জন্ডিসে আক্রান্ত বাংলাদেশে অনুভূতির রাজনীতি  

বিজন সরকার
Published : 6 Sept 2011, 02:31 AM
Updated : 16 May 2016, 12:27 PM

মানবদেহের রক্তে বিলুরোবিনের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি থাকার নাম 'জন্ডিস'। বিলুরোবিন হচ্ছে রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিনে অবস্থিত হলুদ জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। হিমোগ্লোবিনের কাজ হচ্ছে লোহিত রক্ত কণিকায় অক্সিজেন সরবরাহ করা। জন্ডিসের ফলে লোহিত রক্ত কণিকাগুলি ভেঙে পড়ে। নতুন নতুন রক্ত কণিকা ভেঙে পড়া লোহিত রক্ত কণিকার ঘাটতি পূরণ করে। যকৃত ওই ভেঙে পড়া কণিকাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তা করতে ব্যর্থ হলেই বিলুরোবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে মানবদেহের ত্বকে হলুদ রং দেখা দেয়। এই হলুদ রং মানবশরীরের জন্য ভয়ানক ক্ষতির সংকেত বহন করে।

মানবদেহের মতো বাংলাদেশের শরীরেও বিলুরোবিনের পরিমাণ বেড়ে চলছে। এই ভয়ানক বিলুরোবিন এখন প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ফলে সর্বত্র দেখা দিয়েছে জন্ডিস। লাল সবুজের বাংলাদেশ দ্রুতই হলুদ হয়ে উঠছে। ভিন্ন মতাদর্শ ও চিন্তা না মেনে নেওয়ার আরবীয় সংস্কৃতির ছোবলে দেশ বহুলাংশে আক্রান্ত। নতুন আরবীয় জাতীয়তাবাদকে সমাজের স্তরে স্তরে কৌশলে সুনিপুণভাবে সন্নিবেশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিজস্বতার প্রতি অবহেলার প্রবণতা সমাজের একটি বড় অংশে দেখা দিয়েছে।

আমরা এখানে বাংলাদেশি বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আগ্রাসী আরবীয় জাতীয়তাবাদকে যথাক্রমে মানবশরীরের লোহিত রক্ত কণিকা এবং নতুন রক্ত কণিকার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নিজস্ব মৌলিক অঙ্গগুলিও আরবীয় জাতীয়তাবাদের নীরব প্রসার মোকাবেলা করতে পারছে না। এই নীরব প্রসারের পিছনের অন্যতম কারণ দুটি। প্রথমটি হল, রাষ্ট্রের নীতিগত ব্যর্থতা। আর দ্বিতীয়টি হল, ক্ষমতার অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। সমাজে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি রাষ্ট্রের নীতিগত ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য প্রি–কার্সর হিসেবে মূল ভূমিকা পালন করছে।

আরবীয় সংস্কৃতির নিউক্লিয়াসে ধর্মীয় উগ্রবাদ হাজার বছর ধরেই নানান ফর্মে শক্তিশালী। গত কয়েক দশক ধরে ওয়াহাবিজম ও সালাফিজম নতুন ফর্মে ধর্মীয় উগ্রবাদকে রাজনৈতিক ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। উনিশশ নব্বই সালের তুলনায় বিশ্বব্যাপী ওয়াহাবিজম ও সালাফিজম নামের উগ্র গোষ্ঠীগুলোর সংখ্যা পঞ্চাশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

উগ্র ধর্মীয় আদর্শটি একটি নরমপন্থী মুসলিমপ্রধান সমাজকে নানান কৌশলে ধর্মীয়ভাবে উগ্র করে তুলে। প্রথম ধাপ হল, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এবং দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। এ ধাপে সফলতা এলে দ্বিতীয় ধাপে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সাংঘর্ষিক করে তোলা হয়। এরপর তৃতীয় ধাপ।

এই পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে গোত্রভিত্তিক সংঘাত তৈরি করা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের মতো বহু মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর কথা বলতে পারি। ঠিক এই ফরম্যাটটি পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রগুলির অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে, নিরাপত্তার সূচকে দেশগুলি নিচের দিকে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় উল্লিখিত দেশগুলির বেশ কটি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ এখন নানান রূপে প্রসারিত হচ্ছে। ২০০১-২০০৬ সালের দৃশ্যমান (ভায়োলেন্ট) ধর্মীয় জঙ্গিবাদের চেয়ে বর্তমান সময়ের অদৃশ্যমান (নন-ভায়োলেন্ট) ধর্মীয় উগ্রবাদ হাজার গুণে ভয়ানক। এটির কুপ্রভাব বহুমাত্রিক। এটি দেশের চলমান অর্থনীতিকে অক্টোপাসের মতো চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরবে। রাষ্ট্রকে এই অদৃশ্যমান (নন-ভায়োলেন্ট) ধর্মীয় উগ্রবাদকে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে মোকাবেলা করার কথা ছিল। এই কাজটি করতে পারত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু আমাদের লোভ, লালসা, আপোষকামিতা, রাজনৈতিক আদর্শের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাবে আমরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রহর গুনছি।

কিছু দিন আগে পুলিশ প্রশাসন সকল ধর্মের নেতাদের নিয়ে একটি সভা করে। এটি ব্যতীত তেমন কোনো মৌলিক ও ফলদায়ক পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উগ্রবাদ মোকাবেলার জন্য যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মূল ভূমিকা পালন করার কথা, সেখানে যখন পুলিশ প্রশাসনকে মূল ভূমিকায় দেখা যায় তখন বুঝতে হবে যে, আমরা ভুল পথে রয়েছি। এখনও আমরা জানি না একটি উগ্রবাদ আদর্শ– যা জন্ডিসের মতো দেশের লাল সবুজকে হলুদ করে তুলছে– সেটা কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়।

ইংরেজি সাহিত্যে অনেক বিখ্যাত কবি জন্ডিসকে ঋণাত্নক প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। জন্ডিস আমাদের শরীর বিবর্ণ করে তুলে, বিষয়টি কেবল তা নয়। এটি আমাদের চলন-ক্ষমতাও হ্রাস করে। অধিকন্তু, জন্ডিস আমাদের স্বপ্নও নানাভাবে দূষিত করে। নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য আমাদের কর্মপন্থা অবলম্বন প্রক্রিয়ায় জন্ডিস বাধা দেয়। জন্ডিস শারীরিক অক্ষমতা কিংবা স্থায়ী পঙ্গুত্বের চেয়েও বিষাক্ত। কারণ এটি আমাদের মানসিক শক্তির কাঠামো দুর্বল করে দেয়। জন্ডিসে একবার আক্রান্ত হওয়ার পর যদি কোনো সফলতা আসেই, সেই সফলতায় জীবাণুটি থেকে যায়।

কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ একটি দ্রুতগতির অর্থনীতির দেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত বছরগুলিতে বহুমাত্রিক অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। অনেক মেগা-প্রকল্প চলমান অবস্থায় রয়েছে। তা সত্বেও বাংলাদেশের একমাত্র না হলেও প্রধান দুটি সমস্যার একটি হল ধর্মীয় উগ্রবাদ। প্রসঙ্গত, আরেকটি হল দুর্নীতি। আধুনিক শাসন ব্যবস্থায়, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমরা অর্থনীতির যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বপ্ন নির্ধারণ করছি, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ধর্মীয় উগ্রবাদ অন্যতম প্রতিবন্ধক। এই উগ্রবাদ আমাদের স্বপ্ন পূরণের মানসিক শক্তি দুর্বল করে দিচ্ছে।

আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে, ধর্মীয় উগ্রবাদ জিইয়ে রেখে নির্ধারিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এটা অনুধাবনযোগ্য যে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং নীরব উগ্রবাদ জন্ডিসের ন্যায় সমাজ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভিতরেই এই দুটি পরিবর্তন বেশি ঘটছে। মধ্যবিত্ত সমাজের এই পরিবর্তন দেশের সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ আদর্শিক গন্তব্যের ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দেয়। এটি একটি নীরব রেনেসাঁ। আমরা অন্ধ হয়ে থাকতে পারি, তাই বলে প্রলয় বন্ধ থাকবে কি?

ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীর প্রভাবে অর্থনীতি কেমন হয় তা ভালো করে বোঝার জন্য দুটি দেশের উদাহরণ দিই।

মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার অর্থনীতির চাকা খুব সচল ছিল। বর্তমানে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি একটা জায়গায় থেমে রয়েছে। দেশটির সামনে ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে সৃষ্ট ধর্মীয় জঙ্গিবাদ অভ্যন্তরীন নিরাপত্তায় বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশটির পর্যটন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার আইএসপন্থী ধর্মীয় জঙ্গি দেশটিতে রয়েছে। তাই অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে অতিথি শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রেও বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের।

আরেকটি দেশ হল তিউনিসিয়া। তিউনিসিয়ার অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী ছিল। ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীর নীল বিষে তিউনিসিয়ার প্রাণ প্রায় শেষের দিকে। পর্যটননির্ভর দেশটির অর্থনীতি একেবারেই থেমে গেছে। এই শিল্পে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। সমুদ্রতীরগুলি শ্মশানের মতো খা খা করছে। পর্যটকরা এই সব দেশে না গিয়ে এখন দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদ একটি সমাজকে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে দরিদ্র করে রাখে। এটি বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পর্যটন-সম্ভাবনাময় খাত থাকা সত্বেও আমরা এসবের সুবিধা কাজে লাগাতে পারছি না। এর পিছনের কারণটি সহজেই অনুমেয়। এক কক্সবাজার দিয়েই প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন পর্যটক বাংলাদেশে আনা যেত। অথচ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রতীরটি আজ অব্দি বিদেশি পর্যটক টানতে পারেনি– এখনও এটি স্থানীয় পর্যটক-নির্ভর। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর রাশিয়া থেকেই ত্রিশ লক্ষ পর্যটক তুরস্কে যেত। রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্ক শীতল হওয়ায় তুরস্কের পর্যটন শিল্প ইতোমধ্যে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।

তাছাড়া আমাদের রয়েছে প্রকৃতির গর্ব সুন্দরবন। সমুদ্রঘেঁষা এমন বিশাল বনভূমি পাওয়ার মতো ভাগ্যবান জাতির সংখ্যা খুবই কম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে এই মহামূল্যবান সুন্দরবন যেভাবে অবদান রাখার কথা, তা পারছে না। অধিকন্তু, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা।

দেশের বড় দুটি উৎসব দিয়েও হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক দেশে আনা যেত। এর একটি হচ্ছে একুশের বই মেলা। জার্মানির হামবুর্গ ছাড়া এত বড় বই মেলা মানববসতির এই গ্রহের অন্য কোনো জায়গায় হয় কি না জানা নেই। আমরা তা-ও পারিনি। গত দুবছরে সেই সম্ভাবনা ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী চাপাতি দিয়ে কতল করেছে। বিদেশিরা কেন, বই মেলার প্রকাশকেরাই বই প্রকাশ করতে ভয় পান।

শিক্ষা ক্ষেত্রে ধর্মীয় উন্মাদনার বিষাক্ত প্রভাব কীভাবে একটি জাতিতে রুগ্ন করে রাখে, তা বুঝতে হলে আমাদেরকে পাকিস্তানের পেশোয়ারের দিকে তাকাতে হবে। এই প্রদেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চল্লিশ শতাংশ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। কেবল ধর্মীয় স্কুলগুলি চালু রয়েছে। জঙ্গিদের হামলার ভয়ে পাকিস্তানে প্রায় আড়াই হাজার মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সমগ্র আরব দুনিয়াতে গত এক হাজার বছরে যত বই অনুবাদ করা হয়েছে, এক স্পেনেই এক বছরে সেই সংখ্যক বই অনুবাদ করা হয়েছে। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, তাহলে আরব বিশ্বের দেশগুলি এত সম্পদশালী কেন? আমরা যদি সেই দেশগুলির জিডিপি থেকে তেলের অবদান বাদ দিই, দু-তিনটি দেশ ছাড়া প্রত্যেকটি দেশের অবস্থা বর্তমান সুদানের চেয়েও খারাপ হওয়ার কথা।

জন্ডিস আমাদের চিন্তার জগতেও একটি অভ্যন্তরীন সংঘাত তৈরি করে। এটি দ্রুত একজনের কাজ থেকে অন্য জনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। নির্ধারিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগে এই সংঘাতের সমাধান খুবই অনস্বীকার্য। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে এটির সঙ্গে লাঠিসোটা নিয়ে সংগ্রাম করা মানেই হচ্ছে আত্মহননমনস্ক হয়ে ওঠা। এতে গৃহীত স্বপ্নটির অভ্যন্তরীন স্নায়ু-কাঠামোতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হবে। ভবিষ্যতে কেবল কষ্টই বাড়বে। জন্ডিসটিকে কৌশলে সরাতে হবে এবং এটি সম্ভব একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। কেবল তখনই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

জন্ডিসে আক্রান্ত সমাজে বসবাসকারীরাও জন্ডিসের কবলে পড়ে। রাষ্ট্রের মতো তারাও জন্ডিসের কারণে নানান উপসর্গে ভোগে। মানসিক শক্তি ও চিন্তা-চেতনায় দেখা দেয় অবশতা। রাষ্ট্রের স্বপ্নের মতোই রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের স্বপ্নও বিবর্ণ করে তুলে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হলুদ-ভীতি দেখা দেয়। সব কিছুতেই হলুদ দেখতে পায়। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্রিটিশ ধর্ম-চিন্তক এবং যুক্তিবাদী আইজ্যাক ওয়াটসের একটি উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক।

The eyes of a man in the jaundice make yellow observations on everything; and the soul tinctured with any passion diffuses a false color over the appearance of things.

জন্ডিসে আক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ এখন অনুভূতির জ্বরে ভুগছে। কখন কার অনুভূতিতে কীভাবে আঘাত লাগে বলা মুশকিল। রাষ্ট্রও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সেই অনুভূতি রক্ষা করতে সদাপ্রস্তুত। কিছু দিন আগে দুজন শিক্ষককে অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ছমাস সাজা দেওয়া হল। অথচ জানা গেল না, উনারা কী বলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিলেন।

অপরপক্ষে, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক অধ্যাপককে হত্যার জন্য আহ্বান করা একটি ফেসবুক পোস্টে হাজার হাজার কথিত অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্তরা হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করছে। ছয় হাজারের অধিক সেই পোস্ট শেয়ার হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, অভিযুক্ত অধ্যাপকের অনুভূতিতে আঘাত লাগার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রও এই ধরনের কম সংবেদনশীল অনুভূতির আঘাতের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত নয়।

ফলে অনুভূতি-ভীতিতে এখন অনেকেই আতঙ্কিত। অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি এতই খেলো যে, আপনি স্বাভাবিক মাত্রার বেশি জোরে হাঁচি দিলেও কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। অনুভূতির অভিযোগে রাষ্ট্রের তালিকায় না থাকলেই রাজনৈতিক রিজার্ভ ফাঁসের তালিকায় থাকতে পারেন। এরা বিনা বিচারে মধ্যযুগীয় কায়দায় আপনাকে শাস্তি দিবে।

নব্য এই জ্বরে সাধারণ মানুষ কতটুকু আতঙ্কিত, একটি উদাহরণ দিলেই ভালো করে বুঝা যাবে।

আমার এক পরিচিত যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বাথ থেকে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির উপর পিএইচডি শেষ করে সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রভাষক হিসেবে যোগদান করতে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উনি বেশ সরব। বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন যাবত ফেসবুকে স্যাম্পল করে যাচ্ছেন। উনি বাম ঘরানার মানুষ।

দেশে উনার মা অসুস্থ। অপারেশন হবে। দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কতলের ঝুঁকি নিয়ে দেশে যাননি। নির্ধারিত তারিখেই উনার মায়ের অপারেশন হল। আইসিইউ থেকে কেবিনে যাওয়া সময় শুনতে পেলেন অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হল। রেজাউল সেতারা বাজাতেন। ধারণা করা হচ্ছিল, সেতার-অনুভূতিতে আঘাতের জন্যই রেজাউলকে চাপাতি দিয়ে কতল করা হল।

আমার পরিচিত মানুষটিও বেহালা বাজান। বেহালা বাজাচ্ছেন এমন একটি ছবি আমার পরিচিত মানুষটি ফেসবুকের কভার পিকচার করেছেন। তাঁর ছবির পাশে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ছবি। আইনস্টাইনও বেহালা বাজাচ্ছেন এমন একটি ছবি।

কেবিন যাওয়ার সময় উনার মা পাশে উপস্থিতি উনার অন্যান্য সন্তানদের বলছেন, "ওকে এখুনি ফোন কর। বলে দে, ও যেন আর কোনো দিন বেহালা না বাজায়। ওরা ওকে মেরে ফেলবে!"

অসুস্থ মায়ের সংশয়টি অমূলক নয়। উনি বাংলাদেশ নাগরিক এবং দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহারকারী বেহালা বাজানো ছবি ফেসবুকে কভার পিক করার কারণে কারও না কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। অধ্যাপক রেজাউল করীম গ্রামের বাড়িতে সঙ্গীত বিদ্যালয় করায় যেমন কারও না কারও অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, ঠিক একইভাবে উনার বেহালা বাজানো ছবির ফলেও কেউ না কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন। ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে।

অধিকন্তু, রাষ্ট্রের ধর্ম আছে। ফলে রাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ধর্মের অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে হত্যা করলেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

ধর্মানুভূতি নামক মহাকাশযানটি ভীষণ বেগে আমাদের দিকে মধ্যযুগ থেকে ফিরে আসছে। আমরা ক্রমশই  মহাকাশযানটির ভয়ানক বেগের কারণে বাতাসে ধূলিকণার মতো পিছনে ছুটছি।

এ অবস্থায় জন্ডিসে আক্রান্ত বাংলাদেশকে চিকিৎসার জন্য কোন ব্যবস্থার শরণাপন্ন হওয়া উচিত, এমন একটি জিজ্ঞাসা সাধারণ প্রশ্ন হয়ে ওঠা আবশ্যক।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে না কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে?