রৌরব (কিস্তি ৮)

লীসা গাজী
Published : 9 April 2009, 10:15 AM
Updated : 9 April 2009, 10:15 AM

(কিস্তি ৭-এর পর)

ওদের খাবার ঘরটা ছোটোর মধ্যে নিঁখুতভাবে গোছানো। এটাকে ঠিক পরিপূর্ণ কোনো ঘর বলা যাবে না, বিভিন্ন ঘরে যাওয়ার জন্য একটা কমন জায়গা বলা চলে। রান্নাঘর থেকে বের হলেই খাবার জায়গা আবার রান্নাঘরের উল্টা দিকে পাশাপাশি দু'টা দরজা। একটা লাভলির ঘরের দরজা অন্যটা বিউটির। দু'টা ঘর ছাড়িয়ে গেলে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মাথার মতো আরও দু'টা ঘর শেষ মাথার দুই প্রান্তে। বাঁয়ের ঘরটা বসার ঘর আর ডানেরটা ফরিদা আর মুখলেস সাহেবের শোবার ঘর। এই বাসার সবচেয়ে বড় ঘর সেটাই। বসার আর ফরিদাদের শোবার এই দু'টা ঘরই রাস্তার দিকে মুখ করে। অবশ্য ফরিদার ঘর থেকে যতো স্পষ্টভাবে রাস্তা দেখা যায় ততোটা বসার ঘর থেকে দেখা যায় না। যাই হোক, সেই খাবার জায়গায় একটা ছয়-সিটের ডাইনিং টেবিল বসানো। টেবিলের মাথায় মুখলেস সাহেবের নির্দিষ্ট জায়গা। তার বাঁ দিকে ফরিদা, ফরিদার পাশে লাভলি বসে, বিউটি ফরিদার উল্টা দিকের চেয়ারে বসে। এছাড়া একটা মিটসেফ আছে, ফ্রিজও এখানেই রাখা। বাঁ দিকের দেয়াল জুড়ে একটা আজমির শরিফের ছবি বাঁধানো।

ইতোমধ্যে খাবার দেয়া হয়ে গেছে, বেশ ধোঁয়া বের হচ্ছে। খাবারের ম ম গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিউটির পক্ষে আর বেশিক্ষণ খিদে আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে বেশ মরিয়া হয়ে উঠলো। সে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে পড়লো আর সেখান থেকেই জোরে ফরিদাকে ডাকলো। মুখলেস সাহেবকে ডাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকলেও ডাকতে হলো। কারণ তিনি এসে না বসা পর্যন্ত খাওয়া শুরু করা যাবে না। নিঁখুত হতে হবে, সবকিছু নিখুঁত।

— চিল্লাচিল্লি করতেছিস কেন?

—খিদা লাগছে। দুইটা বাজছে অনেক ক্ষণ।

এটা সে কী বললো, এটা কী মনে করিয়ে দেবার মতো কোনো কথা। এই কথার পর মা, মেয়ে দু'জনেই দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো। সেখানে অবশ্য পোনে একটা বেজে ঘড়ির কাঁটা বছর খানিক ধরে দম নিচ্ছে। আল্লাহ'র রহমত! দু'টা বাজার পরেও ঘড়ির কাঁটা ছুটে চলেছে এই দৃশ্য না দেখাই ভালো।

—রাবেয়ার মা, বলছি না খাওয়ার সময় কাছে থাকবা। লাভলির প্লেটটা সরাও।

রাবেয়ার মা ইতস্তত করে লাভলির প্লেট সরালো। ফরিদা বিউটির দিকে তাকিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করলেন।

—খালি প্লেট দেখতে ভালো লাগে না।… লাভলি আসলে প্লেট আবার দিয়া যাইও।

শেষের কথাটা রাবেয়ার মা'কে উদ্দেশ্য করে। মিটসেফের ভিতরে প্লেট রাখতে গিয়ে ফরিদার কথা শুনে সে উপরে রাখলো।

—খালুজানরে ডাক দেও।

—পিচ্চি ডাকতে গেছে।

বিউটি তথ্য যোগান দিলো। ফরিদা হাঁসের মাংসের বাটিটা টেনে নিলেন, নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকলেন। তাকে সন্তুষ্টই মনে হলো।

—রাবেয়ার মা মাংসের পাতিলটা নিয়া আসো, আর তোমাদের বাটি।

রাবেয়ার মা সঙ্গে সঙ্গে পাতিল আর বাটি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মনে হলো এতক্ষণ সে এগুলি হাতে নিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো, বলা মাত্র বান্দা হাজির। এই ক্ষিপ্রতায় ফরিদা খুশি হলেন। গলার হাড় এবং ডানা ছাড়াও দু'জনের জন্য দু'টা আস্ত মাংস আর হাঁসের চামড়া দিলেন ঝোলসহ। মন তার আজকে দরাজ হয়ে গেল নাকি কোনো কারণে অথবা এলোমেলো চিন্তায় এতটাই অন্যমনস্ক যে চাকর-বাকরদের মাংসও দিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়। বাটির দিকে তাকিয়ে রাবেয়ার মা'রও চোখ কপালে উঠলো।

—খালাম্মা এই তরকারী আমার আর পিচ্চির লাইগ্গা।

—কথা কম বলবা, তরকারী দুপুর আর রাত্র মিলা খাবা। এইগুলান নিয়া যাও আর একটা প্লেট নিয়া আসো।

—জে।

—তুমাদের ভাত রান্ধো নাই তো?

—জে না।

'জে না' বলতে গিয়ে রাবেয়ার মা'র বত্রিশ পাটির দাঁত বের হয়ে গেলো। মুখলেস সাহেব বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে এসে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলেন। বিউটির দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলেন আর সাথে সাথে বিউটির মুখ কঠিন হয়ে গেলো। বিউটি যে মুখলেস সাহেবকে দেখতে পারে না এই তথ্য সবার অজানা থাকলেও মুখলেস সাহেবের কাছে তা পানির মতো পরিষ্কার। কিন্তু তিনিও এই বিষয়টাকে কখনও লোকচক্ষের সামনে আসতে দেন নাই। খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছেন —মেয়ে বাপকে কঠিন অপছন্দ করবে এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে, হরদম ঘটছে —ভাবটা এমন!

দ্বিতীয় দফায়ও ফরিদা রাবেয়ার মা আর পরিবারের দু'জনকে চমকে দিয়ে ইলিশ মাছের সুন্দরমতো দু'টা টুকরা আর গাদাখানিক পোলাও ওদের জন্য প্লেটে বেড়ে দিলেন। আজকে ফরিদার মনটা নরম, আহারে —এই ভেবে মুখলেস সাহেব বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা বড়সড় নিঃশ্বাসটা গিলে ফেলতে গিয়ে বিষম খেলেন। সাথে সাথে এক চুমুক পানি খেয়ে কাশি সামলালেন। এদিকে বিউটি ভাবছে, এতোদিনে আম্মা ভালো ধরা খাইছেন —এই চিন্তা বিউটির মাথায় আসার সাথে সাথে ঠোঁটের বাম কোণায় তীর্যক হাসি দেখা গেলো।

ওরা নিঃশব্দে খাচ্ছে। চপত চপত শব্দে মুখলেস সাহেবের খাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু শোনা যাচ্ছে না। আজকের ইলিশ-পোলাও বিউটিকে অবাক করে দিয়ে দুর্দান্ত লাগছে খেতে। টেবিলে বসে গন্ধেই টের পেয়েছিলো বিউটি রান্না হয়েছে ফাটাফাটি। রাবেয়ার মা আর পিচ্চির জন্য ফরিদার বেড়ে দেওয়া শেষ হতে বিউটি এক রকম হুমড়ি খেয়ে পড়লো খাবারের উপর। টেবিলে একটা পদ কম —দই বেগুন দেখা যাচ্ছে না। ফরিদা বেমালুম ভুলে গেছেন।

মুখলেস সাহেবও গভীর আনন্দে খেয়ে চলেছেন। শুধু ফরিদা খেতে খেতে কখনও ঠোঁট কামড়ে ধরলেন, দু'বার কারণ ছাড়াই শিউরে উঠলেন, একবার পানি খেতে গিয়ে ঠোঁটের কাছে গ্লাস আনার আগেই গ্লাস কাৎ করে দিলেন, ফলে বেশ খানিকটা পানি ঠোঁট গড়িয়ে তার শাড়িতে পড়লো। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলেও অসাধারণ দক্ষতায় এইসব ছোটোখাটো ঘটনাগুলি ধামাচাপা দিতে পারলেন অথবা ভাবলেন পেরেছেন। একবার শুধু বিউটি মুখে নলা দিতে গিয়ে থমকে মায়ের দিকে তাকালো। পাছে মায়ের দুরবস্থায় আবারও হাসি আসে এই ভয়ে চটজলদি চোখ সরিয়ে নিলো।

—রাবেয়ার মা, দই আর পায়েসের বাটি ফ্রিজ থিকা বার করো।

সেদিন আর কেউ পায়েস বা দই খেলো না। মুখলেস সাহেবের খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো তাকে খেতে দেয়া হলো না। বিউটি গলা পর্যন্ত খেয়েছে, পেটে এক ফোঁটাও জায়গা ছিলো না আর কিছু খাওয়ার। বিকালে খাবে বলে উঠে পড়লো। আর ফরিদার পায়েসের বাটির দিকে তাকাতেই গা গুলিয়ে উঠলো, খাবার তো প্রশ্নই উঠে না।

খাওয়া শেষ হতে যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ালো শুধু মুখলেস সাহেব ছাড়া। আজকে উনি ঠিক করেছেন পারতপক্ষে ফরিদার সামনে পড়বেন না। লাভলি ফিরে আসুক তারপর তুলকালাম যা হবার হওয়ার পরে বারান্দা থেকে বের হবেন। যদিও এখন বেশ শীত শীত লাগছে। বারান্দায় গিয়ে শালের উপর কম্বল জড়িয়ে বসবেন ঠিক করলেন। তিনি জানেন এখন ফরিদা বা বিউটি দু'জনের কেউই তাকে সহ্য করতে পারবে না —তার দিকে তাকালেই মেজাজ চড়তে শুরু করবে ওদের। শুধু শুধু ওদের মেজাজ খারাপ করানোর কী দরকার? তিনি চুপচাপ বারান্দায় বসে নিচু ভলিউমে গান শুনবেন —না, আজকে বোধহয় গান শোনা ঠিক হবে না। তাতেও ক্ষতি নাই, নতুন দু'টা সিনেমার পত্রিকা আছে সেগুলি দেখতে দেখতেই ঘণ্টাখানেক আরামে কাটিয়ে দিতে পারবেন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। বারান্দায় গেলেই পিচ্চি বখশিশের লোভে লোভে ঠিকই চলে আসবে, তখন তাকে মাথায় হাত বুলাতে বলবেন বা পাকা চুল বেছে দিতে বলবেন। সে একটা একটা করে চুলের গোড়ায় হালকা টান দিবে আর অনায়াসে তার চোখ বুজে আসবে।

* * *

অনেকক্ষণ থেকে মনিপুরি পাড়ার একশ' পনেরো বাই তিন বাড়িটার উপরে একটা একটা করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। শীতের এই অপরাহ্ণে কালো কালো মেঘের দল কোথা থেকে বিশেষ করে এই বাড়িকে উদ্দেশ্য করে ছুটে আসছে বলা মুশকিল। তবে কাকের কালো মখমল শরীরে ভর করে যে আসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই বাড়ির উপর এসে ট্রাক থেকে সশস্ত্র সৈন্য নামার মতো টুপ টুপ করে নেমে পড়ছে। পুরো বাড়িটা যেন উপরে মেঘ আর ভিতরে আটকা-পরা বাসিন্দাদের নিয়ে একটা যতিচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মেঘ জমতে শুরু করেছে ফরিদার মাথার ভিতরেও। জমাটবাঁধা শক্ত মেঘ। এরা কখনও দুই ভ্রূর ঠিক মাঝখান দিয়ে গণ্ডারের শিংয়ের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আবার কখনও গুড় গুড় শব্দে ডাকছে। বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফরিদার কপালের ঠিক মাঝখানের জায়গাটুকু একবার ফুলে উঠছে আবার নেতিয়ে পড়ছে, আবার ফুলে উঠছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে কি না তাও ঠাহর করতে পারছেন না তিনি। এতো কিছুর মধ্যেও মুখলেস সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন, হাজার হোক তাকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এখন যদি মুখলেস সাহেব তার মুখের সামনে হ্যাঙ্গারের মতো ঝুলে থাকতেন তাহলে অবধারিত ভাবে ফরিদার সমস্ত বিদ্বেষ, হতাশা, ক্ষোভ তার উপরে গিয়ে পড়তো। আসলে মুখলেস সাহেব মোটেও ফরিদাকে একা থাকার সুযোগ করে দেন নাই বরং নিজেকে রক্ষা করেছেন মাত্র। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!

গত পনেরো মিনিট ধরে ফরিদা শোবার ঘরের এক প্রান্ত থেকে হেঁটে অন্য প্রান্তে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন। ঘড়ির দিকে তাকাতে তার ইচ্ছা করছে না। চারটা বাজলেও অবাক হবেন না। চুপ করে বসে যে ভাববেন তাও পারছেন না, কিছুই মাথায় খেলছে না। কী নিয়ে যে ভাববেন সেটাও মাঝে মাঝে মনে থাকছে না। লাভলি এতটা বেপরোয়া হবে তা ফরিদার কল্পনার বাইরে ছিলো। বিউটির কথামতো সত্যি সত্যি যদি আর না ফেরে? কিন্তু যাবে কই? —চল্লিশটা বছর পেলে পুষে বড় করেছেন —সেই মেয়ে কি তার সাথে এতো বড় বেঈমানী করতে পারবে। দুই মেয়ের জন্য লাভলি কী করেন নাই। পরিবারের সাথে সম্পর্ক বলতে কিছু নাই, সামাজিকতার ধার ধারেন না। দুই মেয়ের আরাম আয়েসের জন্য জীবনপাত করেছেন। ওদের চাহিদা, নিরাপত্তার উপর আর কোনো কিছু অগ্রাধিকার পায় নাই। আর কী করতে পারতেন তিনি? ওদের বিয়ে পর্যন্ত দেন নাই। কে জানে বিয়ের পরে কী জীবন অপেক্ষা করছে, এই ভয়ে কোনো পাত্রই ধোপে টেকে নাই।

টেলিফোন বাজছে অনেক ক্ষণ থেকে। অন্তত পাঁচটা রিং হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো কিন্তু ফরিদা শুনতে পেলেন না। আবার টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। এবার দৌড়ে টেলিফোনের সামনে গেলেন ঠিকই কিন্তু ধরলেন না, ওয়াড্রোবের পাশে বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একবার হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলেন।

আবার টেলিফোন বাজছে, যে করছে সেও কম যায় না। তুমি তুলবা না তোমার ঘাড়ে তুলবে!

—হ্যালো?

—হ্যালো।

—হ্যাঁ বলেন, বলেন আপনে কী চান ?

—আমি তো কোনো দিনই কিছু চাই নাই ফরিদা।

—ইয়ার্কি মারার সময় এখন না। বিশ/বাইশ বছর পরে আপনে যখন আবার ফোন করা শুরু করছেন, তখন মতলব কিছু আছেই। সেইটা কী তা যত তাড়াতাড়ি খোলাসা করবেন তত আমাদের দুইজনের জন্যই মঙ্গল।

—তুমি একটুও বদলাও নাই ফরিদা। ইস্পাতের মতো শক্ত।

—এইসব ধানাই পানাই দয়া কইরা বাদ দেন।

—মেয়ে দুইটারে একটু দেখতে চাই ফরিদা। আমি কে কী বিত্তান্ত কিছুই বলবো না, শুধু মেয়ে দুইটারে চোখের দেখা দেখতে চাই।

—অসম্ভব।

—আমার কর্তব্য আমি করছি ফরিদা এখন তোমার কর্তব্য তুমি করো। আমাদের দুইজনেরই বয়স হইছে। শরীর আমার খুবই খারাপ, যেকোনো সময় আল্লাহ'র দরবারে ডাক পাইতে পারি, মেয়ে দুইটাকে দেখলে মনে শান্তি পাবো।

—বললাম তো কোনোদিনই সম্ভব না। আর আপনে কারে ভুলান, কী কর্তব্য করছেন? —সময় সময় টাকা পাঠাইছেন এই তো? —আপনে করছেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর কিছু না। নিজের পুলাপানের সামনে গিয়া কইতে পারবেন লাভলি আর বিউটি কে, পারবেন?

—না, এই বয়সে তাদের এত বড় শোক দিতে চাই না। খোদেজাও মারা গেছে বেশিদিন হয় নাই। আমি কারো ক্ষতি করবো না। শুধু আইসা একটু দেইখা যাবো। ওদের জন্য কিছু টাকা দিয়া যাবো।

—টাকা দিতে চাইলে দিবেন, কিন্তু মেয়েদের সাথে দেখা হবে না।

আসলেই ইস্পাতের মতো ঠাণ্ডা আর কঠিন শোনালো ফরিদার গলা। আবদুুল বশির সাহেব ফরিদার কথার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

—মেয়ে দুইটারে পাইয়াও তুমি সুখি হইলা না ফরিদা!

—আমি অসুখী এই সংবাদ আপনেরে কে দিছে।

আবারও বেশ কয়েক সেকেন্ড বশির সাহেব চুপ —শুধু ফোনের অন্য প্রান্তে তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফরিদার কপালের নিচে জমাট বাঁধা মেঘ আলগা হতে শুরু করেছে। যেকোনো মুহূর্তে প্রবল বিদ্যুতের ঘায়ে বৃষ্টি নামবে অথবা জমাট মেঘপুঞ্জ বাতাসের তোড়ে উড়ে চলে যাবে ফরিদাকে আরও শক্ত আরও কঠিন হবার সুযোগ করে দিয়ে।

—মেয়ে দুইটারে বিয়া দিলা না কেন ফরিদা, এত বড় ক্ষতি কেন করলা? ওদের চিন্তায় রাত্রে ঘুমাইতে পারি না…

আরও কিছু হয়তো তিনি বলে যাচ্ছিলেন কিন্তু সেগুলি শোনার মানসিক শক্তি ফরিদার ছিলো না। ফোন কেটে দিলেন। ওয়াড্রোব-এর উপর দুই হাত রেখে তার উপর মাথা রাখলেন। এক সময় ওয়াড্রোবের গা ঘেঁষে মাটিতে বসে পড়লেন। চোখ থেকে পানি টপ টপ করে পড়ছে, বাধা দিলেন না ফরিদা —যতোটুকু আছে বেরিয়ে যাক!

মেয়ে দু'টাকে কীভাবে তিনি আল্লাহ'র তিরিশটা দিন আগলে রেখেছেন। মুরগি তার ছানাগুলিকে যেভাবে পালকের নিচে রেখে দেয়, তিনি তাই করেছেন। জগতের সব কিছুতেই ফরিদার গা গুলায়, গা ঘিনঘিন করে —মেয়েদেরকে সেগুলির কোনো কিছুর ছায়াও মাড়াতে দেন নাই। মেয়েদেরকে তিনি রক্ষা করেছেন এই কথা কেউ বোঝে না। না বুঝলে নাই, তিনি কারও ধার ধারেন না। মেয়েরা তার ভালো আছে এইটাই সবচেয়ে আসল কথা।

ফরিদার তক্ষুনি মনে পড়লো লাভলি বাসায় নাই। বুকের ভিতর থেকে জানটা এক লাফে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। ঠিক সেই সময় ফরিদা নিশ্চিত হলেন লাভলি কোথায়। আবদুুল বশির যতই ফোন করে ভাওতা দিক না কেন, তিনি হলফ করে বলতে পারেন লাভলি এখন আবদুুল বশিরের জিম্মায়।

সে কি তাহলে মেয়েকে সব কথা বলে দিবে। না, এটা সে করবে না। তাহলে সে কী বলবে মেয়েকে?

ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে ফরিদার। ইচ্ছা করছে বিউটির ঘরে গিয়ে মেয়েটার হাত ধরে চুপ করে বসে থাকতে। কেউ যদি তখন তাদেরকে তালা মেরে রাখে তাহলে আরও ভালো হয়।

লাভলি এখন বশিরের সাথে কোথায় আছে, কী করছে, দুপুরে কি কিছু খেয়েছে? অবশ্যই খেয়েছে —বশির ঠিকই লাভলিকে খাওয়াবে, হয়তো খুব ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খাইয়েছে। বড়লোকী জাহির করতে হবে না! সব কিছু শোনার পর লাভলি যদি আর এই বাড়িতে ফিরে আসতে না চায়, এই মায়ের মুখ যদি আর দেখতে না চায়! না, সেটা কখনও হবে না, ফিরে সে আসবেই, হাজার হোক ও ফরিদার মেয়ে —মায়ের কথার অবাধ্য হতে ওরা দুই বোনের কেউই শেখে নাই।

* * *

নাইওর থেকে ফিরে ফরিদা কমলাপুরে কবি জসিম উদ্দিন রোডের শেষ মাথার প্লটটায় স্বামীর সাথে এসে উঠলেন। মুখলেস সাহেব ধরেই নিয়েছিলেন বিয়ের পরে নতুন বউ যে হতাশা আর গ্লানি নিয়ে বাপের বাড়িতে নাইওর করতে গেলেন, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু যখন ফিরে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে হাসি মুখে ফিরে এলেন তখন মুখলেস সাহেব গভীর ধন্ধে পড়ে গেলেন। এরকম আস্তো একটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে নিয়ে বসবাস করা তার জন্য ভয়াবহ।

—আমি সত্যিই বিয়া করতে চাই নাই ফরিদা, তুমি বড় ভাইজানকে জিজ্ঞাস করো।

—শুনো, তুমি আমার স্বামী। তোমার লজ্জা মানে আমার লজ্জা। এই বিষয় নিয়া আমরা আর কোনোদিন কথা বলবো না। এই বিষয়ে কথা বলা আজকেই শেষ, মনে থাকে যেন।

—তুমি জীবন কেমনে পার করবা?

—তোমারে একটা সত্য কাহিনী বলি, আমার আপনা ফুপাতো বোনের কথা, বিয়ার পরের দিন তার স্বামীরে সাপে কাটলো। সে জীবন পার করছে শ্বশুর বাড়িতে, অন্যের ফুট-ফরমাশ খাইটা। সেই তুলনায় আমি তো ভাগ্যবতী। আমার স্বামী জীবিত, সুস্থ। এই নিয়া আর দ্বিতীয় কথা না।

ফরিদা সংসার পাতলেন তিন কামরার টিনের বাড়িতে। বাড়িটা খুব পছন্দ হলো তার। শহরের মধ্যে বাড়ি কিন্তু গ্রাম গ্রাম ভাব। মূল বাড়ির সাথে লাগোয়া আর একটা ছোট ঘরে রান্নার ব্যবস্থা। রান্নাঘর ঘেঁষে এক চিলতে পাকা জায়গায় টিউব অয়েল বসানো। সেখানে বাসন, কোসন ধোয়া, হাত-মুখ ধোয়া। বাড়ির পিছনে অনেকখানি খালি জায়গা। সেখানে তারা সব্জির বাগান করলেন। ছুটির দিনে বাগানে বসে চা খেতেন, টুকটাক গল্প করতেন। খুব সুখি ছিলেন তখন, শুধু মাঝে মধ্যে মাঝরাতে উঠে বসে থাকতেন ফরিদা, এই যা। মুখলেস সাহেবে টের পেতেন ঠিকই কিন্তু কখনও জানতে দেন নাই।

একদিন মুখলেস সাহেব অফিস থেকে ফিরলেন তার গ্রাম সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে। ভদ্রলোক মুখলেস সাহেব থেকে অন্তত বছর পাঁচ/ ছয়ের বড়, নাম আবদুুল বশির। বিয়ের পরে স্বামীর দিকের আত্মীয়ের দেখা ফরিদা পান নাই-ই বলা চলে। তাই একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসায় বেশ অবাক হলেন। সেদিন মুখলেস সাহেবকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত উৎফুল্ল দেখালো। ফরিদাকে ভালো-মন্দ রান্না করতে বললেন। বাগান থেকে কাঁচা টমেটো নিজে তুলে এনে দিলেন আর চিংড়ি মাছ দিয়ে রাঁধতে বললেন। চিংড়ি মাছ সাথে নিয়েই এসেছিলেন আর একটা মুরগি। বাসায় পিঁয়াজ বেশি নাই বলতেই পিঁয়াজ আনতে ছুটলেন।

—ফরিদা, বশির ভাই আর আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। বশির ভাইয়ের আম্মা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কতো কিছু যে খাওয়াইছেন চাচি-আম্মা, সে তোমারে বইলা শেষ করা যাবে না।

—তোমরা বাগানে বসো, আমি চা কইরা আনতেছি।

—বাগানে কাঁচা টমেটো আছে, না কি সব পাইকা গেছে?

—আছে।

—কয়টা তুইলা আনি। কাঁচা টমেটো দিয়া চিংড়ি মাছ রানবা। চিংড়ি মাছ সাথে নিয়া আসছি। মুরগি আনছি, আলু আর কাঁচামরিচ দিয়া পাতলা ঝোল করবা।

—রানবো যে পিঁয়াজ বেশি নাই ঘরে। দুইটা আছে তাও শুকনা।

—আচ্ছা, তুমি চা বানাও আমি সামনের দুকান থিকা পিঁয়াজ নিয়া আসি।

পিঁয়াজ আনার জন্য মুখলেস সাহেব তড়িঘড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলেন।

—বাড়িতে মুড়ি টুড়ি আছে না কি? তাইলে চায়ের সাথে দিতে পারতা। না কি আমি নিয়া আসবো?

—মুড়ি নাই কিন্তু চিড়া আছে, ভাইজা দিবো নে, যাও। তুমি এত অস্থির হইতেছো কেন?

ফরিদার কথায় মুখলেস সাহেব একটু মিইয়ে যান, যেন তার অভিসন্ধি ফরিদা ধরে ফেলেছেন —আমতা আমতা করে কী একটা বলে ঘর থেকে প্রায় পালিয়ে গেলেন।

—না, অস্থির না —ছোট থাকতে উনাদের অনেক খাইছি, আদর পাইছি…

আহারে, নিজের বলতে লোকটার কেউ নাই, কে কবে আদর করেছিলো তার জন্য এখনও কত উতলা —ফরিদা গভীর মায়াবোধ করলেন মুখলেস সাহেবের জন্য।

শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার সময় সেই প্রথম ফরিদা আবদুুল বশির সাহেবকে দেখলেন। খুবই সাধারণ চেহারা, রঙ বেশ কালো, তবে উঁচা-লম্বা। তাকে দেখে নিজের অজান্তেই ফরিদা আঁচল দিয়ে ঘোমটা টানলেন।

—আসসালামালাইকুম।

—ওলাইকুম আসসালাম, ভাবি সাহেব। আপনেদের সংসার দেখতে আসলাম। বাড়ি তো চমৎকার।

—জি, ভালো করছেন। বাগানে বসেন ভাইজান, চা আনতেছি।

—মুখলেস কই গেলো?

—একটু দুকানে গেছেন, এখনি চইলা আসবেন।

ফরিদা রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে ভাবলেন, স্বামী বড় মুখ করে একজন মেহমান নিয়ে এসেছেন, তার যতœ তিনি সাধ্যমতো করবেন। দুই মুঠ বুটের ডাল ভিজালেন, মাংসের মশলা দিয়ে রাঁধবেন —মুখলেস সাহেব খুব পছন্দ করেন।

সেদিন রাতে মেহমান বিদায় হওয়ার পরে মুখলেস সাহেব গল্প করলেন কীভাবে আবদুুল বশিরের পরিবার তার মতো এতিমকে আপন করে নিয়েছিলেন। মায়ের আদর-যতœ কী তার ছোটখোটো নমুনা আবদুল বশিরের মায়ের কাছেই তিনি পান।

এর সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা, একদিন মুখলেস সাহেব অফিস ছুটির ঘণ্টাখানেক আগে বাড়িতে ফিরলেন। খাওয়া দাওয়া করলেন তারপর ধীরে সুস্থে কথাটা ফরিদার কাছে ভাঙলেন।

—বশির ভাইয়ের সাথে কালকে দেখা হইছিলো। অফিসে আসছিলেন। তোমার রান্নার স্বাদ না কি এখনও জিব্বায় লাইগা আছে।

—তাই না কি? বলো নাই তো?

—বলি নাই, না? চট্টগ্রামে বশির ভাইয়ের বিরাট এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কারবার, বুঝলা? সেই কারবার ঢাকাতেও আনতে চান। সেই কারণেই ঢাকায় আসা, আপাতত হোটেলে উঠছেন। কতোদিন আর হোটেলে থাকা যায়, বুঝলা না?… মানে, আমি উনারে একটা প্রস্তাব দিছি… আমাদের খালি কামরাটায় উনি কয়েক মাস থাকুক। উনারও খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা থাকবে না, আমাদেরও বাড়তি কিছু পয়সা সংসারে আসবে। তুমি কী বলো?

বুদ্ধিটা ফরিদার ভালোই মনে হলো। বিশেষ করে বাড়তি পয়সা আসার ব্যাপারটা তো খুবই ভালো। খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন।

—হ্যাঁ, উনি খালি ঘরটায় আরামে থাকতে পারবেন। ওই ঘরে খুব হাওয়া হয়… কত দিবে কিছু বলছে?

—না, তবে খারাপ দিবে না। উনার হাত খুব দরাজ।

দরাজ হাতের নমুনা ফরিদাও পেয়েছেন। নতুন বউয়ের মুখ দেখা উপলক্ষ্যে সেদিন আবদুুল বশির সাহেব বেশ কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন। ফরিদা প্রথমে নিতে চান নাই।

—নেন ভাবি সাহেব, মনে করেন বড় ভাসুর আপনেরে দিচ্ছে, না নিলে বেয়াদবি হবে।

—আরে নাও, নাও… বশির ভাই অতি অবশ্যই বড় ভাসুর।

ফরিদা সেদিন লাজুক হেসে টাকা ক'টা হাতে নিয়েছিলেন। পরে একান্তে গুণতে গিয়ে ওর চোখ প্রায় কপালে উঠে গেছে —১০০ টাকা! এত টাকা এমনি এমনি কেউ কাউকে দেয়! সুতরাং টাকা যে ভালোই পাওয়া যাবে সে বিশ্বাস ফরিদারও হলো —তাই স্বামীর প্রস্তাবে একেবারেই আপত্তি করলেন না, বরং হাসিমুখে অনুমতি দিলেন।

এক মঙ্গলবার সকালে শুধু একটা ছোটো কালো সুটকেস হাতে আবদুুল বশির সাহেব কবি জসিম উদ্দিন রোডের ১১ নম্বর বাড়িটায় উঠে এলেন। ঠিক সেই মুহূর্তটা থেকে ফরিদার জীবন ভয়ানক পাল্টে গেলো। শুরুর দিকে পুরো ব্যাপারটাই ছিলো এক ধরনের খেলা। যেন ফরিদা বিংশ শতাব্দীর দ্রৌপদী, পার্থক্যের মধ্যে তার স্বামী দু'টা। এক স্বামী যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মপ্রাণ অন্য স্বামী অর্জুনের মতো বীর্যবান!

বিয়ের পরে সেই পয়লা মুখলেস সাহেব নিঃশঙ্ক, ভারশূন্য বোধ করলেন। তার ঘাড়ের উপর থেকে বিশাল এক বোঝা তিনি নামিয়ে ফেলতে পেরে সুখী, অনুতাপশূন্য। ফরিদা সেই থেকে ভয়াবহ ভারে নত, পাপ-বোধে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত আর তা ঢাকতে ইস্পাতের মতো শক্ত, ছুরির ফলার মতো ধারালো। তবে জোর করে মাথা উঁচু করতে গিয়ে বুকের পাঁজর নতুন চাঁদের মতো বেঁকে গেলো।

রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ