‘লালন’ সংস্কৃতি : সাধু! সাধু!!

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 17 Oct 2007, 09:57 PM
Updated : 17 Oct 2007, 09:57 PM

গান-বাজনা করেন , এমন নতুন ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলে যখন জিজ্ঞেস করি, কি ধরনের গান বাজনা করেন, তখন অনেকেই বলেন 'লালন করি', 'ফোক করি', 'ফিউশন করি', 'রক করি' ইত্যাদি। এদের মধ্যে কেউ একক শিল্পী, কেউ ব্যান্ড বা দলীয়।

আমার আগ্রহ কেন তারা 'লালন করে' – এই বিষয়ে।

এখন, রবীন্দ্র সঙ্গীত যিনি গাইতেন সংস্কৃতি চর্চার নিদর্শন হিসেবে, পরাকাষ্ঠা হিসেবে, বা আন্দাজ করা যায় যে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত করতেন যদি-তবেই তাই হয়ত স্বাভাবিক হত, বা পাঁচ বছর আগেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতেন, এখন 'লালন করেন'। মধ্যবিত্ত হোন বা উচ্চবিত্ত হোন, 'লালন করেন'।

এখন বড়লোকে লালন করে, মধ্যবিত্তে লালন করে, গরীবে লালন করে, বুদ্ধিজীবী 'লালন করে', সংস্কৃতিকর্মী 'লালন করে', রাজনীতিবিদ 'লালন করে'। সব কিছুর পাশাপাশি একটু 'লালন' করা। দরকার হলে একটু বেশি করা।

'বিপ্লবী'ও করে। অ-বিপ্লবীও।

এখন 'ক্লোজআপ-ওয়ান'-এ লালন, কর্পোরেট স্পন্সরড মিউজিক ফেস্টিভালে লালন, বাংরেজি উচ্চারনে লালন, ইংরেজি উচ্চারণে লালন, রাবীন্দ্রিক উচ্চারণে লালন, কসরতি ফোক উচ্চারণে লালন। ফিউশনে লালন, ট্র্রাডিশনাল কম্পোজিশনে লালন।
এই লেখকও লালন ফকিরের গান করেন।

বঙ্গ লালনময়।

বঙ্গ কি লালন ভাবের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে?

বঙ্গে ভাবের নদীতে লালন বন্যার পলিতে কি নতুন ফসল ফলতে শুরু করল?

আধুনিক, বেকনিয়, সংকোচনবাদী বিজ্ঞানের বিকাশের কালে, এই ধরুন শ'দুয়েক বছর আগে, লোকে এইভাবে 'বিজ্ঞান' করত। অবশ্য বিজ্ঞান একা একা বা সবার পক্ষে করা একটু কঠিন ছিল বটে। তবে , 'আমি মানি', 'বিজ্ঞান ছাড়া বুঝি না,' বিজ্ঞানসম্মত কি না ব্যাপারটা তাই বল', 'বিজ্ঞান বিশ্বাস করি', এই সব চলত। মানে, লোকে বিজ্ঞান খেত, বিজ্ঞান পরত, বিজ্ঞান মলত্যাগ করত, 'বিজ্ঞান শুনত, দেখত, উপভোগ করত…সব।

দু'শ বছরে এই ধারার বিজ্ঞান কর্পোরেট সায়েন্স-এর গরিমা অর্জন করেছে।…বিজ্ঞানের ভিন্নতর বয়ান ও তরিকা যে সম্ভব- সেই তর্ক তখনও ছিল, মৃদু স্বরে। এখনও আছে।

পাঠক, এখনই সিদ্ধান্ত টানবেন না।

রবীন্দ্র তিরোধান পরবর্তী কালের বাংলা সংস্কৃতি অনেকখানি ঠাকুরময়। কে এমন 'সংস্কৃতিমনা' আছে, যার ঘরে রবীন্দ্রনাথ নাই? এক-আধখানও রবীন্দ্র সঙ্গীত জানে না? রবীন্দ্র নাটক দেখেন নাই? লোকে সব ধরনের প্রেম করত রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। এর মধ্যে দেশপ্রেমও আছে!

কেউ কেউ লালন এবং রবীন্দ্রনাথকে একই সাথে গ্রহণ করছেন, কোন ক্রিটিক্যাল বোঝাপড়া ছাড়াই। বলা হয়, আরে উনারা দুইজনই তো 'মানবতা'র কথা বলছেন! 'মানবতাবাদে'র জাল নেহাত ছোট-খাটো না!

'মানবতাবাদ'-এর খোপে নজরুলকেও ফেলা হয়। জোরেশোরে।

পুঁজিবাদবিরোধী , বিপ্লবী চে'র ছবি/চেহারা এখন দেদারছে ব্যবহার হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির টি-শার্ট থেকে মদের বতল পর্যন্ত – সব কিছুতে। রবীন্দ্রনাথের কথা বলা মুশকিল হতে পারে। কিন্তু লালনের সঙ্গে কি পুঁজিবাদ, নির্বিকার ভোগবাদ – যায়? নজরুলের সঙ্গে? তাহলে, লো, মিডল এবং হাই; সাবঅল্টার্ন, মিডল ক্লাস এবং এলিট/হাই কালচার বা সংস্কৃতিতে, এবং রাজনীতিতে সমধর্মী এবং বিরোধী সাংস্কৃতিক আইকন কিভাবে আত্মীকৃত এবং অ্যাপ্রোপ্রিয়েটেড বা চামে-চিকনে ব্যবহার হয় কীভাবে?

আর্ট কি মাল তবে? জীবন যাপন, লড়াই – এ সবেরই বা অর্থ কী? যদি, ধরেন দুনিয়া ধ্বংসকারী তেল কোম্পানির মালিক বা অস্ত্র কোম্পানির মালিক কিংবা কোন প্রাণ-প্রতিবেশ ধ্বংসকারী কিংবা শ্রমিক হত্যা ও গুমকারী, শিশু ও অপত্যস্নেহের বেসাতিকারী , জনগণের সম্পদলুটকারী কোন কোম্পানির মালিক বা দালাল, বুশ, কিংবা এই রকম কেউ, তার বিনোদন/'আত্মার তৃপ্তি' ঘটে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন – এই রকম বিরোধী চেতনার লোকদের সৃষ্ট 'আর্ট' দিয়ে?

আর্ট সত্য প্রকাশ করে বটে। তবে কে কোন চশমায় তা দেখে বা শোনে বা ভোগ-উপভোগ করে – তা জরুরী প্রশ্ন। আর আর্ট করার সময়ও তো চোখে চশমা থাকে। দেখার ভঙ্গি থাকে। আর্ট তাই রাজনৈতিক। ভোগ এবং উপভোগও।

'সংস্কৃতি'র কতখানি ধান্দা, কৌশল ? কতখানি সত্য যাপন? কতখানি ফ্যাশন, গড্ডালিকা প্রবাহ? এসব মাপার কোন সর্বজনগ্রাহ্য নিখুঁত নিক্তি নাই। তবে , মানুষ তার নিজের ও গোষ্ঠী পরিচয় নির্মাণের জন্য কোন কোন প্রতীক আঁকড়ে ধরবে, তার একটা হিসাব-নিকাশ চলে। এর মধ্যে আবার আছে 'আলাদা', 'বিশেষ' হবার রাজনীতি। এই পীড়ন বা টান বা টেনশন সব সময় কাজ করে সমাজে। 'লালন' কারো সংগ্রামের বা যাপনের ভাষা, কারো ভোগের উপকরণ। পুঁজিবাদে সংস্কৃতি, তা যে রকমই হোক, নরম হোক, গরম হোক, আপোষী হোক, বিরোধী হোক, তাকে পণ্য বানানোই তার টিকে থাকার কৌশল। পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো তার সম্ভাব্য সকল 'ভোক্তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে প্রস্তুত। তেমন কালচারাল প্রোডাক্টকেও, যাকে নিয়ে মুনাফা করা যায়। সেটা যে নামে চলবে বা লোকে খাবে সে নামেই চলুক। এর অন্যথা হলেই ঝামেলা।

তাহলে, লোকজনের রবীন্দ্র বা লালন বোল তোলার মধ্যে কি ভালো কিছু নাই? বুর্জোয়ার, তার এস্টাবলিশমেন্টের আদর্শিক ও শিল্পবোধের দেউলিয়াত্বই তো প্রকাশ পায়, যখন বড়লোকের আদরের বা অনাদরের সন্তানেরা 'লালন' অ্যাপ্রেশিয়েট করে! আর এই নতুন প্রজন্ম যখন গাওয়ার জন্য হলেও লালন নিচ্ছে, তখন, কোন এক সময় তা পালনও তো করতে পারে?

প্রথমত, একজন মধ্যবিত্ত হিসেবে আমি তাদের স্বাগত জানাই। দ্বিতীয়ত, আমি এখানে কে ভালো, কে মন্দ , কে বিপ্লবী কি নয়- এই তর্ক তুলে রেখেই একটা কথা বলতে চাই। যাপনের বাইরে আর্ট-কালচার করা ভাড়ামি। বড়জোর হাত-সাফাই বা সার্কাস হতে পারে। যাপন মানে বিশ্বাসের অনুশীলন। সক্রিয়তা। পর্যালোচনামূলক অনুশীলনের মাধ্যমে পালনীয় বিশ্বাস বা আদর্শের সীমাবদ্ধতাও টের পাওয়া যায়। বিকাশের সম্ভাবনাও তৈরি হয়।

আদর্শের লড়াই তো চলবেই। সেটা, সুন্দর যদি নাও মনে হয়, সত্য অবশ্যই। জীবনের সমান।

ঢাকা, অক্টোবর ২০০৭
aruprahee@gmail.com