শিখছি প্রতিদিনই, সবার কাছ থেকেই

মো: আব্দুল আলীম খান
Published : 30 Nov 2016, 03:34 AM
Updated : 30 Nov 2016, 03:34 AM

না হেঁটে আজ রিক্সায় উঠলাম, বাসায় একটু দ্রুত আসবো বলে। রাস্তার এক পাশ দিয়ে গাড়ি আর উল্টা পথের রিক্সা। তাই, সংকীর্ণ পথ দিয়েই রিক্সাওয়ালা ছেলেটি তার রিক্সা চালাচ্ছিল। সামনে একটা খালি রিক্সা, কিন্তু খুব আস্তে আস্তে চালাচ্ছে তার ড্রাইভার! একটু রাগ হচ্ছিলো, বললাম যে, সামনের রিক্সার কি সমস্যা? খালি রিক্সা এত আস্তে টানছে কেন? আমার রিক্সাওয়ালা ছেলেটা খুব সুন্দর একটা উত্তর দিলো। বললো, খালি রিক্সা তো আস্তেই টানে আর এদিক ওদিক তাকায়। যদি কেউ ডাক দেয়। ক্লান্তি আর বিরক্তির মাঝেও একটা ভালো লাগা কাজ করলো উত্তরটা শুনে। বললাম, বাহ্! খুব ভালো উত্তর দিয়েছো তো! আমিও অন্তত দুইটা জিনিস শিখলাম ঐ ছোট্ট উত্তর থেকে।

এক. যে যে কাজ করে তার সেই বিষয়ের অভিজ্ঞতা আসলেই ভালো/বেশি।
দুই. অল্পেই রাগ করা ঠিক না, আমি যা দেখছি হয়তো আমার দেখা ভুল, কিংবা এর পিছনে কোনো কারণ আছে।

একবার একজন বিজ্ঞ লোককে কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, কুকুর কখন সাবালক হয়? বিদ্বান লোকটির অনেক বিষয়ের জ্ঞান থাকলেও এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা ছিলোনা। তিনি উত্তরের তালাশে লেগে গেলেন। কেউই বলতে পারেনা, কোনো পুস্তকেও নাই। লোকটি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু! যাকে পান, তাকেই জিজ্ঞাসা করেন। অবশেষে উত্তর মিললো। উত্তরদাতা ছিলেন একজন মুচি এবং জানালেন যে, সেদিন কুকুর সাবালক হয় সেদিন থেকেই কুকুর এক ঠ্যাং উঁচু করে প্রস্রাব করতে শুরু করে। কথিত আছে, এরপর থেকে ঐ বিদ্বান ব্যক্তি সেই মুচির বাড়ির দিক পা দিয়ে ঘুমান নাই। একেই বলে উস্তাদের ভক্তি।

আমি জ্যাম এড়াতে প্রতিদিন একটু সকালে সকালেই আমার অফিসে (কলেজে) চলে যাই। আমিই সাধারণত সবার আগে পৌঁছাই। গিয়ে অফিসের পিয়ন আর গার্ডদের সাথে কুশল বিনিময় করি, সময় থাকলে কিছু কথাও হয়। তাদের অনেকেই অনেক কিছু জানতে চায়। সাধ্যমতো ভালো কথা শুনাই। সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম কলেজের ঠিক গেটের সামনে। দেখি যে, এক বৃদ্ধ লোক তিনটা কুকুরকে আদর করছে । কুকুরগুলোও আদর পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। তিনটার আলাদা আলাদা নামও আছে। লোকটি কুকুর তিনটার সাথেই রাতে ঘুমায়। শুধু আমরা কজন নয়, পথচারীর অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখতেছিলেন ব্যাপারটা। নিজের লুঙ্গি দিয়ে একটা কুকুরের মুখটা মুছিয়ে দিচ্ছিলেন, আর কুকুরটা মুখ এমনভাবে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন কোনো মা তাঁর সন্তানকে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে আর সন্তান মায়ের স্বর্গীয় আদরটুকু প্রাণভরে গ্রহণ করছে। দৃশ্যটা এত বেশি ভালো লাগলো যে, সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের উপর ঘৃণা জন্মে গেলো। আমি ওদেরকে বললাম, দেখেন, আদর পেলে নিকৃষ্ট প্রাণীও কেমন কৃতজ্ঞ হয়ে যায়! আর মানুষ কি করে? সবাই মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিলো।

উপরে ঘটনার সাথে একটা ঘটনা না বললে ঘৃণার ব্যাপারটা হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তাই বলেই দিচ্ছি। একবার আমার সেজো দাদার কাছে একজন লোককে বাড়ির রাখাল ধরে নিয়ে এসে বললো, দাদা, এই লোক আপনার অমুক ক্ষতি করতে এসেছিলো। দাদা তো পুরাই অবা! আমাদের গোষ্ঠীতেই সারা বছর কাজ করে! যখন যা প্রয়োজন নিজের মনে করে নেয়, নিজের লোকের মতো থাকে! মজুরির বাইরেও কত কত সাহায্য করা হয়! কিন্তু এমন লোক কেন ক্ষতি করতে আসবে? কিন্তু ঘটনা সত্যি এবং সে স্বীকার করে মাফও চাইলো। দাদা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, মনে তো পড়েনা কোনোদিন তোদের কোনো ক্ষতি করছি, আর তুই ক্ষতি করতে আসলি? পরক্ষণেই দাদা বললেন যে, ও আচ্ছা বুঝছি, সব সময় তোদের উপকার করি তো, তোদের কাছ থেকে ক্ষতি তো আমার পাওনা! ওরে ছেড়ে দে!

এই হলো মানুষ আর কুকুরের তফাৎ! বাসে প্রতিদিনই কিছুনা কিছু ঘটনা আমার চোখে পড়ে। এই যুগেও এক টাকার জন্য কন্ডাক্টরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালায় করতে দেখেছি শিক্ষিত জনকে! দেখেছি, অপরাগতা স্বীকার করাতে নির্দ্বিধায় মাগনা কোনো যাত্রীকে নিয়ে যেতে। এ রকম অজস্র ঘটনা দেখি চলার পথে প্রতিদিনই! যার ভালোটা চোখে পানি নিয়ে আসে, আর মন্দটা দুঃখে ভেঙ্গে দেয় অন্তর। তবুও দেখি আর ভাবি যে, নানা লোকের নানা আচরণ, এমনটা তো হবেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে তো খারাপ আচরণগুলো মেনে নেয়া কষ্টকর! তাই মাঝে মাঝে প্রতিবাদ না করে হয়ই না। চেষ্টা করি ভালোটা থেকে ভালোকে গ্রহণ করার, আর খারাপ কিছু দেখলেও তা থেকেও ভালো কিছু শিখি যে, এমন আচরণ যেন কখনই আমার দ্বারা না হয়।

শিখছি প্রতিদিনই, সবার কাছ থেকেই, সর্বদাই! আর চাওয়াটুকু হলো, মরণ যেন হয় এই শিক্ষাগুলোর ভালোটা গ্রহণ করে ভালোর উপর থেকেই।