শ্রমিকের নিরাপত্তা দেবে কে?

বিনয় দত্ত
Published : 14 May 2017, 07:25 PM
Updated : 14 May 2017, 07:25 PM

দিবস যার জন্যে

সেই শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত,

ছুটি, আনন্দে বর্ণিল।

দিবসের তাৎপর্য পর্যুদস্ত।।

শ্রমে-ঘামে গড়া এই দেশে শ্রমিকই সবচে বেশি অবহেলিত জনগোষ্ঠী। যে শ্রমিকের জন্যে মে দিবসের সূচনা হয়েছিল সেই শ্রমিক, দিবসের মর্ম না বুঝে সরকারি ছুটির দিন হিসেব করে হাসি, আনন্দে দিন পাড় করছে। মালিকরাও শ্রমিককে তার অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করছে না। তাতে সুবিধা মালিকদের। সারা বছর একজন শ্রমিক তার অধিকার, দাবি সম্পর্কে কথা বললেও এই একটি দিন তাকে আরো বেশি করে তার অধিকার, দাবি-দাওয়া সম্পর্কে মালিককে বা প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে যাতে করে একজন শ্রমিক তার ন্যায্য দাবী সুশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যদিয়ে আদায় করতে পারে। অথচ আমরা তা ভুলে বসে আছি। তবে কেন এই দিবস?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে কাজে নিয়োজিত ৫ কোটি ৬৭ লাখ। অর্থাৎ আমাদের এই বিশাল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা অনেক বেশি মাত্রায় উন্নতি করতে পারবো। শুধু দরকার সুশৃঙ্খল নিয়মকানুন।

তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের শ্রম আইন এখনো বৈষম্যমূলক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বৈষম্য নিরসনে শ্রম আইন, ২০০৬ সংশোধন প্রয়োজন, যাতে গৃহকর্মী থেকে শুরু করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা এতে অন্তর্ভুক্ত হন।

শ্রমিকের শ্রম, মেধা, দক্ষতা ও নিষ্ঠায় গড়া এই বাংলাদেশ। যেই শ্রমিক দেশ গড়ার জন্যে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে সেই শ্রমিকেরই কোনো সুনিরাপত্তা নেই। ১৮৮৬ সালের শিকাগোতে যে আট ঘণ্টার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই আট ঘণ্টার বক্তব্য এখন শুধু খাতা-কলমে বা মুখে মুখে। গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই তা মানছে না।

তাছাড়া, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হলেও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি এবং ভবিষ্যতে তা বাস্তবায়ন করা হবে কি না এই নিয়ে জোর সন্দেহ রয়েছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ৪২টি পেশায় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হলেও কোনো খাতেই তা শতভাগ বাস্তবায়িত হয়নি। এখন পর্যন্ত ৫৮টি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণাই করা হয়নি।

এছাড়াও শ্রমিকের অধিকার বা সম্মান নিশ্চিতকরণ, ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়া ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিতো রয়েই গেল।

আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কর্মজীবী নারীর অবদান অপরিসীম। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় কাজ করে যাচ্ছেন এবং আমাদের অর্থনীতিতে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এখনো নারীকে পুরুষের সমকক্ষীয় মনে করছে না। শ্রম আইন, ২০০৬-এ নারী ও পুরুষের সমান মজুরির কথা বলা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন কিছু বলে। এখনও বিভিন্ন পেশায় নারী, পুরুষ সমান সমান কাজ করলেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের কম মজুরি দেয়া হয়। এর চেয়ে ভয়ানক বিষয় হল, নারী শ্রমিক কম মজুরির ব্যাপারে জানতে চাইলে তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করার হুমকি দেয়া হয়। কাজ বাঁচানোর জন্যে বাধ্য হয়ে নারী শ্রমিক বধির হয়ে যান।

তাছাড়া, দেশের বড় নামীদামী কিছু প্রতিষ্ঠান নারী কর্মী নিয়োগ দিতে চাই না কারণ মাতৃত্বকালীন ছুটি সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণে নারীরা ছুটি নেন এতে করে তাদের কাজের ক্ষতি হয়, এই চিন্তা করে। কি রকম বৈষম্যমূলক এই সমাজ!

নারীদের পাশাপাশি এখন শিশুরাও অর্থাভাবে বিভিন্ন বিপদজনক পেশায় কাজ করছে।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) তথ্যমতে, ৪৭ ধরনের 'ঝুঁকিপূর্ণ' এবং ১৩ ধরনের 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' কাজে বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকরা কাজ করে। নির্মাণ, ইটভাটা, সিরামিকস পোশাক খাতে নারী ও শিশুরা কাজ করলেও তাদের ন্যূনতম মজুরি ও কর্মঘণ্টা এখনো পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। তারমধ্যে নিরাপত্তা খাতে নারীদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে ভয়ানক বৈষম্য চালু রয়েছে।

আলোচিত প্রথম খাতঃ অভিবাসন শ্রমিক

বিভিন্ন সময় অভিবাসন শ্রমিকরা বিভিন্ন কারণে আলোচনায় এসেছেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধা, দেশে ফিরে আসা নিয়ে বিপত্তি, বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রার বিষয় তো রয়েছেই। তাদের পাঠানো বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে দেশ চলছে এই বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, এ পর্যন্ত ৯৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গিয়েছেন৷ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই বাংলাদেশকে বিশ্বের দুয়ারে সম্মান এনে দিচ্ছেন। তারা একেক জন একটি বাংলাদেশ। সবচে হতাশাজনক হলেও সত্যি, এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা কারণে-অকারণে অনেক অবহেলার স্বীকার। প্রতিবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে তাদের বিশাল অঙ্কের টাকা লোন করে দেশ ছাড়তে হয়। ঘর-বাড়ি, গয়না, জমি, গরু-ছাগল, দোকান বন্ধক রেখে তারা টাকা ধার করে বিদেশে পা রাখে কারণ, একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল তাদের টাকা হাতিয়ে নেয়। মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের তত্পরতা বন্ধ করতে সরকার ২০১৩ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন করেন। কিন্তু ওই আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রবাসীদের ১০ ধরনের সুবিধার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার অর্ধেক সুবিধাই পাওয়া যায় না। বিদেশে আইনি সহায়তা, লাশ দেশে ফেরত পাঠানো, ক্ষতিপূরণের টাকা আদায়, বিশেষ ঋণ সুবিধার জন্যে প্রবাসীদের বিড়ম্বনা দেখার মতো।

এতো কষ্টের মাঝেও আশার কথা হল, প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েই সরকার নতুন নতুন প্রকল্পের কথা ভাবেন, উন্নয়নের বড় বুলি আওড়ান, দেশকে অগ্রসরতার দিকে ধাবিত করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার।

আলোচিত দ্বিতীয় খাতঃ পোশাক শ্রমিক

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার দ্বিতীয় বৃহৎ (মতান্তরে প্রথম) খাত হল পোশাক শিল্প। দেশে এবং দেশের বাইরে সব জায়গায় বাংলাদেশের পোশাক খাতের বেশ সুনাম রয়েছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য হল তৈরি পোশাক। পোশাক রপ্তানি করে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয় সত্তর দশকে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের প্রথম চালানটি রপ্তানি হয়। এরপরেই বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে। আজ পোশাক রপ্তানির মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

হতাশার বিষয় হল, যে পোশাক শিল্প দেশে এতো বিশাল অঙ্কের অর্থ এনে দিচ্ছে সেই শিল্পের শ্রমিকরাই অনিরাপদ ভাবে কাজ করছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, শ্রমবান্ধব পরিবেশের অভাবে কর্মক্ষেত্রে যেমন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে মজুরি না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা। নারী শ্রমিকদের নিরাপদ আবাসন সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

আলোচিত তৃতীয় খাতঃ পরিবহন শ্রমিক

বছরে বেশিরভাই আলোচনা সমালোচনায় উঠে আসে পরিবহন খাতের নাম। সারা বছরের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার খবরাখবর, বাস ভাড়া বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষ সহ বিভিন্ন কারণে পরিবহন শ্রমিকদের কথা সবচে বেশি আলোচনায় আসে।

সরকারি পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে তালিকাভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছে প্রায় ১৬ লাখ। এই হিসেবে ১১ লাখের বেশি অবৈধ চালক গাড়ি চালাচ্ছেন।

বিপত্তি আসলে এখানে নয়, বিপত্তি হল, পরিবহন খাতের ৮৬ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণা বলছে, যেই চালককে দৈনিক ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করার কথা সেই চালক প্রতিদিন গড়ে ১২-১৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় গাড়ি চালান।

সহজ হিসাব হল, যেই পরিমাণ চালক প্রয়োজন তা তো নেই-ই ফলে একজন চালককে অনেক বেশি সময় গাড়ি চালাতে হয়। এতে করে তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যহানি ঘটছে, অবসাদগ্রস্ততা তৈরি হচ্ছে ফলে চালক অসংলগ্ন হয়ে দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব দেখলেই বোঝা যায়, প্রতিবছর কি পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে আর তাতে কি পরিমাণ পরিবহন শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০১৬ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৩১২টি এতে আহত হন ১০৫৯১৪ জন, নিহত হন ৬০০৭ জন।

শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ যেমন জরুরী, তেমনি জরুরী নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা। তাতে একজন শ্রমিক যেমন সুরক্ষিত থাকবে, সুরক্ষিত থাকবে মালিকের বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭৩৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৩৬১ জন। কর্মস্থলে নিরাপত্তার কারণে এতো শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল, তারপরেও প্রশাসন শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেক উদাসীন, কিন্তু কেন?

পরিশেষে বলা যায়, একজন শ্রমিক আমাদের দেশের সম্পদ। তার শ্রম, মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা আমাদের অর্থনীতিকে যেমন সমৃদ্ধ করছে তেমনি তার প্রাপ্য সম্মান, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, নিরাপদ কর্মস্থল প্রদান, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ ও আবাসন সমস্যা সমাধান করাও প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক নিরাপদ বা নিশ্চিত মানে প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত তথা বাংলাদেশ নিশ্চিত।

একশ একত্রিশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তা যেন যথাযথ পালন করা হয়, আর কোনো শ্রমিককে যেন তার কর্মস্থলে প্রাণ বিসর্জন দিতে না হয়, একজন শ্রমিক যেন সর্বোচ্চ নিরাপদ থাকেন, যেন তার অধিকার আদায়ে অনেক বেশিমাত্রায় সচেষ্ট হন, আগামীদিনের এই চাওয়া।