গাজীপুরের জনগণকে অভিনন্দন, কোন জনগণকে

শওগাত আলী সাগর
Published : 23 March 2011, 07:54 AM
Updated : 7 July 2013, 09:50 AM

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল পুরোপুরি ঘোষিত হওয়ার আগেই সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে গাজীপুরের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। গাজীপুরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণতান্ত্রিক চর্চায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের একজন প্রতিনিধি বাছাই করেছেন। বলে রাখি, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোন প্রার্থী বা কোন দল বিজয়ী হল তার চেয়েও আমার আগ্রহ বেশি ছিল একটি দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে কি না সেটি দেখা।

কিন্তু গাজীপুরের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে ফেসবুকে দেওয়া আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক সুমন দত্ত। আমার পোস্টের নিচে তার মন্তব্য, ''গাজীপুরের কোন জনগণকে অভিনন্দন জানাবেন? বিষয়টা এইভাবে ভেবে উত্তর দেবেন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লা পেয়েছেন ২ লক্ষ আটান্ন হাজার আটশত ষাটষট্টি ভোট (২,৫৮,৮৬৭)। অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী মান্নান পেয়েছেন ৩ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার ৪ শত চুয়াল্লিশ ভোট (৩,৬৫,৪৪৪)। বিজয়ী বিএনপি সমর্থিত পার্টি। কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি ১০ লক্ষাধিক ভোটার যে এলাকায়– সে এলাকায় ভোট দিয়েছে মাত্র ৬ লাখ ২৪ হাজার ভোটার। ৩ লাখ পঁচাত্তর হাজার লোক ভোট দিতেই যাননি যা বিজয়ী ব্যক্তির প্রাপ্ত ভোটের চাইতে বেশি। প্রকৃতপক্ষে জিতল কে? এই দুই ভাঁওতাবাজ পার্টিকে যারা দেখতে পারে না তারাই তো বিজয়ী হয়েছে।''

আরেক সাংবাদিক (তিনি যেহেতু ইনবক্সে কথাটা বলেছেন তাই নাম উল্লেখ করলাম না) বলেছেন, ''গাজীপুরের সিংহভাগ হিন্দুই ভোট দিতে যাননি।''

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থক এবং সরকারবিরোধীরা এ ফলাফলের মধ্যেই সরকারের পতন এবং বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের যৌথ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন। আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে তীব্র হতাশাবোধ কাজ করলেও যারা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন তারা দলের বিভিন্ন অংশকেই নির্বাচনে বিপর্যয়ের জন্য দোষারোপ করছেন।

সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার শিক্ষক আনিস আলমগীর ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, ''বাংলাদেশে নির্বাচনী ফলাফল এখন আর জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয়, বরং জনঅসন্তোষের ব্যারোমিটার।''

আরেকটা গ্রুপ আবার খোদ ভোটারদের বিবেচনাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। তাদের ভাষ্য– চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, হজ্জযাত্রীদের টাকা মেরে দেওয়া প্রার্থীও যদি বিপুল ভোটে নির্বাচনে জিতে যায়, তাহলে বুঝতেই হবে জনগণ চোর-বাটপাড়দেরই পছন্দ করে। প্রতিক্রিয়াটি নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারে সিংহভাগ বিশ্লেষণে সবচেয়ে 'কমন' যে কথাটা বলা হয় তার সঙ্গে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করে।

পদ্মাসেতু, হলমার্কসহ নানাধরনের দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে জনগণ যদি আওয়ামী লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে সে জনগণই আবার একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে ভোট দেয় কীভাবে? ভোটের ফলাফলে দুর্নীতি কোনো ধরনের নিয়ামক হলে অন্তত মান্নানের ভোট পাওয়ার কথা নয়। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ মান্নান যখন বিপুল ভোটে জয়ী হন তখন হলমার্ক বা পদ্মাসেতু দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগ হেরেছে– এ কথা ধোপে টেকে না।

তাহলে নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থী হেরে গেলেন কেন? আমি নিজে হেফাজতকে ভোটের মাঠে কোনো ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনায় নিই না। হেফাজতিরা অতীতেও ছিল, তখনও নির্বাচন হয়েছে। এরা বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং প্রগতিবিরোধী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে। এবার তারা জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারে শামিল হয়েছে।

টরন্টোর সাপ্তাহিক বাংলা কাগজের সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান এম আর জাহাঙ্গীরের মন্তব্য, ''গাজীপুরে ভোট হয়েছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে। আওয়ামী লীগকে ওরা হিন্দু বানিয়ে মুসলমানের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। সে চেষ্টাই সফল হয়েছে।''

সুপরিকল্পিত সেই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরকার, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং 'আওয়ামী লীগ ডুবলে দেশ ডুবে যায়' বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করা প্রগতিশীল গ্রুপটাও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বা নিতে পারেনি। আমি বিভিন্ন সময় বলেছি, 'আওয়ামী লীগ প্রচারেও ম্যাড়ম্যাড়া, অপপ্রচারেও।' নিজেদের ভালো কাজটুকুও তারা ঠিকমতো প্রচার করতে পারে না।

চারটি সিটির নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ কি রাজনৈতিকভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। নিজস্ব অবস্থানে, নিজের আদর্শিক জায়গায় শক্তভাবে দাঁড়াতে পারল না কেন আওয়ামী লীগ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও কেন বিতর্কিত রাজনীতিক এরশাদের পেছনে দৌড়াতে হল? হেফাজতকে নিয়েও টানাহেঁচড়া করতে হল?

আওয়ামী লীগকে যারা ভোট দেয়, তারা আওয়ামী লীগের আদর্শিক অবস্থানকেই ভোট দেয়। কিন্তু ভোটের খেলা আওয়ামী লীগকেও নিজের আদর্শিক অবস্থানে অনড় রাখতে পারল না। তাহলে আদর্শের টানে যে ভোটার ভোট দেন, তিনি কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন? তিনি কি ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকে নিজের প্রতিবাদটুকুও প্রকাশ করতে পারবেন না? তিন লাখেরও অধিক যে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি, তারা কি এভাবেই আদর্শহীন ছুটোছুটির প্রতিশোধ নিলেন?

আর জাহাঙ্গীরকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দেওয়া হল কেন? এ সরকারের প্রভাব ব্যবহার করে তিন-চার বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়া জাহাঙ্গীরকে রাস্তা থেকে যে ছাত্রলীগ নেতারা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সর্বনাশটা তারাই যে করে দিয়েছেন, সেটা আওয়ামী নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন কিনা কে জানে? একজন ভোটের প্রার্থীকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে কেন? তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে? প্রধানমন্ত্রী কি তাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরকে উঠিয়ে আনার জন্য? আর সবকিছুতেই হুটহাট প্রধানমন্ত্রীকে সম্পৃক্ত করে ফেলতে হবে কেন?

জাহাঙ্গীরকে আমি 'পলিটিক্যাল পারসোন্যাল' বলে মনে করি না। বিভিন্ন মিডিয়ায় তার বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীর আর যাই হোক, আদর্শিক রাজনীতির কোনো লোক নয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে নিয়ে টানটানি জনগণকে বিরক্ত করেছে। সে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভোটের বাক্সে।

আগেই বলেছি, ভোটে আমার আগ্রহ ছিল একটা দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনের স্বরূপ দেখা। কোনো দলীয় সরকারের অধীনেও যে সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হতে পারে সে প্রমাণটা সম্ভবত আওয়ামী লীগই প্রথম রাখল। কিন্তু নির্বাচনী বিশ্লেষণে, টক শোর আলোচনায় এ কৃতিত্ব কেউ স্বীকার করতে চায় না। আওয়ামী লীগও জোরেসোরে সে প্রচারণা চালাতে পারেনি।

বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলে; প্রচার ও অপপ্রচার দুটোই চালায়। আওয়ামী লীগের আরেকটি সমস্যা হল, প্রগতিশীল প্রায় সবকটি মহলও আওয়ামী লীগেরই সমালোচনা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। কখনও কখনও জামায়াত-বিএনপির প্রচারণা আর প্রগতিশীল বামদের আওয়ামীবিরোধী প্রচারণার টোনটাও একই রকম হয়ে যায়। 'তকমা' লাগিয়ে না দিলে কেবল বক্তব্য দেখে কোনটা কার বক্তব্য আলাদা করাও কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়।

গাজীপুরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের দিকে সেই তীর আবার ছোঁড়া শুরু হয়েছে। সাংবাদিক বন্ধু সুপ্রীতি ধরের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই, ''অবাক হচ্ছি দেখে যে, আওয়ামী লীগ যখন হারে, তখন কিছু মানুষ নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়, যেন এটা ছোঁয়াচে রোগ, ছুঁলেই ধনুষ্টংকার হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হার দেখে আমার কাছের মানুষদের অনেকেরই স্বরূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, তারা এখন নিজেদের বেশি বেশি 'মানুষ' বলে ঘোষণা দিতে শুরু করেছে।''

আওয়ামী লীগের বিকল্প শাসকদের হাতে দেশ কোনদিকে যাবে সেটা কিন্তু ইতোমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচনে হেরে গেলে বা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেতাদের ব্যক্তিগত কোনো সমস্যাই হয় না। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিপত্তি কোনো কিছুতেই চুল পরিমাণ ঘাটতি দেখা দেয় না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অগ্রসরমান মুক্তচিন্তার সমাজ বাধাগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আওয়ামী লীগ নামের দলটি ক্ষমতায় না থাকলে।

বিষয়টা যত দ্রুত বোধগম্য হবে দেশের জন্য ততই মঙ্গল।

শওগাত আলী সাগর : প্রথম আলো'র সাবেক বিজনেস এডিটর এবং কানাডা থেকে প্রকাশিত 'নতুনদেশ ডটকম'-এর প্রধান সম্পাদক।