আসছে দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট

বিডিনিউজ২৪
Published : 6 June 2012, 06:03 AM
Updated : 6 June 2012, 06:03 AM

আবদুর রহিম হারমাছি
প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ঢাকা, ০৫ জুন (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- বিদ্যুৎ, সড়ক যোগাযোগ, বন্দর, ভৌত অবকাঠামো, কৃষি-পল্লী ও মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হচ্ছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় এক লাখ ৩৫ হাজার ৫০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) ৫৫ হাজার কোটি টাকা।

এর বিপরীতে বাজেটে আয়ের (রাজস্ব আদায়) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

সেক্ষেত্রে ঘাটতি থাকছে ৪৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এই ঘাটতি মেটানো হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এবং বিদেশি ঋণ সহায়তা দিয়ে।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বাজেট প্রণয়ন নিয়ে সর্বশেষ গত ১১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। সেখানেই এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।"

সিদ্ধান্তের আলোকেই অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটের রূপরেখা চূড়ান্ত করে বলে জানান তিনি।

অর্থমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো।

গত তিন বারের মতো এবারও প্রধান বিরোধীদল বিএনপির অনুপস্থিতিতেই বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এটি হবে বর্তমান সরকারের চতুর্থ বাজেট।

অবশ্য বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার দলের 'বাজেট ভাবনা' উপস্থাপন করেছেন।

সম্ভাব্য রূপরেখা

এক লাখ ৮৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে নতুন বাজেটে সরকারের আয়ের (রাজস্ব) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অন্তর্ভুক্ত খাত থেকে আসবে বলে ধরা হচ্ছে। আর এনবিঅঅর বহির্ভূত খাত থেকে আরো ২৭ হাজার ৪১১ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ইতোমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে।

বাজেটের এই হিসাবে মোট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ৪৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২০ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে আরো ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান হিসেবে আসবে বলে ধরা হচ্ছে।

চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। অবশ্য পরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা করা হয়।

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অনুদান বাদে এ ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ এবং ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ হিসাবে পাওয়া যাবে বলে আশা করেছিল সরকার।

চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে এডিপির আকার ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বাস্তবায়ন সন্তোষজনক না হওয়ায় পরে এডিপি কাটছাট করে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি, ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৮৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে অর্থবছর শুরু করেছিল সরকার।

৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা

বাজেটে আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা করছে সরকার, চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ৭ শতাংশ ধরা হয়েছিল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অর্থবছরের নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাব ধরে জিডিপির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকও বলেছে, এবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে।
মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে বাঁধার আশা

আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার আশা করা হচ্ছে নতুন বাজেটে। চলতি অর্থবছরেও এই হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিল।

অবশ্য বিবিএসের সর্বশেষ মে মাসের হিসাবে গড় মূল্যস্ফীতি হার রয়েছে ৯ শতাংশের ওপরে।

ভর্তুকি ৩৪ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা

প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ৩৪ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে জ্বালানি তেল খাতে, অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

কৃষি খাতে ভর্তুকি থাকছে ছয় হাজার কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতে (পিডিবি) পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া বিজেএমসি ও অন্যান্য খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব হচ্ছে।

সামাজিক নিরাপত্তায় ২১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা

আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সব মিলিয়ে ২১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব হতে পারে বলে জানা গেছে।

এর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ রাখা হবে ১৭ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। আর সামাজিক ক্ষমতায়ন, ছাত্র বৃত্তি ও ক্ষুদ্র ঋণ খাতে বরাদ্দ থাকতে পারে তিন হাজার ৯০৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

এমপিওর জন্য পাঁচ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিও খাতে নতুন বাজেটে পাঁচ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।

এছাড়া পল্লী উন্নয়ন অবকঠামো প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অতি দরিদ্রদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি খাতে ৪১০ কোটি টাকা, রাস্তাঘাট মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য দুই হাজার ১৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে নতুন বাজেটে।

১০ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ

নতুন বাজেট প্রস্তাবে উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেট মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য, ১২ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।

এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ১১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্য ১১ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করতে পারেন অর্থমন্ত্রী।

এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৮ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১০ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আট হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ছয় হাজার ৩৬১ কোটি টাকা এবং সড়ক বিভাগের জন্য চার হাজার ৮৩১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হবে।

পাওয়ার পয়েন্টে উপস্থাপন

মঙ্গলবার এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, অর্থমন্ত্রী ৭ জুন বিকাল ৩ টায় জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের মহাজোট সরকারের চতুর্থ বাজেট উপস্থাপন করবেন। গত দুই বারের মতো এবারো বাজেট উপস্থাপন করা হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে।

বাজেটের সব তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল ওইদিন অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে www.mof.gov.bd প্রকাশ করা হবে। এছাড়া যে কেউ ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একটি ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ জানাতে পারবেন।

এছাড়া সরকারের ওয়েবসাইট www.bangladesh.gov.bd, www.nbr-bd.org, www.plancomm.gov.bd, www.imed.gov.bd, www.bdpressinform.org, www.pmo.gov.bd এবং দেশের প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইটেও (www.bdnews24.com) বাজেট সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে।
বাজেট উপস্থাপনের পরদিন, অর্থাৎ ৮ জুন শনিবার বিকেল ৪ টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হবে বলে তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফেঅর ডটকম/এআরএইচ/জেকে/১০২৫ ঘ.