শাহ আবদুল করিমের জীবনসঙ্গীত

saymon_zakaria
Published : 13 Sept 2009, 05:00 AM
Updated : 13 Sept 2009, 05:00 AM


শাহ আবদুল করিম (সুনামগঞ্জ ১৫/২/১৯১৬ – সিলেট ১২/১০/২০০৯)

প্রসঙ্গকথা
১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সকাল ৭ টা ৫৮ মিনিটে দেহ রেখেছেন বাংলাদেশের সুবিখ্যাত সঙ্গীতকার সাধক শিরোমনি শাহ আবদুল করিম। তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে তার জন্ম গ্রহণ করেন। সঙ্গীতজীবনের প্রথম দিকে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে মালজোড়া গান গেয়ে ফিরতেন। জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর গান গ্রামের সাধারণ থেকে শুরু করে শহুরে আধুনিক ও সাম্প্রতিক সঙ্গীতধারা ব্যান্ডসঙ্গীতের শিল্পীদেরও আকৃষ্ট করেছে এবং বহু শিল্পী তাঁর গান গেয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বহু জনপ্রিয় গানের বাণীর এই মহান রচক ও সুরস্রষ্টা শাহ আবদুল করিম-এর জীবন, সঙ্গীত ও সময় নিয়ে গত বছর আমি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাকুর মজিদ-এর জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্রের পাণ্ডুলিপি তৈরি করি (উল্লেখ্য, তার আগেই তিনি ভাটির পুরুষ নমে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন)। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমার সেই পাণ্ডুলিপিটি আজও চিত্রভাষ্য অর্জন করতে পারেনি। শাহ আবদুল করিমের দেহগত অনুপস্থিতির সুযোগে আমার পাণ্ডুলিপিটির প্রয়োজনীয় অংশের বর্ণনা (ধারাভাষ্য), সাক্ষাৎকার, গান ইত্যাদি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হলো।

ভাটির পুরুষের সূচনাকথা

দক্ষিণ এশিয়ার একটি নদীমাতৃক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বিশাল সমুদ্র উপকূলবর্তী এদেশের মানুষ প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তাঁরা নিজের দেশকে ধানের দেশ গানের দেশ ভেবেই আনন্দ খুঁজে ফেরে। তাঁদের গানপাগল কর্মনিষ্ঠ প্রাণশক্তির কাছে বারবার পরাস্ত হয় নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা-খরা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি, এমনকি বিচিত্র রাজনৈতিক সঙ্কটকেও তারা অতিক্রম করে যায় গানের বাণী ও সুরে। ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-বিরহ ইত্যাদি মানবিক জীবনাচারকে তারা মিশিয়ে দিতে জানে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পৌরাণিক চরিত্রের মানবীয় লীলার সঙ্গে।
—————————————————————–
নিজের এলাকার সাধক রাধারমণের গানের সঙ্গে নিজের গানের মিল-অমিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গানের সাথে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোট বেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্ব গান আছে, যা হিন্দু মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তবে, খুব গভীর তত্ত্ব নাই। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সবকিছু আছে।
—————————————————————-
আকাশ, মাটি, আলো, হাওয়া, জল সর্বোপরি প্রকৃতির আবেগ নিয়ে এদেশের মানুষ প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বাংলা গানের যে ঐতিহ্য প্রবহমাণ রেখেছিলেন তাঁদেরই একজন মহৎ হলেন ভাবসাধক শাহ আবদুল করিম। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে তার জন্ম।

তিনি শুধু নিজেই গান লেখেননি তাঁর জীবদ্দশাতে তাঁকে নিয়েও রচিত হয়েছে গান:

"যুগের বাউল আব্দুল করিম
জন্ম নিলেন উজানধল।
তোমার গানে কতজন পাগল…॥"

বৃহত্তর সিলেট জেলার অনেক শিল্পীই সুগভীর ভক্তিতে নিত্যই তাঁর নামে এ ধরনের বন্দনা গেয়ে ফেরেন।

তাৎক্ষণিক সঙ্গীত প্রতিভা ও মন্ত্রদাতা

বাংলাদেশের সঙ্গীতভুবনে একজন শাহ আবদুল করিম তাঁর জীবনকাহিনীতে, তাৎক্ষণিক সঙ্গীত রচনার প্রতিভায়, এমনকি ভক্তিবাদী দর্শন চর্চায় সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।

এক সাক্ষাৎকারে শাহ আবদুল করিমের শিষ্য বর্তমানে প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী রুহী ঠাকুর জানিয়েছিলেন: "বঙ্গবন্ধু একবার এসেছিলেন সুনামগঞ্জ… সেই সময় সুনামগঞ্জ সাবডিভিশন… আমার ওস্তাদ একটা গান পরিবেশন করেছিলেন… ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সম্পর্ক হলো… ঐ সময়ের পরিস্থিতির উপর ওস্তাদ একটা গান লিখেছিলেন… তো বঙ্গবন্ধু দেখলেন একজন বাউল মানুষ আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য একটা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেললো… বঙ্গবন্ধু ভাসানীর কাছে গল্প করেছিলেন, ভাসানী তখন তৎকালীন ডিসি সাহেবের কাছে লোক পাঠায়ে ওস্তাদরে নিয়ে গেছেন।"

শাহ আবদুল করিমের আরেক শিষ্য বলেছিলেন: "আমরা করিম সাহেব রে মুর্শিদ মানি… মুর্শিদ একজন শিক্ষক একজন মাষ্টার… ইহকাল পরকালের বিষয়ে উনি জানেন… আজানাকে জানেন অচেনাকে চিনেন তিনি… উনাকে মানি কারণ উনার থিয়রি মেনে চললে আল্লা রসুলের সান্নিধ্য লাভ করা যাবে এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু সৃষ্টি করা যাবে। উনি বলেছেন মওলা বক্স মুর্শিদ… মওলা বক্স দয়ার ঠাকুর… উনার কত জন শিষ্য জানি… আমি একদিন জানতে চেয়েছিলাম আপনার শিষ্য কতজন… উনি বলেছিলেন বাবারে আমি তো কানে কানে মন্ত্র দিই না আমার মন্ত্র হলো উড়াল্যা মন্ত্র। কতজন আমাকে জেনেছে কতজন আমাকে মেনেছে সে তো আমিও জানি না…।"

সঙ্গীতজীবনের স্বীকৃতি

আমাদের জানা মতে, বৃহত্তর গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সঙ্গীত সুধায় নিবিষ্ট তিনিই একমাত্র সঙ্গীতকার-সাধক যিনি সম্মানিত হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে একুশে পদক গ্রহণ করেন।

বর্তমানে তাঁর রচিত ও সুরাপিত গান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে, হাল আমলের জনপ্রিয় সঙ্গীতধারা ব্যাণ্ডসঙ্গীত শিল্পীদের কণ্ঠে, ইউরোপ থেকে সঙ্গীতশাস্ত্রে দীক্ষিত শিল্পীদের কণ্ঠে এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে ভারতে এবং যুক্তরাজ্যের বাঙালি সমাজে।

শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র এবং গ্রন্থ। শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে রচিত সকল গবেষণাপত্র ও গ্রন্থের অনিবার্য আশ্রয় কিন্তু তাঁর গান।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ

বাংলা গানের ধারায় শাহ আব্দুল করিম সংযোজন করেছেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই ধারায় তিনি গেয়েছেন, "আমি কূল হারা কলঙ্কিনী। আমারে কেউ ছুঁইও না সজনি…।" এ গানটিতে অপূর্বভাবে কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী শ্রীরাধার মর্মবেদনা সমকালীন হয়ে উঠছে। এভাবেই শাহ আবদুল করিমের এক একটি গানের বাণীতে এবং সুরের মোহনায় এক সঙ্গে এসে মেশে এদেশের সাম্প্রতিক সময় ও সহস্র বছরের লালিত প্রাণের ধারা।

কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে যথার্থই জানিয়েছিলেন, "তার গানগুলো শুনে… আমার মনে হয়েছে এই লোকটি প্রাচীন এবং বর্তমান এই দুইটির একটা মিশ্রণ… সুর তিনি ব্যবহার করেন সুরের বৈচিত্রটা খুবই চমৎকার ভাবে তার এখানে এসছে…।"

শাহ আবদুল করিমের বহু গানের একটি হলো, "আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভোমরা। কেমন ভুলিবো তারে বাঁচি না তারে ছাড়া…।" আসলে, শাহ আবদুল করিম তাঁর এই গানের সুর আর বাণীতে যেন কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে রাধার প্রেমলীলার কথাকে আধুনিক মানুষের মনের কথায় রূপান্তর করেছেন। লক্ষ করার বিষয়, শুধু পুরাণ প্রসঙ্গকে সমকালীন করে উপস্থাপন করেই শাহ আবদুল করিম তৃপ্ত থাকেননি। তিনি বাংলার চিরায়ত তত্ত্বগানকে নতুন মাত্রা প্রদান করেছেন। যেমন দেহতত্ত্বের গানকে তিনি উপস্থাপন করেছেন আধুনিক অনুষঙ্গ গাড়ির প্রতীকে। তিনি গেয়েছেন গান, "গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে…।" রুহী ঠাকুর শাহ আবদুল করিমের গুরুত্বপূর্ণ শিষ্যদের একজন। এই গানটি সম্পর্কে তিনি বলেন, "গাড়ি চলে না চলে না। এই দেহটাকে উনি একটা গাড়ির সাথে তুলনা করেছেন। 'চড়িয়া মানব গাড়ি যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি।' এই বন্ধুর বাড়ি বলতে উনি স্রষ্টা বা পরম-ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন।"

অসাম্প্রদায়িক সাধনা, দেহতত্ত্ব ও পীরভজনা

শাহ আবদুল করিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আস্থাশীল। তিনি তাঁর এবং তাঁদের বাল্যের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে বর্তমান কালের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দৃষ্টে ব্যথিত হয়েছেন। সে বেদনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাই গানের বাণীতে, 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।… গ্রামের নও-যোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম॥"

শাহ আবদুল করিম তাঁর সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, "প্রথম থেকেই আমার গানের প্রতি টান। হিন্দু মুসলমানের দেশ গানের একটা পরিবেশ ছিলো। দাদা সারিন্দা নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতো।

'ভাবিয়া দেখো মনে
মাটির সারিন্দা বাজায় কেমনে…॥"

এই গানটা একেবারে ছোটবেলাতে শাহ আবদুল করিমের মনে সুগভীর রেখাপাত করে। তারপর দিনে দিনে তিনি একসময় কেবল গানের সুর-বাণীতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। এ কথাটি তিনি তাঁর গানেই প্রকাশ করেছেন সুর-বাণীর যুগল সম্মিলনে, "আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।" তবে, একথাও ঠিক যে, শাহ আবদুল করিমের গান বিনোদনধর্মী কোনো গান নয়। তাঁর গানে বিভিন্ন তত্ত্বকথা ও জীবন দর্শন যেন একাকার হয়ে আছে। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণের প্রত্যাশায় একদিন তাঁর মুখোমুখি হলে তিনি বলেছিলেন, "দেহতত্ত্বের সাথে দেহ শব্দটি আছে। আর এই দেহ তো শরীর। এর মধ্যে কী কী বস্তু আছে। দেহের মধ্যে চক্ষু আছে, কর্ণ আছে… এ সমস্ত আর কি। আমি এসব বুঝি বলে, মানুষে আমাকে পীর বলে মানে। আসলে, দেহ সম্পর্কে যারা ভালো জানেন তাদেরকেই পীর বলা হয়। এই ধারায় আমার মুর্শিদের নাম মুওলা বক্স। মানুষের জীবনে পীরদের ভজতে হয়। আর পীর ভজলেই তত্ত্ব কথা পাওয়া যায়।"

সাধকের সঙ্গীত বিচার

শাহ আবদুল করিমের জন্মের মাত্র বছর দুই আগে দেহ রাখেন বাংলাদেশে সর্বাধিক সমাদ্রিত বাউল সাধক কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁই। এছাড়া, সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অন্যান্য সাধকগণ হলেন হাসন রাজা, শীতালং শাহ, রাধারমণ, দূরবীণ শাহ প্রমুখ। তাঁদের সবার গান ও জীবন দর্শনে শাহ আবদুল করিম স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। একই সঙ্গে সাধকদের ধারায় রচিত নিজের গানের বিশেষত্ব সম্পর্কেও তিনি একবার আমাদের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, আমি লালন ফকিরের গান শুনেছি, গেয়েছি, তাঁর গান মূলত তত্ত্বগান।

আর নিজের এলাকার সাধক রাধারমণের গানের সঙ্গে নিজের গানের মিল-অমিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গানের সাথে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোট বেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্ব গান আছে, যা হিন্দু মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তবে, খুব গভীর তত্ত্ব নাই। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সবকিছু আছে।

আসলে, শাহ আবদুল করিমের এই কথার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে বাংলার সহস্র বছরের জ্ঞানচেতনা, 'যা নেই দেহ-ভাণ্ডে তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে।' তিনি একই সঙ্গে ভক্তিবাদী এবং যুক্তবাদী। ভক্তিকে তিনি যুক্তির নিরিখে বিচার করে নিতেই পছন্দ করতেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ গান হয়ে উঠেছিল:

'দেখাও দাও না কথা কও না
আর কত থাকি দূরে।
মুর্শিদ শোনো হে কেমনে চিনি তোমারে।'

ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর সরল ও দৃঢ় যুক্তিবাদী উচ্চারণ ছিল, 'শুনি উনি আছেন। দেখি নাই তো কোনোদিন…।'

যুক্তিবাদী বিবেচনার ভেতর দিয়ে তিনি প্রকৃতিবাদী এবং সর্বপ্রাণবাদীর মতো কথা বলতেন। তিনি খুব সহজেই হাস্যচ্ছলে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন তাঁর আত্মগত চেতনার কথা, 'পরকাল সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নাই। মাটি মাটিতে মিশে যাবে…।'

জীবনবাদী এই সাধক শাহ আবদুল করিম বাংলার অন্যান্য সাধকদের থেকে ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি সাধনসঙ্গীতের পাশাপাশি রচনা করেছিলেন জনমানুষের অধিকার আদায়ের গান 'গণসঙ্গীত।' এ সম্পর্কে একবার শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রুহী ঠাকুর বলেছিলেন, 'শাহ আবদুল করিমের একটা দিক আছে উনি সাধারণ মানুষের জন্য গান লিখেছেন, গণসংগীত লিখেছেন যা অন্য বাউলদের মধ্যে পাওয়া যায় না… যেমন উনার বাল্যজীবনের একটা গান আছে এই গানের মধ্যে ঐ মানবতার কথাবার্তা আইছে, 'মনের দুঃখ কার কাছে জানাই মনে ভাবি তাই…।' 'কতকথা মনে পড়ে গ্রাম বাংলাই যা দেখেছি ঘরে ঘরে…।' 'গরীব বাঁচবে কেমন করে…।'

শুধু গ্রামের সাধকশিল্পীদের কাছে নয়, শাহ আবদুল করিমের এই গণচেতনা বাংলাদেশের শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীকে বলতে শুনি, 'ভাষা আন্দোলন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গান আছে। এদেশের বাউল সাধকদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম যে গণচেতনা প্রকাশ করেছেন তা সত্যি অন্যরকম একটা ঘটনা। এছাড়া, তাঁর প্রেমের গানগুলোও অকৃত্রিম। তা শহুরের আধুনিক শিল্পীদের অবলম্বন বা ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে দেখে আনন্দই লাগে।'

তরুণ প্রজন্মের অনুসৃত সঙ্গীতকার

গানের বাণীর সংকটে যখন বাংলাদেশের গান জনপ্রিয়তা হারাতে বসেছিল তখন তরুণ প্রজন্মের সঙ্গীতকার শিল্পীরা নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিয়েছেন শাহ আবদুল করিমের।

তাদেরই একজন হাবিব ওয়াহিদ। সঙ্গীতশাস্ত্রে ইউরোপী শিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে এসে তিনি শাহ আবদুল করিমের গান কণ্ঠে তুলে নেন। তাঁর গান সীমাহীন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হাবিব তাই শাহ আবদুল করিমের গানের বাণী ও সুরে একনিষ্ট ভক্ত হয়ে ওঠেন। শুধু হাবিব নন, তরুণ প্রজন্মের আরেকজন শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী শাহ আব্দুল করিমের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের কলকাতার সঙ্গীত শিল্পীদের কাছেও শাহ আবদুল করিম তাঁর গানের সুর ও বাণীতে সম্মানের স্থান অধিকার করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাই কমিশনার ছিলেন আনোয়ার চৌধুরী। তিনিও একদিন ঢাকা শেরাটন হোটেলের বলরুমে শাহ আব্দুল করিমের গান নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন।

সাধুরা মনে করেন, এ যুগের একজন সাধক কবি হিসেবে শাহ আবদুল করিম সর্বস্তরের মানুষের কাছে এই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন তাঁর সততার গুণে। রুহী ঠাকুর তাঁর ভাষ্য জানিয়েছিলেন, 'তাঁর (শাহ আবদুল করিম) সাথে পরিচয় তো আমার একেবারে বাল্য জীবন থেকেই… ঐ সময় থেকেই তার সাথে আমার চেনা জানা। বড় ভাই উনার বন্ধু… সেই হিসেবে খুব ছোট বেলা থেকে আমি উনার খুব কাছের মানুষ… উনি একজন শুদ্ধ মনের মানুষ… উনি সততারে খুব পছন্দ করেন। সৎ উপার্জনরে খুব পছন্দ করেন। নির্যাতন নিপীড়ন এই গুলোকে উনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন।'

ব্যক্তিগত জীবনকথা

ব্যক্তিগত জীবনে শাহ আবদুল করিম ছিলেন অত্যন্ত অনুভূতিশীল একজন মানুষ। সংসার জীবনে তিনি স্ত্রীর প্রতিই বেশি আসক্ত ছিলেন। বলা চলে তাঁর পত্মীপ্রেম ছিল অন্তহীন। সে কথার প্রমাণ আছে তাঁরই রচিত গানে, 'সরল তুমি নাম তোমার সরলা।' অকালে দেহত্যাগী পত্মীর কথা মনে হলে তিনি দিব্যমান হয়ে উঠতেন, আর পরক্ষণেই বিরহ-বেদনা অশ্র" ফেলতেন এবং বলতেন, 'তাঁর (স্ত্রী) বাবা-মায়ে নাম রাখছিল বৈশাখী। আমি নাম রাখছি সরলা।… সে যদিও লেখাপড়া জানত না। তবু এমন একটা মানুষ আছিলা। তারে ধইরা রাখতে পারলাম না।…'

নিজের স্ত্রী সরলার স্মৃতিচারণে তিনি গান বেঁধেছিলেন, 'কে পীরিতি বানালে ছেড়ে যাবে যদি।/ও আমি মরণ জ্বালা সইতে না পারি ॥'

ব্যক্তিগত জীবনকথার কোনো কিছুই শাহ আবদুল করিম প্রকাশ করতে বাকি রাখেননি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক গীতিকবিতার ভেতর দিয়ে নিজের জন্ম, বেড়ে ওঠা, সঙ্গীত চর্চা এবং যুক্তিবাদী উদার নৈতিক দর্শন প্রচারের প্রতি গোঁড়া মোল্লাদের প্রতিরোধের কথা তুলে ধরেছেন। যেমন, তাঁর আত্মজীবনীমূলক একটি কাব্যাখ্যান হলো, 'মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।' সেই কাব্যাখ্যানে তিনি তাঁর জীবনে পূর্বাপর সব ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

জীবনের কোনো প্রতিরোধই শাহ আবদুল করিমকে রুখতে পারেনি। বরং তিনি সুগভীর একাগ্রতা, নীতিনিষ্ঠ সত্যাচার ও নিরন্তর সঙ্গীতসাধনার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার মানুষের কাছে ভাটি অঞ্চলের বাউলসম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। রচনা করেছেন বিচিত্র ধারার গান। যা গ্রন্থাকারে ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর ঢেউ, গণসঙ্গীত ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হয়েছে।

শাহ আবদুল করিম ভাবসাধকদেরকে ধারায় গান রচনা করলেও তাঁর গানের সঙ্গে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে আছে ভাটি অঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি-নদী, উৎসব-মেলা ইত্যাদি।

অবশ্য এ পরিচয় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের শিরোনাম হতেও টের পাওয়া যায়। যেমন, বাড়ির পাশ দিয়ে বেয়ে যাওয়া নদীর নামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই কালনীর ঢেউ, নিজের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলার নামে বই প্রকাশ করেছেন। ভাটি অঞ্চলের প্রেমে বইয়ের নামকরণ করেছেন 'ভাটির চিঠি', এমনকি স্ত্রীর নাম শরণে প্রকাশ করেছেন আফতাব সঙ্গীত

একজন সাধকের পথ ধরে হেঁটে চলে উত্তরাধিকার। বর্তমানে শাহ আবদুল করিমের উত্তরাধিকার হলেন তাঁর আত্মজ সঙ্গীতকার নূর জালাল। সম্প্রতি নূর জালালের গানও সমাদৃত হতে চলেছে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখানকার সঙ্গীত দল দোহার মঞ্চে উপস্থাপন করেছে শাহ আবদুল করিমের উত্তরাধিকার নূর জালালের গান। আমাদের বিশ্বাস, ভাবসাধক শাহ আবদুল করিমের আলোকবর্তিকা বহন করে চলবেন নূর জালালের মতো আরো অনেকেই।

শেষকথা

অনতিদূর হিমালয় থেকে নেমে আসা জলরাশি বাংলাদেশের ভূভাগের উপর দিয়ে সহস্র নদীর ধারায় ভাটির পথ বেয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে। বাংলাদেশ তাই ভাটির দেশ।

এই ভাটির দেশের আরেক ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ জেলা। এ জেলার দিরাই থানার উজানধল গ্রামে শাহ আবদুল করিমের বাড়ির দক্ষিণ পাশ দিয়ে বেয়ে গেছে এই নদী, এর নাম কালনী।

বর্ষা এলে তো বটেই এমনকি বছরের অধিকাংশ সময়েও নৌকা ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের চলাচলের কোনো উপায় থাকে না।

শাহ আবদুল করিমের গানে তাই এই নৌকার প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে আসে। কখনো তা দেহ নৌকার অনুষঙ্গে, আবার কখনো তা জীবন নদী পাড়ি দেবার সীমাহীন প্রেরণা খোঁজার আনন্দে। তাঁর গানে আছে, 'কোন মিস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়।'

ভাটি অঞ্চলের দৃশ্যরূপের সঙ্গে যেমন অনিবার্য হয়েছে নদী ও নৌকা তেমনি যুগ যুগ ধরে অনিবার্য হয়ে থাকবেন ভাটির পুরুষ শাহ আবদুল করিম। কেননা, ভাটি অঞ্চলের জনজীবনকে তিনি যেভাবে তাঁর গানে স্থান দিয়েছেন, বাণী ও সুরের মোহে নবরূপে চিত্রিত করেছেন তা থেকে সমগ্র ভাটি অঞ্চল কোনোদিনই হয়তো বেরিয়ে আসতে পারবে না। জয়তু ভাটির পুরুষ।

saymon_zakaria@yahoo.com
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: সাইমন জাকারিয়া