জীবন মানে জি বাংলা না

বিধান সাহা
Published : 8 May 2015, 09:23 AM
Updated : 8 May 2015, 09:23 AM

গণমাধ্যম- তথ্য ও বিনোদনের অন্যতম শক্তিশালী একটি উৎস। আর এ উৎসের ভূমিকাটি পালন করতে গিয়ে গণমাধ্যম শুধু তথ্য ও বিনোদন প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, গড়ে তুলছে আমাদের চিন্তার কাঠামো ও মানস জগত। গণমাধ্যমের চরিত্রগুলো হয়ে উঠছে আমাদের রোল মডেল, সেখানে উপস্থাপিত জীবনধারা হয়ে উঠছে কাঙ্খিত জীবনাচরণের নির্দেশিকা। তাই পাখি ড্রেসের জন্য আমাদের মরতে দ্বিধা হয়না; সিদ্ধান্ত নিতে পারি বিবাহ বিচ্ছেদের, কখনো কখনো আত্মহত্যার।

বহুল প্রচলিত সত্য যে বাংলাদেশের টিভি দর্শকরা এদেশের চ্যানেলগুলোতে শুধু ঢুঁ মারে সংবাদের সময়টিতে। এর কারণ মানসম্মত ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের অভাব। আর মানসম্মত ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান না হওয়ার কারণ দক্ষ জনবল ও কলাকুশলীর অভাব। আর অভাবের এ জাল বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে টিভি চ্যানেলের অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। ফলে অপেশাদার ও অদক্ষ জনবল সুযোগ পাচ্ছে সৃজনশীল এই খাতটি পরিচালনার। ফলাফল দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন আমাদের টিভি চ্যালেনগুলো থেকে।

এদিকে বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্যের তৃষ্ণা মেটাতে ডিসকোভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বিবিসি, সিএনএন থাকলেও বিনোদনের জন্য হাতের রিমোটটি সহজেই খুঁজে নিচ্ছে স্টার প্লাস, ওয়ান, কালার, জি বাংলা বা স্টার জলসার পর্দা। আর সেখানেই বাধে বিপত্তি, বিনোদনের মান আবারো দাঁড়ায় প্রশ্নের কাঠগড়ায়। দামী সেট ও আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে আকৃষ্ট হয়ে দর্শক যা দেখছে তা কতটা পরিচ্ছন্ন?

এসব চ্যানেলের পিক আওয়ারে চলছে হিন্দি ও বাংলা টিভি সিরিয়াল যার কাহিনীগুলো মূলত পারিবারিক কলহ ও অশান্তি, ষড়যন্ত্র, হীনতা, অসুস্থ সম্পর্ক, সম্পর্কের ধোকাবাজি, যৌনতার সুড়সুড়ি, ধ্বংসাত্মক রাগ, প্রবল লোভ, ঈর্ষা, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতায় আবর্তিত।

আবার সেই গোড়ার কথায় ফিরে আসি। গণমাধ্যমের চরিত্রগুলো হয়ে উঠে আমাদের রোল মডেল, আর সেখানকার জীবনধারা হয়ে উঠে প্রমিত জীবনাচারণের নির্দেশিকা। সুস্থ বিনোদন মানেই যে সেখানে কোন শিক্ষা থাকতে হবে তা নয়, কিন্তু গণমাধ্যম যখন বিনোদনের মাধ্যমে আমাদের মানস জগতে বপন করছে মানবিক সত্তার কুৎসিক দিকগুলো তখন ভাবনার বিষয় বৈকি। আমরা ভুলে যাই জীবন মানে জি বাংলা নয়; জীবন মানে জীবনানন্দ, জীবন মানে জয়নুল আবেদীন, জীবন মানে জহির রায়হান।

পুঁজিতান্ত্রিক এ সমাজে শৈল্পিক বিনোদন সম্প্রচার নয়, লাভবান শিল্প পণ্য বিক্রিই গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য। ফলে গণমাধ্যম হয়ে উঠছে তথ্য ও বিনোদন উৎপাদনের কারখানা। আর ব্যবসা যখন শিল্পের মোড়কে ঢাকা তখন মানের বিষয়টি থাকে উপেক্ষিত। তাই কাহিনীর প্রয়োজনে নয়, বাণিজ্যের প্রয়োজনে টিভি সিরিয়ালগুলোর চিত্রনাট্যগুলো হয় অকারণ দীর্ঘায়িত।

কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে না পেলে ধীরে ধীরে গণমাধ্যমসৃষ্ট মানসিক দৈন্যতাগুলো স্থায়ীভাবে বাসা বাধবে আমাদের মগজে, আর এর প্রভাব পড়বে প্রজন্মান্তরে। তাই অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি ও চ্যানেলের সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দূরদর্শী ও সময়োপযোগী নীতিমালা এবং সুষ্ঠু ওকার্যকর ব্যবস্থাপনা।