরে ভাইসাব, বাহুল্য কথা লেইখা কী লাভ! আর দ্যাখেন-না লেখারই তো জায়গা নাই ফরমে। আপনারা আমার মেহমান মানুষ। আসেন, বসেন, চা-নাস্তা খান। অধম লোকমানের পরগনা থেকে তো কেউ কোনোদিন শুকনামুখে ফেরত যায় নাই।"

কাজ সেরে চলে গেল আদালতের লোকজন। এদিকে নির্মাণকাজ চলতে থাকল পুরাদমে। আগের মামলা তো আছেই, এইবার যোগ হলো আদালত অবমাননার মামলা। সপ্তাহ তিনেক পর আবার লোক এল আদালত থেকে। এসে দ্যাখে জোর কদমে এগিয়ে চলছে কনস্ট্রাকশন। আবার চলল সরেজমিনে জরিপ ও তথ্য-উপাত্ত রেকর্ডের কাজ। আগের তথ্য আর এবারকার তথ্য হবহু এক, কেবল তারিখটা ভিন্ন। এবারেও "কাজের স্ট্যাটাস" এর জায়গায় "আন্ডার কনস্ট্রাকশন"।

দুপক্ষেরই দস্তখত হলো রেকর্ড রেজিস্টারে। লোকমান চেয়ারম্যান এবার আদালতের লোকজনদের উদ্দেশে বলে উঠল,
"দ্যাখেন ভাইসাবেরা, আমি একজন নির্বাচিত জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। নিরঙ্কুশভাবে জনপ্রিয়, অবিসংবাদিত এক জননেতা। আমি কি আর আদালতের আদেশ অমান্য করতে পারি, বলেন? "স্ট্যাটাস কো" মানে কী? মানে, স্থিতাবস্থা। মানে, কাজের স্ট্যাটাস যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই থাকবে। তো, ঠিকই তো আছে। কাজের স্ট্যাটাস আগেও ছিল "আন্ডার কনস্ট্রাকশন", এখনও "আন্ডার কনস্ট্রাকশন"। আপনারাই বলেন, ঠিক কিনা? এখন, আমার বিরুদ্ধে সমন জারি করার আগে বিজ্ঞ আদালতকে ব্যাপারটা বুঝাইবেন কাইন্ডলি। আর এই যে নেন, আমার ব্যারিস্টারকে পাঠাইলাম, আপনাদের সাথে। তুখ্খাড় তরুণ ব্যারিস্টার।"

পরে অবশ্য কী হয়েছিল জানা যায়নি। তবে নির্মাণকাজ তো দেখি চলছেই।

দুই হারু-পার্টি, কালাম বিএসসি আর মোজাহার মণ্ডল, একদিন এক হালকা সোনা-ঝরা বিকালে চলে আসে লোকমান চেয়ারম্যানের বাড়িতে। চেয়ারম্যানগিরির বছরপূর্তি উপলক্ষে। হাতে তাদের ফুলের তোড়া আর ঢাউস একটা বই। বিশ্ববিখ্যাত সব ভাস্কর্যের রঙিন ছবিসম্বলিত বই।

অভিনন্দন-জ্ঞাপন, চা-নাস্তা ও আলাপপর্বের এক পর্যায়ে কালাম বিএসসি বইটা খুলে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর বেশ কিছু ভাস্কর্যের ছবি দেখায় লোকমান চেয়ারম্যানকে। বলে,
"দ্যাখেন দ্যাখেন, কী হ্যান্ডসাম! আর ফিগারখান দেখছেন নি? মাথা ঘুরায়া পইড়া যাওয়ার মতন। আপনেক দেখতে ঠিক এই দেবতার মতন লাগে। খালি আমি না, হগলেই কয়। তাই কই কি, আপনের একখান স্ট্যাচু বানান। জনগণের উদ্দেশে আপনে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেছেন– এইর'ম একটা পোজ হবে স্ট্যাচুটার।"

কালামদের কথাটা বেশ মনে ধরে চেয়ারম্যানের। মনে মনে ভাবে– তাই তো! হামি হইলাম এই বিশাল পরগনার একচ্ছত্র অধিপতি, আর দেখতে হামি দেবতার মতন, বহুৎ লোক হামাক দেবতা মানেও। হামার একখান স্ট্যাচু থাকবো না এইডা কোনো কথা হইল?

তো, আজকে সেই স্ট্যাচুর মডেল হয়েছে লোকমান চেয়ারম্যান। স্ট্যাচুর জন্য শানবাঁধানো বেদি বানিয়ে রাখা হয়েছিল আগে থেকেই। পেশি-ফুটে-ওঠা জাঁহাবাজ ফিগারের চেয়ারম্যান উদলা গায়ে তার সেই বিখ্যাত কাউবয়-হ্যাট, থ্রি-কোয়ার্টারস আর গামবুট পড়ে বক্তৃতারত ভঙ্গিমায় পোজ দিয়ে চলেছে, অনেকক্ষণ ধরে। পেছনে তার সিংহচিহ্নিত কুরশিখানা। চেয়ারম্যানের বিচিত্র পোজ আর প্রোফাইলের ছবি এঁকে নিচ্ছে ভাস্কর্যশিল্পী। পরে সেগুলি বিশ্লেষণ করে ভাস্কর্যের ডিজাইন চূড়ান্ত করবে সে।

কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না লোকমানের। রাগে টং হয়ে আছে। এক পর্যায়ে হেঁকে ওঠে,
"কি ভাস্কর সাহেব, স্ট্যাচু বানান বাদ দিয়া কী বালের ছবি-উবি আঁকতেছেন, গুল্লি মারি আপনের আঁকাআঁকির। পিএ-রে কইলাম ভাল দেইখা একজন ভাস্কর ভাড়া কইরা আন, যত ট্যাকা লাগে দিমু, হে যায়া নিয়া আইছে এক বাবরি-আলা মাইয়ালি আর্টিস! এইটা ভাস্কর, নাকি ভচকর? নাকি পায়জামা? সোন্দর গাধা জানি কোনহানকার, মিনমিন কইরা কী-সব-কয়-না-কয়, 'ডাইনে ঘোরেন, বাঁয়ে ঘোরেন, মাথা তোলেন, মাথা নামান, ব্যাঁকা হন…' হেই মিয়া আপনে কি আর্টিস নি? আর্টিসের কাম আপনে করেন ক্যা? আপনের কাম আপনে করেন। আপনে বানাইবেন স্ট্যাচু, তাইলেই হইচে!"

চেয়ারম্যানের কথায় আহত হয় ভাস্কর। রাগ চেপে রেখে বলে, "জি, কী বললেন স্যার? আমার কাজ আমি করব? ঠিক আছে, তাই করি। স্যার, আপনে একটু জিরান, কোক খান, আমি আসতেছি কিছুক্ষণ পর।" মনে মনে বলতে থাকে, 'বুঝছি… যে-দেবতা যে-ফুলে তুষ্ট…।'

চলে যায় ভাস্কর। মিনিট দশেক পর ফিরে আসে গাট্টাগোট্টা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। সবাই মিলে ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে পানিতে গোলানো কুইক-সিমেন্টভর্তি বড় বড় দুটি প্লাস্টিক ট্রে। প্ল্যান করা ছিল আগে থেকেই, সুযোগ পেলেই হাজির করবে।

ভাস্কর বলে, "স্যার, আনছি।" "কী আনছেন?" জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যান। "স্ট্যাচু বানানোর তেলেসমাতি মালমশলা।"
"তাই নাকি, শাবাশ! বহুৎ আচ্ছা! আনেন আনেন।"

খুশি-খুশি ভাব চেয়ারম্যানের। বলে, "এইটুক্কা মশলা দিয়া কী হইবো?"

"খালি দ্যাখেন-না স্যার, কী হয়। আরো তো আসতেছে। এগুলা দিয়ে হবে দুইটা সাব-প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মের ওপর সাব-প্ল্যাটফর্ম লাগে না? এগুলা তাই।" এই বলে ভাস্কর ট্রে দুটি সেট করে দেয় চেয়ারম্যানের দুই পায়ের তলায়।

গামবুট-পরা পা দুটি আস্তে আস্তে ঢুকে যেতে থাকে কুইক-সেটিং সিমেন্টের তেলেসমাতি মশলার ভেতর। দুই পা দুই ট্রে-তে, মানে দুই সাব-প্ল্যাটফর্মে। 'গুড বাই' ব'লে বাউ করতে করতে বিদায় হয় ভাস্কর আর তার লোকজন।
চেয়ারম্যান হাত নাচিয়ে পেশি কুঁদিয়ে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে থাকে। আর হতচকিত গ্রামবাসী হা-করে অবলোকন করতে থাকে গর্জনকুর্দনশীল, সদামুখর, পেশিবহুল এক ভাস্কর্যের সাবলীল সৌন্দর্য। কাজটা কি চেয়ারম্যানের জন্য ভালো হলো নাকি খারাপ, বুঝতে পারে না তারা।

পুনশ্চ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সমাচার

এভাবে সবাইকে হাইকোর্ট দেখিয়ে কেটে পড়ে হকসেদ সুরসুর করে। আমরাও তার পেছন পেছন পা চালিয়ে হাঁটতে থাকি। গর্জায়মান ভাস্কর্যের কীর্তিকাণ্ড দেখায় ব্যস্ত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা। শুধু শাজাহান মাতব্বরের বড় ব্যাটা আওরঙ্গ গুণ্ডা তার তিন ভাইকে নিয়ে লাঠি-হাতে তেড়ে আসতে থাকে আমাদের পেছন পেছন।

বিশাল জোতদার এই শাজাহান মাতব্বর। হাবভাব এমন যেন সাক্ষাৎ মোগল সম্রাট শাজাহান। কারুর সঙ্গে গোলমাল হলেই ভয় দেখায় এই ব'লে—
"হামার সাথোত বাজাবাজি কইরতে আইসো না কইলাম। হামার আট ব্যাটা, সাত কামলা, তার উপর আছে পোষ্যপুত্র হোসেন আলি। হুম্। একবার যদি হাঁক দেই, খুঁইজা আর পাওয়া যাইব না তোমগোরে।"

সেই নব্য বাদশাহ শাজাহান তার প্রথম চার ছেলের নাম রেখেছে আওরঙ্গজেব, মুরাদ, সুজা ও দারা। শেষ তিন জনের নাম রেখেছে মোগলবংশের শেষ তিন বংশধরের নামে। মানুষ তো হয়নি একটাও, খালি খায় দায় ঘোরে ফেরে আর গুণ্ডামি-পাণ্ডামি করে বেড়ায়। ভাড়ায়ও যায় ষণ্ডামি করতে।

তো সেই আওরঙ্গজেব এগিয়ে এসে পেছন থেকে যেই লাঠির একটা বাড়ি মেরেছে হকসেদের পিঠে, অমনি ঘুরে উঠে হকসেদ এক ঝটকায় লাঠি কেড়ে নিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে তাকে। পায়ের গিরায় গিরায় চালাতে থাকে লাঠি-থেরাপি। মুরাদ, সুজা ও দারা তেড়ে যাচ্ছিল হকসেদের দিকে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন গিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করছে তাদের। বলছে, "ফাইট হচ্ছে সেয়ানে সেয়ানে। তোমগোরে কী কাম হের মইধ্যে গিয়া ? আওরঙ্গ কি তোমগোরে ডাকছে?"

এদিকে হকসেদ একাই কুপোকাৎ করে ফেলেছে আওরঙ্গজেবকে। একেবারে নাস্তানাবুদ। মাটিয়ে শুয়ে পড়ে "ও বাবাগো, মাগো" বলে চিৎকার করছে আওরঙ্গ। হকসেদ হাঁক দিয়ে ওঠে, "ওই ব্যাটা আওরঙ্গজেব, ওঠ্, মুরাদ থাকে তো সুজা হয়া দাঁড়া।" হকসেদের কাণ্ডকারখানা দেখে ভালোই ভয় পেয়ে যায় মুরাদ, সুজা ও দারা। যে তেজ নিয়ে তারা তেড়ে যাচ্ছিল তা নিস্তেজ এখন। আর এই সুযোগে লাঠি ফেলে দিয়ে হনহন করে এগুতে থাকে হকসেদ সামনের দিকে। আমরাও পেছন পেছন। ওদিকে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়কুল আর তাদের অনুগত ঠ্যাক-ও-ঠ্যাঙানি-বাহিনী ততক্ষণে ছুটে গেছে কথা-বলা জ্যান্ত ভাস্কর্য দেখতে।

(চলবে…)

পর্ব ১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ এর লিংক: