বই পড়ুয়া জাতি হিসেবে ভারতীয়দের অবস্থান এক নম্বরে। একজন ভারতীয় প্রতি সপ্তাহে বই পড়েন গড়ে ১০ ঘন্টা ৪২ মিনিট। ত্রিশটি দেশের তালিকায় সবার নিচে অবস্থান কোরিয়ানদের। তারা প্রতি সপ্তাহে বই পাঠে সময় ব্যয় করেন ৩ ঘন্টা ৬ মিনিট। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান কত নম্বরে তা চেষ্টা করেও জানা যায়নি। অবশ্য বই পড়ে আমরা সপ্তাহে কত ঘন্টা ব্যয় করি তা আপাতত না জানলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ পুরো জাতি বিশেষ করে আমাদের 'গুণধর' রাজনীতিবিদরা এখন দুটি বইয়ের উপর হুমরী খেয়ে পড়েছেন। প্রথমটি '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' এবং পরেরটি 'বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি এন্ড দ্য আফটারম্যাথ ২০০৭-২০০৮'। বলা চলে বই দুটি আমাদের রাজনৈতিক ময়দানে প্রচন্ড ঘূর্ণিবায়ু সৃষ্টি করেছে। এই ঘূর্ণির নায়ক দুইজন। প্রথমজন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর উপসেনাপতি এয়ারভাইস মার্শাল (অব.) এ. কে. খন্দকার বীর উত্তম এবং অপরজন এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ও বিএনপির কথিত 'ডিগবাজি' নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।
জনাব এ কে খন্দকার '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' এর ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শেষ শব্দ ছিল 'জয় পাকিস্তান।' হতে পারে। হতে পারে বলছি, কারণ এ ভাষণ আমি নিজে সরাসরি শুনিনি। আমার জন্ম একাত্তরেরও বহু বছর পরে। তাছাড়া, এ ভাষণ যারা নিজ কানে শুনেছিলেন তাদের অনেকেরই দাবি খন্দকার সাহেবের মতই। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু 'জয় পাকিস্তান' বলেছিলেন কিন্তু পরে ভাষণের রেকর্ড থেকে সে শব্দটুকু কেটে দেওয়া হয়। এ দাবি আজকের নয়, অনেক পুরনো। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সিনিয়র সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদ তাঁর বহুল পঠিত 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' গ্রন্থের ৫৫৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: ''কিছুদিন ধরিয়া তিনি (বঙ্গবন্ধু) সব বক্তৃতার শেষ করিতেন এক সংগে 'জয় বাংলা' 'জয় পাকিস্তান' বলিয়া। এই দিনকার সভায় (৭ মার্চ) প্রথম ব্যতিক্রম করিলেন। শুধু 'জয় বাংলা' বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেন। যাঁরা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন, তাঁদের কেউ কেউ আমার এই কথার প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বলেন, শেখ মুজিব ৭ই মার্চের সভাতেও 'জয় বাংলা' 'জয় পাকিস্তান' বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তৃতা শুনিয়াছি এবং তাতে 'জয় পাকিস্তান' ছিল না, তার জবাবে তাঁরা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল।'' অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা'র পাশাপাশি 'জয় পাকিস্তান' বলেছিলেনÑ এ বিতর্কের সূত্রপাত ২০১৪ সালে নয়, ১৯৭১ সাল থেকেই। 'জয় পাকিস্তান' সম্পর্কে ৭ মার্চের ভাষণের শ্রোতা বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্ররায়-এর দৃষ্টিভঙ্গিটাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, 'পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে জয় বাংলার পাশাপাশি জয় পাকিস্তান বলে শেখ মুজিব পাপ করেননি।' গয়েশ্বর চন্দ্ররায়ের এই বক্তব্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলেই মনে করি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি এবং প্রাপ্য ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য আলোচনার পথ তিনি তখনও বন্ধ করেননি। তাই বঙ্গবন্ধু যদি 'জয় পাকিস্তান' বলেও থাকেন তাতে কী আসে যায়! শেষ পর্যন্ত তো তাঁর 'জয় বাংলা'ই জয়ী হয়েছে, 'জয় পাকিস্তান' নয়। তাই আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ইতিহাসের একটি সত্যকে অনর্থক আড়াল না করে সাহসীকতার সাথে তা স্বীকার করে নেওয়া। তবে এ কে খন্দকারের এই তথ্য যদি মিথ্যা হয় তবে তাদের উচিত হবে তার পক্ষে অকাট্য প্রমাণ দিয়ে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং জাতির নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্তির জাল থেকে মুক্ত করে আনা।
জনাব এ কে খন্দকার তার গ্রন্থে আরো লিখেছেন, 'তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র লিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তা পাঠ করতে বললেও বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। উল্টো তিনি বলেন, এটা আমার বিরুদ্ধে একটি দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।' তিনি আরো দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল না। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সামরিক নেতৃত্বে। ২৫ মার্চের রাতের ঘটনাটি সত্য কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ এটি একটি তথ্য আর এ কে খন্দকার নিজে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করতে বঙ্গবন্ধুর অপারগতার কথা তিনি শুনেছেন তার বন্ধু মইদুল হাসানের কাছ থেকে। জনাব মঈদুল হাসানের বক্তব্য যে সঠিক সে নিশ্চয়তা কোথায়?
তবে ৭ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার কথা মনেপ্রাণে চিন্তা করেছিলেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রস্তুতি নিয়ে এ কে খন্দকারের বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। আবুল মনসুর আহমদ তার ঐ একই গ্রন্থের ৫৫৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 'অসাধারণ ব্যক্তিত্বশালী মুজিব তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা করেন নাই সত্য, তবে তরুণদের চাপে অন্ততঃ তাদের মন রাখিলেন। শুধু তাদের দেখাইবার উদ্দেশ্যেই পরিষদে যোগ না দিবার ব্যাপারটায় ঐরূপ বীরত্বব্যঞ্জক ব্র্যাভাডো প্রদর্শন করিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিদার তরুণদের খুশি করিবার জন্য শেখ মুজিব আরো দুইটা কাজ করিলেন। প্রথমতঃ উপসংহারে তিনি বলিলেন: আজিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ৫৫৬ পৃষ্ঠায় তিনি আবারো লিখেছেন, 'এটা নিঃসন্দেহে বোঝা গেল যে তথাকথিত ছাত্র-নেতা ও তরুণদের যবরদস্তি ও হুমকি ধমকেও সেদিন শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ইচ্ছা ছিল না। আমার বিবেচনায় এটা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই প্রমাণ।' তবে আবুল মনসুর আহমেদ বা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাধীনতা চাননি। এর অর্থ এই যে বঙ্গবন্ধু ঠিক ঐ সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মত চরম সিদ্ধান্ত নেবার কথা চিন্তা করেননি। এতে দোষের কী আছে?
আওয়ামী লীগ বরাবরই নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের একক নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে দাবি করে এসেছে। তাই এ কে খন্দকারের এমন বাক্যবানে স্বভাবতই দলটিতে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু এ কে খন্দকারকে ঘায়েল করতে গিয়ে দলটির নেতা ও সমর্থকরা যা বলতে শুরু করেছেন তাও হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য। আওয়ামী লীগের অনেকেরই দাবি, এবার মন্ত্রী হতে না পেরে এ কে খন্দকার ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। সংসদে তার বই নিষিদ্ধ করারও দাবি উঠেছিল। হয়তো কদিন পর কেউ না কেউ আবিস্কার করে ফেলবেন যে এ কে খন্দকার একজন রাজাকার! অথচ যতটুকু জানি তিনি বইটি লেখা শুরু করেছিলেন মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবারও অনেক আগে। আর স্বাস্থ্যগত কারণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি অংশ নেননি। সুতরাই মন্ত্রীত্ব না পেয়ে তিনি এই বই লিখেছেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এই দাবির তেমন কোন ভিত্তিই নেই। তাছাড়া আবুল মনসুর আহমদ কিংবা ১৯৭১ এর সেই সব প্রত্যক্ষ শ্রোতারও কি মন্ত্রীত্ব না পাবার হতাশা থেকে এ কথা বলেছিলেন? তা নিশ্চই নয়। তাই সমালোচনায় বাকসংযম প্রত্যাশিত।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রসঙ্গে। এ কে খন্দকারের '১৯৭১: ভেতরে বাইরে' প্রকাশিত হবার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন বিএনপির নেতা-সমর্থকরা। কারণ অজ্ঞতা। তারা ভেবেছিলেন, 'জয় পাকিস্তান' ইস্যুকে কেন্দ্র করে এবার হয়তো আওয়ামী লীগকে ধোলাই দেওয়া যাবে। কিন্তু তাদের এই তৃপ্তিবোধ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ এ বইয়ে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে এ কে খন্দকারের বক্তব্য আরো কঠিন। তিনি লিখেছেন, 'জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। সে যোগ্যতাও তার ছিল না।' তবে এখানেই শেষ নয়। এ কে খন্দকারের বক্তব্যের যন্ত্রণা লঘু হবার আগেই বিএনপি ঠিক আওয়ামী লীগের মতই আক্রান্ত হয়েছে নিজের ঘরের মানুষ দ্বারা। তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ব্যারিস্টার মওদুদ তার 'বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি এন্ড দ্য আফটারম্যাথ' গ্রন্থে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন তার বর্তমান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। ২০০৭ সালে জেলখানায় বসে রচিত তার এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন:'খালেদা জিয়ার কাছে ওই সময় তাঁর দুই সন্তান তারেক ও কোকোর ভাগ্যই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।… সে সময় দেশের মানুষের নেত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন কিংবা একজন রাজনীতিবিদের চেয়েও একজন মা হিসেবে দুই সন্তানের মুক্তির বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন খালেদা জিয়া।' তাছাড়া, ২০০৮ সালের নির্বাচনকে তিনি মূল্যায়ন করেছেন 'নীরব বিপ্লব' হিসেবে। ব্যারিস্টার মওদুদের এমন সোজা-সাপ্টা বক্তব্য নিঃসন্দেহে বেগম জিয়া ও বিএনপির জন্য বিব্রতকর। কিন্তু মিথ্যা কি? নিশ্চই নয়। দুঃখজনক হলেও, সত্যকে মেনে নেবার মত শক্তি ও সাহস বিএনপিও দেখাতে পারেনি। তাই হয়তো ব্যারিস্টার মওদুদের সমালোচনা করতে গিয়ে বিএনপির নেতারাও আওয়ামী লীগের নেতাদের মতই আচরণ করছেন। দলটির দপ্তর সম্পাদক রিজভী আহমেদ তো ব্যারিস্টার মওদুদকে 'ডিগবাজি' নেতা হিসেবে গালি দিয়েই ফেলেছেন। জনাব রিজভীর এই বোধদোয় এত দিন কোথায় ছিল আমাদের সেটাই প্রশ্ন।
তাই রাজনীতিবিদরা যাই বলুক আর করুক না কেন, আমরা এদেশের সাধারণ মানুষ সত্যটা শুনতে চাই, সত্য ইতিহাসটা পড়তে চাই। সত্য তথ্য ও সত্য ইতিহাস আমাদের রাজনীতিবিদরা এখন যতই লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন, আমাদের বিশ্বাস সময়-ই সে সত্য উন্মোচিত করবে।