আমার ‘মা’ রমা চৌধুরী

বিনয় দত্ত
Published : 24 June 2017, 05:41 AM
Updated : 24 June 2017, 05:41 AM

বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যে ক'জন বীরাঙ্গনার সম্ভ্রমহানির ইতিহাস জড়িয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তিনি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে বাংলাদেশটা আমাদের কাছে ভিক্ষে দিয়েছেন। যে জাতীয় পতাকা আজকে আমাদের কাছে, যা নিয়ে আমাদের গর্ব সেই জাতীয় পতাকার মাঝে অন্তর্নিহিত হয়ে আছে তাঁর গল্প।১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার গাঢ় সবুজ এবং মাঝখানে লাল বৃত্তের জাতীয় পতাকার মধ্যে লুকিয়ে রমা চৌধুরী, তারামন বিবি, জয়ন্তী বালা দেবী, আছিয়া বেগম সহ অসংখ্য বীরাঙ্গনাদের গল্প, যাঁরা নিজেদের সবচে পবিত্র সম্পদটুকু দেশের জন্যে উৎসর্গ করেছেন। তেমনি একজন হার না মানা নারীর নাম রমা চৌধুরী।

১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান। মা মোতিময়ী চৌধুরী শত বাধা পেরিয়ে তাঁকে পড়াশোনা জন্যে অনুপ্রেরণা দিয়ে যান। মায়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিনিই প্রথম নারী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

তাঁর জন্ম অন্য সাধারণ নারীদের মতো হতে পারতো, স্বামী সংসার, সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে দিন পাড় করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। মাত্র ২০ বছর বয়সে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ এক যুগের উপরে তিনি বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে তিনি বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বিদুগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেই কর্মরত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ রমা চৌধুরীর সামনে মূর্তিমান আতংক হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে দেশান্তরী হয়ে যান। সাগর আর টগর দুই সন্তানকে নিয়ে রমা চৌধুরী পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায় থাকা শুরু করেন। ১৩মে সকালবেলা, পোপাদিয়ায় স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা রমা চৌধুরীর বাড়িতে আক্রমণ চালায়। এই ক্ষত তিনি এখনো ভুলতে পারেননি। সেদিন পাকিস্তানি এক সৈনিক তাঁর সম্ভ্রম কেড়ে নেন। তাঁর উপর চালান শারীরিক নির্যাতন। ওই বিভীষিকার বর্ণনা রয়েছে তাঁর "একাত্তরের জননী" বইয়ে। সেখানে লিখেছেন, 'যখন আমাকে নির্যাতন করতে উদ্যত হলো পাক সেনা, তখন জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার মা ও দুই ছেলে বারবার আকুতি করছিলেন। ছিল আমার পোষা বিড়াল কনুও। তখন আমি মাকে আমার সন্তানদের নিয়ে সরে যেতে বলেছিলাম।'
সম্ভ্রম হারানোর পর রমা চৌধুরী পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন। হানাদাররা তাঁকে না পেয়ে গানপাউডার দিয়ে ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায় সম্পদ সবকিছুই পুড়িয়ে দেয়। ঘরবাড়ি সহায় সম্বলহীন বাকি আটটি মাস তিনি দুইপুত্র সাগর, টগর আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পাড় করেছেন। পোড়া ভিটায় কোনোরকমভাবে পলিথিন আর খড়কুটো মাথায় আর গায়ে দিয়ে রাত কাটিয়েছেন। এইভাবে বহু কষ্টে যুদ্ধের দিনগুলো পাড় করেন।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে তাঁর ছেলে সাগর ছিল সাড়ে পাঁচ বছরের। দুরন্ত সাগর মিছিলের পেছনে পেছনে 'জয় বাংলা, জয় বাংলা' বলে ছুটে বেড়াত। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একসময় সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যায়। সাগরের মৃত্যুর ১ মাস ২৮ দিনের মাথায় ৩ বছরের ‍টগরও মারা যায়। ছেলেদের হিন্দু সংস্কারে না পুড়িয়ে তিনি মাটি চাপা দেন। দুই সন্তানের দেহ মাটিতে আছে বলে রমা চৌধুরী জুতা পড়া বন্ধ করে দেন। ছেলেদের মৃত্যুর স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে তাঁর কাছে। খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তাঁর পায়ে ঘা হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজনদের জোরাজুরিতে তিনি অনিয়মিতভাবে তখন জুতা পড়া শুরু করেন।

প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটলে রমা চৌধুরী দ্বিতীয় বারের মতো সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। দ্বিতীয় বার সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। টুনুর মৃত্যুর পর রমা চৌধুরী একেবারের মতো জুতা ছেড়ে দেন।

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। সম্মানীর বিনিময়ে তাঁকে পত্রিকার ৫০টি কপি দেয়া হত। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবনজীবিকা। পরে তিনি নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। তাঁর সমস্ত বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকন ছায়াসঙ্গী হিসেবে সবসময়ই তাঁর পাশে থেকেছেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'রবীন্দ্রসাহিত্যে ভৃত্য', 'নজরুল প্রতিভার সন্ধানে', 'স্বর্গে আমি যাব না', 'চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে জীবনদর্শন', 'শহীদের জিজ্ঞাসা', 'নীল বেদনার খাম', 'সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়', 'ভাববৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

রমা চৌধুরী নিজেই নিজের বই ফেরি করে বিক্রি করেন। এ থেকে প্রতি মাসে তাঁর হাজার বিশেক টাকার মতো আয় হয়। এ দিয়েই তিনি থাকা খাওয়ার সংস্থান করেন। একই সঙ্গে পরিচালনা করছেন 'দীপংকর স্মৃতি অনাথালয়' নামে একটি অনাথ আশ্রম। প্রচণ্ড কষ্টের জীবন কাটলেও তাঁর দু'চোখে স্বপ্ন সুখ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে অনাথ আশ্রম খুলতে চান। সকল ধর্মের অনাথরা সেখানে থাকবে। মনুষ্য দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত।

২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে রমা চৌধুরী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেখা করেননি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে রমা চৌধুরী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। খালি পায়ে তার সাথে সাক্ষাতে নিজের কষ্টের কথা জানান। প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহযোগিতা করতে চাইলে রমা চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দেন। সবকিছু হারিয়ে একরকম নিঃস্ব তিনি। জীবনের দীর্ঘ সময় পাড় করে ফেলেছেন এখন এই আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে তিনি কিইবা করবেন তাই কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেননি।

নিজের সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, কিন্তু তাঁর কাছে ওরা শহীদ। একাত্তর রমা চৌধুরীকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা। এই নিয়েই এখন রমা চৌধুরীর দিনযাপন।

তিনি এতোটাই তেজস্বী যে, কারো দান দক্ষিণা গ্রহণ করেন না, নিজের কষ্টের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলেনও না, নিজের জীবনের সর্বস্ব হারিয়েও একা দীপ্তিময় ভূমিকায় হেঁটে চলেছেন, যুদ্ধদিনের বিভিন্ন ঘটনা সহ অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী তিনি, তিনি আমাদের মহান রমা চৌধুরী।

বর্তমানে রমা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অর্থের অভাবে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর এখন দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা দরকার কিন্তু অর্থাভাবে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। রমা চৌধুরী এখনো মরতে চান না। অনেক কিছুই তাঁর লেখার বাকি আছে। এই দেশকে এখনও কিছুই দিতে পারেনি বলে মনে করেন তিনি। দেশকে অনেক কিছু দিতে চান। স্বনির্ভর, স্বাবলম্বী আর আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চান রমা চৌধুরী।

কারো সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ না করলেও আমাদের সকলের উচিত তাঁর পাশে দাঁড়ানো, তাঁর লেখা ১৮টি বইয়ের মধ্যে অন্তত একটি করে বই কেনা, তাঁকে উৎসাহিত করা, তাঁকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনা। রমা চৌধুরীর মতো আত্মপ্রত্যয়ী, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার খুব প্রয়োজন এই সময়ের তরুণদের। সকলের ভালোবাসায় তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, দেশব্যাপী অনাথ আশ্রম গড়বেন এইটা আমাদের সবারই আশা।

বিনয় দত্ত

লেখক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী