এখনই যে কাজে এগিয়ে আসতে হবে

Published : 12 March 2011, 05:29 PM
Updated : 29 April 2013, 07:39 PM

সাভারের মর্মান্তিক ঘটনার পর উদ্ধারকাজ, আহতদের চিকিৎসা, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, অভিযুক্তদের গ্রেফতার, বিচারপ্রক্রিয়ার আইনি দিক ইত্যাদি চলছে। এর পাশাপাশি আরও কিছু দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। যারা সাভারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছেন– সাধারণ মানুষ- তারা এসব ঘটনার উপর নজর রাখতে পারবেন না। কেননা তারা যথার্থই এখন হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, সাধ্যমতো মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তাদের কাছে আশু কাজগুলোই জরুরি।

কিন্ত এসব বিষয়ে আইনজীবীদের উচিত এগিয়ে আসা এবং অন্যদের, বিশেষত মানবাধিকার সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সেদিকে নজর রাখবে। এরপর সরকার ও সংশ্লিষ্টদের উপর এসব বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে কদিন পর আমরা বুঝতে পারব, দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকদের বিষয়ে এমনসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেগুলো কার্যত তাদের সাহায্য না করারই সামিল। একটি উদাহরণ দিলে আমার বক্তব্য বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মালিকরা এক হাজার লোককে চাকরি দেবে। লক্ষ্যণীয়, কথাটা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী, মালিকরা নন। সংখ্যার দিক থেকে তা মোটেই নিহত বা আহতদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আহতের সংখ্যা যেখানে দুই হাজারের বেশি, সেখানে কারা এ চাকরি পাবেন তা বলা হচ্ছে না। অনুমান করা যায়, নিহতের সংখ্যা পাঁচশ'র বেশি হবে। তাদের পরিবারের কী হবে সেটাও বলা হচ্ছে না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, নিহত শ্রমিকদের এককালীন টাকা দেওয়ার মানে তাদের পরিবারের কোনো দায়িত্ব না নেওয়া।

নিহতদের পরিবারের জন্যও চাকরি বা স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। সে কারণে প্রতিশ্রুত চাকরির সংখ্যা বাড়াতে হবে। আহতদের এসব চাকরিতে নিয়োগ করা হলে তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা রাখাও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দাবি হল, এ ধরনের চুক্তির বাস্তবায়ন মনিটরিং করার জন্য শ্রমিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারক ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হোক।

মালিকরা যদি এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, তবে সে জন্য বিজিএমইএর সঙ্গে আইনানুগ প্রকাশ্য চুক্তি করতে হবে। তারপর সেটির বাস্তবায়নের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ব্যর্থতার জন্য শাস্তির বিধান রাখতে হবে। সমিতি ব্যর্থ হলে সরকারের সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকবে, যেন তারা সেটি বাস্তবায়ন করে। না হলে এগুলো অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতোই আরেকটি প্রতিশ্রুতি মাত্র হবে।

যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার আশু ব্যবস্থায় অনেকে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আহতদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন হবে অনেকদিন। যারা আহত হয়েছেন তাদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা করার জন্য সরকারকে দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেটা করা দরকার চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়েই। একটা তহবিলও এ জন্য তৈরি করা দরকার।

তবে মালিকদের সংগঠনেরই উচিত এ তহবিল গঠন করা (এবং যারা অপরাধী তাদের সম্পত্তি যদি বাজেয়াফত করা হয়ে থাকে); তাতে সাধারণ মানুষ চাইলে অর্থ দিতে পারবেন। এ জন্যও একটা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে এক ধরনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, সরকার বা সমিতির নেতৃত্ব বদলে যাওয়ার ফলে এ দায়িত্বে যেন ভাটা না পড়ে।

গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় হাসপাতাল তৈরি করার জন্য আগেও দাবি করা হয়েছে। কিন্ত তাতে সরকার ও মালিকপক্ষ কর্ণপাত করেননি। এখন আশা করি তাদের কানে কথাগুলো যাবে। তবে অভিজ্ঞতা বলে এটির সম্ভাবনাও কম। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে সরকার উদযোগ নিয়ে সে আলোচনা খুব শিগগির শুরু করতে পারেন। কিন্তু রাতারাতি হাসপাতাল তৈরি হবে না। ফলে আহতদের চিকিৎসার জন্য সরকার ও গার্মেন্টস মালিক সমিতি সাভার, ঢাকা ও দেশের অন্যত্র কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে সাভারের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে।

রানা প্লাজায় অনেকের ব্যবসা ছিল, বিশেষত ছোট ছোট দোকান মালিক ছিলেন ওখানে। তারা কিন্তু এখন পথে বসতে চলেছেন। তাদের ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সে জন্য সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে দাবি তোলা দরকার। কোনো অবস্থাতেই তাদের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাদের সাহায্যেও এগিয়ে আসতে হবে। সৌভাগ্যবশত হোক কী সাবধানতার জন্য হোক- তাদের জীবনরক্ষা হয়েছে; সামনে তাদের কঠোর সংগ্রামের দিন। তাদের ব্যাপারে কী করণীয় সে সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। তবে তাদের সঙ্গে নিয়েই উপায়গুলো ভাবতে হবে।

যারা আহত ও নিহতদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, গত কয়েকদিন জীবনবাজি রেখে কাজ করেছেন তাদের কাজ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন এসব বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। আশা করি সরকার এ বিষয়ে সচেতন থাকবেন, এবং আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা ভেবে দেখবেন, কী করে শ্রমিকদের এসব প্রয়োজন পূরণ করা যায়।

সাভারে নিহতদের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। সে ঋণের স্বীকৃতি হিসেবে হলেও আমাদের এখনই এসব কাজে এগিয়ে আসতে হবে।

আলী রীয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।