নতুন পথে ব্রিটেনের রক্ষণশীল সরকার

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 3 August 2011, 06:34 AM
Updated : 10 August 2015, 07:42 AM

ব্রিটেনের ৫৬তম সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ তথা রক্ষণশীলদের অভাবনীয় বিজয়ের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেন শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না সে সংশয় দেখা দিয়েছে। সে সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন সেবা খাতে বর্তমানে যেসব বরাদ্দ রয়েছে তার বেশকিছু কাটছাঁটের সাম্প্রতিক প্রস্তাব নিয়েও জনমনে কাজ করছে অনিশ্চয়তা। আলোচনা চলছে, এতদিন কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের যে ইমেজ, তাতে ছেদ পড়বে কিনা।

৭ মে, ২০১৫ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর লেবার পার্টি, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল এবং বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। মানবাধিকার, অভিবাসন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার উদার নীতি থেকে সরে আসার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে পুননির্বাচিত ডেভিড ক্যামেরন সরকার।

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরা রক্ষণশীল সরকারের প্রথম বছরেই এসব বিষয়ে পরিবর্তিত নীতির প্রতিফলন ঘটবে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের থাকা না-থাকা প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের বিলও আনতে যাচ্ছে সরকার।

নতুন পার্লামেন্টের উদ্বোধন উপলক্ষে রানির দেওয়া প্রথাগত ভাষণেই অবশ্য ক্যামেরন সরকারের এসব কর্মসূচি উঠে এসেছিল। রীতি অনুযায়ী সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এমপিদের সামনে পাঠ করেন। ভাষণে সরকারের অর্থনৈতিক ও আইনগত মোট ২৬টি কর্মসূচি তুলে ধরা হয়। বিরোধীরা সরকারের এসব নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যুক্তরাজ্যের নেতৃত্ব এর ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

অবৈধ অভিবাসী ও বিদেশি সন্ত্রাসীদের যুক্তরাজ্য থেকে বিতাড়ন সহজ করতে নতুন অভিবাসন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি বিদ্যমান মানবাধিকার আইন বিলুপ্ত করবে ক্যামেরন সরকার। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আদালতের দেওয়া রায় ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালতে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকায় অভিবাসন-সংক্রান্ত অনেক সরকারি সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যায় না। আইনগত এই বাধা দূর করতে ব্রিটেনের নতুন সরকার নিজস্ব মানবাধিকার বিল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, যা ইউরোপিয়ান মানবাধিকারের আইনের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের আয় জব্দ করার পাশাপাশি তাদের কোনো ধরনের আইনি সুযোগ না দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর বিধান রাখা হয়েছে নতুন অভিবাসন আইনে।

ধর্মীয় উগ্রবাদ গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম সমস্যা। এটি দমনে সরকার যে আইনের প্রস্তাব করেছে তাতে ব্রিটিশ মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে আদর্শিকভাবে সাংঘর্ষিক এমন বক্তব্য ও বিবৃতি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। উগ্রবাদ ছড়ায় এমন স্থাপনাগুলোও বন্ধ করে দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এমন সন্দেহ হলে মসজিদ ও উপাসনাগুলোও বন্ধ করে দিতে পারবে সরকার। এ লক্ষ্যে পুলিশ, বিচার ও যোগাযোগে আড়িপাতা-সংক্রান্ত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবে সরকার।

রক্ষণশীল সরকার শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলন দমনেও নতুন বিল আনবে বলে জানিয়েছে। নতুন বিলে বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ সদস্য অনুমোদন না করলে আন্দোলনে যেতে পারবে না সংগঠনগুলো। বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় সরকারি কল্যাণ ব্যয়ের সংস্কার ও কৃচ্ছসাধন অব্যাহত রাখা হবে। কর্মজীবী মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার অবশ্য রয়েছে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করা, ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার ওপর চাপ অব্যাহত রাখা এবং সিরিয়া, ইরাকসহ বিশ্বে উগ্রবাদ দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা রয়েছে।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ক্যামেরন সরকার ইইউর প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তিতে বদল আনতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। পাশাপাশি দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় সনদের প্রভাব কমাতে বিদ্যমান মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট আইনগুলোও ঢেলে সাজাতে চায় কনজারভেটিভ পার্টি। প্রস্তাবিত এ আইন নিয়েও তীব্র আপত্তি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের থাকা না-থাকা নিয়ে ২০১৭ সালের মধ্যে গণভোট আয়োজনের লক্ষ্যে বিল উত্থাপন করা হয়েছে। ইইউভুক্ত দেশের অভিবাসীরা ওতে ভোট দিতে পারবেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, প্রতিবেশি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্য সামনে রেখে। ইউরোপীয় অঞ্চলে জাতিগুলোর মধ্যে অবাধ চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যও ছিল উদ্যোক্তাদের আরেকটি পরিকল্পনা। প্রথমে ১৯৫০ এবং এর কিছুটা পরে, ১৯৫৭ সালে প্রণীত রোম চুক্তির অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয়, 'ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি', ইইসি।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেন্দ্র করে ঘোষিত হয় মাসট্রিক্ট ট্রিটি এবং ১৯৯৯ সালে আমস্টারডাম ট্রিটি। এসব ট্রিটির মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।

এখন সে ইউনিয়নই আবার এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে সংস্কারের প্রশ্নে। স্যার উইনস্টন চার্চিল ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের সূচনালগ্নের একজন উদ্যোক্তা। তাঁর উত্তরসূরী ক্যামেরনের হাতেই সেই ইউনিয়নের কাঠামো হুমকির মুখে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তিতে সংশোধনী আনার কথা। লন্ডনের সঙ্গে বাস্তবসম্মত চুক্তি করা হলেই কেবল ব্রিটিশদের এই জোটে থেকে যেতে রাজি করানো যাবে বলে তিনি জানান। ইইউতে সংস্কার আনার জন্য সদস্য দেশগুলোকে চাপ দিতে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সফরে বেরোনোর প্রেক্ষাপটে হ্যামন্ড এ মন্তব্য করেন। যুক্তরাজ্যের ইইউর সদস্য থাকা না-থাকা প্রশ্নে একটি গণভোটের আগে ওই সফরে বেরিয়েছিলেন ক্যামেরন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যামন্ড বিবিসি রেডিওকে ঠিক এভাবেই বলেছেন, ''অংশীদাররা যদি আমাদের সঙ্গে একমতই না হয়, যদি ওই সমঝোতায় পৌঁছুতে আমাদের সঙ্গে না-ই কাজ করে, তাহলে কোনো সম্ভাবনাই আমরা উড়িয়ে দেব না।… আমরা যে উপদেশ পাচ্ছি সেটা হল, আমাদের এ সংক্রান্ত চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে।''

সদ্য অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রচারণার সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচনে আবার জয়ী হলে ইইউতে থাকা না-থাকা প্রশ্নে ভোটারদের মতামত জানতে ২০১৭ সালের মধ্যে গণভোটের আয়োজন করবেন। তবে গণভোটের আগে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক ঢেলে সাজানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ক্যামেরন সরকার।

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল মনে করনে যে, যুক্তরাজ্যকে জোটে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তিতে পরিবর্তন আনতে হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তা করতে হতে পারে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইায়শকা ফিশার সংস্কারের ব্যাপারে জার্মানির সমর্থনে বিষয়টিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে 'বেশি আত্মবিশ্বাসী না হতে' বলার পরপরই এ কথা বললেন ম্যার্কেল। বিবিসিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আশাবাদী যে, যুক্তরাজ্যকে ইইউ জোটে রাখার মতো পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে তিনি খুব বেশি উদ্বেগে নেই। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী এই নেতা আরও বলেন, ''আমি আশাবাদী যে আমরা সবাই চাইলে একটি ভালো সমাধান মিলবে।''

ইইউর প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তিতে পরিবর্তন আনার বিষয়টি জোটে একটি স্পর্শকাতর ও জটিল ইস্যু। ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

নির্বাচনে বিপর্যয় এবং দলনেতা এড মিলিব্যান্ডের পদত্যাগের পর লেবার দলটি যখন নতুন করে দল গোছাতে কাজ শুরু করেছে, ঠিক তখনই রক্ষণশীল দলের সামনে দেখা দিয়েছে দুটি পুরনো সমস্যা, অত্যন্ত জটিলভাবে। তার একটি হচ্ছে, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়াসহ পূর্ব ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটেনে বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর আগমন এবং অন্যটি হচ্ছে, এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের জরুরি সংস্কারের বিষয়টি।

এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের বেশ কিছু মন্ত্রী এবং নেতা-নেত্রীর যথেষ্ট চাপ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। ব্রিটেনের নিজস্ব আইন, সংসদ, মুদ্রাব্যবস্থা, ঐতিহ্য এবং এমনকি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার স্বার্থে তাদের অনেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষপাতি।

অন্যদিকে, লন্ডন ও ব্রিটিশ চেম্বারের ব্যবসায়ী নেতারা ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার যে দাবি উঠেছে তার পুরোপুরি বিরুদ্ধে। তাঁরা মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা কমন মার্কেট ব্রিটেনের জন্য একটি বিরাট বাজার। কোনো অবস্থাতেই তা ত্যাগ করা যাবে না। নীতিগতভাবে, বিরোধী দল, লেবার পার্টিরও সিদ্ধান্ত বা মত এটিই।

এদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ক্যামেরন ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন (ইউসিএইচআর) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, ''একটি বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। আমরা চাই ব্রিটিশ আদালতগুলোতে সিদ্ধান্ত নেবেন ব্রিটিশ বিচারকেরাই।''

এ বিষয়ে তাঁর যুক্তি হল, বারবার অপরাধ করলেও অনেককে যুক্তরাজ্য থেকে বিতাড়ন করা যাচ্ছে না। কারণ, তারা এ ক্ষেত্রে ইউসিএইচআরের প্রদত্ত 'পরিবারের সঙ্গে বসবাসের অধিকারটি' ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

ক্যামেরন সরকারের এসব পদক্ষেপের গ্রহণের ইঙ্গিতের মধ্যে, কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা লেবার পার্টির অবস্থা বেশ নাজুক। তারা ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবেই সব সময় দেখতে চায়। তাই ক্যামেরন সরকার সব পক্ষকে খুশি করে কীভাবে দলের ঘোষিত লক্ষ্যগুলো পূরণ করবে তাই দেখার বিষয়।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।