কে করবে পাকসেনাদের বিচার

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 Sept 2011, 03:12 AM
Updated : 7 May 2016, 04:50 AM

সঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারি না অামরা। এ এক নিয়তি। এখন অার যাই হোক, মুখ দেখছে বাংলাদেশ। কিন্তু শান্তি নেই। যত উন্নয়ন, যত অগ্রযাত্রা, ততোধিক ষড়যন্ত্র। মুসলিম লীগের নয়া সংস্করণ বিএনপি অার মৌলবাদীরা কী পরিমাণ ভয়াবহ ও দেশবিরোধী হতে পারে তার নমুনা দেখছি। অাওয়ামী লীগও তথৈবচ। বাহাত্তরে তারা নতুন দেশে নতুন সরকারের কারণে ষড়যন্ত্র রুখতে পারেনি, কিন্তু এখন? এখন তো পরিবেশ অারও ভয়াবহ।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যে মেধাবী পরিণত বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীরা পথ দেখাতেন তাঁরা হয় নীরব নয়তো পথহারা। তাঁরা ঠিক কাজ করলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি মৌলবাদ ও চাপাতি-বিরোধী জাগরণপর্ব গড়ে উঠত। রাজনীতিকে নিয়ন্তা না মানা সংস্কৃতির জায়গাটাও এখন ভেতরে পচে গেছে।

শহীদ মিনারে এসে দাঁড়ানো মানববন্ধনে হাত ধরা মানুষটির বাড়িতে প্রগতির কোনো চিহ্ন নেই। এদের বাড়িতে বাড়িতে জামায়াতি ওয়াজের ক্যাসেট। ঘরে ঘরে খালেদা জিয়ার জয়জয়কার। অাওয়ামী লীগের সজীব জয় এদের মুখে। অন্তরে অাপাত নির্জীব তারেক জিয়ার জন্য অপেক্ষা। অামি বলব, জামায়াত-বিএনপিকে এখন দেখা না গেলেও তারাই অাসল কাজ করছে। গুছিয়ে যখন অাঘাত হানবে, পালানোরও পথ থাকবে না।

ওদিকে বুদ্ধিজীবীরা যদি সঠিক কাজটি করতেন, তাহলে বাংলার অসাম্প্রদায়িকতা ফিরিয়ে অানতে পারতেন। দেশ যখন প্রায় রসাতলে তখন অন্যান্য সময়ের চাহিদায় তালিকার পেছনের বা পরের ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।

খবরে দেখলাম, দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা যারা একাত্তরে অামাদের নিধন করে পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছিল তাদেরও বিচার করা যাবে। হাজার হাজার পাকসেনা যাদের অামরা 'খানসেনা' নামে চিনতাম, তাদের এই অফিসাররা দুনিয়ার কলঙ্ক। হিটলার, মুসোলিনী বা ভিয়েতনামের কথা অামরা পড়ে জানলেও এর তুলনা তার সঙ্গে চলে।

অামি কম্বোডীয় যাদুঘরে দেখা বিভীষিকা ও ভিয়েতনামের ইতিহাস থেকে এ কথা বলতে পারি যে, পাক সেনা অফিসারদের বিচার হওয়া ছিল জরুরি। পাকিস্তান সে মর্মে অঙ্গীকার করে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেও বিচার করেনি। ভারতও এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। পাকিস্তানিদের পরাজিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করাই ছিল ভারতের গৌরব।

অামাদের না ছিল শক্তি, না সাহস, না দেশের সে ইমেজ। উল্টো পাকিকরণের পথে ছুটে চলা দালাল রাজাকার ও বিএনপি-এরশাদের বাংলাদেশ ছিল তাদের অনুসারী টাইপের। অাজ বদলে যাওয়া সময়ে দেশের মাথা নামে পরিচিত অগ্রজ পণ্ডিত সুশীল নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা সে বিচার চাইতেই পারেন।

কিন্তু সময়টা কি তার অনুকূলে? এই সরকারের অামলে অামাদের মাথা-উঁচু সম্মান, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পাশাপাশি চলছে হানাহানি। একটার পর একটা খুন, গুম, হত্যা অার অঘটনে মানুষ ত্রাসে ভয়ে গুটিয়ে অাছে। এত অপরাধ, এত যৌন-অনাচার এ জাতি অাগে কখনও দেখেনি। কোনো কিছুরই বিচার হয় না।

এমন বিচারহীন সমাজে নিরীহ মুসলমান অার সংখ্যালঘু নামের হিন্দু, বৌদ্ধ, আদিবাসী ও খ্রিস্টানরা বলির পাঁঠা অথবা কোরবানির পশু। হিন্দুদের দেশত্যাগ, বাড়িঘর হারানো, দেবদেবী ও মন্দির পোড়ানো এখন হররোজকার ঘটনা। এতই প্রবল যে, খালেদা জিয়া ভড়কে গিয়ে দাবি করেছেন, তাঁর অামলেও এমন হয়নি। মানে সব অামলেই হয়, এবার তা মাত্রা ছাড়িয়ে তাঁকেও বোকা বানিয়ে দিয়েছে। এবারের হিন্দু-নিধন বা সংখ্যালঘু পীড়নের কাণ্ডারি জামায়াত-বিএনপি নয়, অাওয়ামী লীগ। তারা কীভাবে পাকসেনাদের বিচার করবে?

দেশ মুক্ত করা মানুষজনদের চেতনা বহনকারীরাও এখন নিরাপদে নেই। গাঁও-গেরামে মৌলবাদ এমন গেড়ে বসছে যে তাতে এদেশের চেহারাই হয়তো একদিন অার চেনা যাবে না। এ প্রক্রিয়া দেশের বাইরেও চলমান। সিঙ্গাপুরের ঘটনা মিথ্যে কিছু নয়। এমন সব দেশে চলছে। খোলনলচে পচে গেছে অামাদের। তার বিহিত না করে পাকিপ্রেমী মূল্যবোধের সমাজ ও খুনোখুনির পরিবেশ নিয়ে অামরা কি পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের বিচার করতে পারব?

জানি না তারপরও কেন তাঁরা এ নিয়ে সামনে এসেছেন। মজার ব্যাপার হল, সাধারণ মানুষ এখন বিপন্ন সংখ্যালঘু ও মুক্তচিন্তার বাঙালিদের মগজ রক্ত রাজপথে দেখে প্রশ্ন করেন: কোথায় বুদ্ধিজীবীরা, কোথায় তাদের অানিস স্যার, কোথায় মুনতাসীর মামুন বা শাহরিয়ার কবীর? অনেকে বলেন, শাহরিয়ার কবীররা নাকি বিএনপির অামলে এসব ঘটলে প্রতিবাদমুখর হন, অাওয়ামী অামলে নয়।

এখন জানলাম ও নিশ্চিত হলাম যে, তাঁরা পাকিস্তানি সে সব সেনা অফিসারের বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত, যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন। এমনকি নিয়াজীও বেঁচে নেই। তবু অপরাধ ও বিচার বলে কথা।বিবেকবান মানুষ তা চান। তবে তারা এটাও জানতে চান যে, অাজকের বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট, রাজনীতি, সামাজিক অাচারে পাকিস্তানপ্রেমী– বেশিরভাগ মানুষ পোশাকে-অাহারে-জীবনে ক্রমেই উগ্র, মানবতাবিরোধী ও অসহনীয় মেজাজের হয়ে উঠছে, তখন তাদের ঠিক না করে এ দেশ ও জাতিকে সুস্থ ধারায় না এনে এ জাতির বিচার চাওয়া কি সময়ের চাহিদা?

একটা সত্য ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ঢাকায় লেখালেখি করেন ও টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেন এমন একজনের কাহিনি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। বর তথাকথিত উদার মনের যুবক। তবে বেশিদিন টিকল না তার উদারতা। মেয়েটিকে অাহার-বিহার-পোশাক সব কিছুতে নিয়ন্ত্রণের এক অনাচার চালু হল।
সে সব মেনে নিয়েও কোনোভাবে থাকা দুজনের। পরের ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক।

মুক্তিযুদ্ধের সময় না জন্মালেও মেয়েটির মনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অসীম মায়া অার ভালোলাগা। সে ভালোলাগা থেকে বরকে নিয়ে দোকানে গিয়ে কিনে এনেছিলেন একখানা দারুণ পোস্টার। একদিন কাজ থেকে এসে দেখেন টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে অাছে সেটি। নিরীহ পোস্টারটির দোষ জেনে তিনি হতবাক। তার চেতনাপ্রেমী বরটি এখন চেতনাহীন। পোস্টারে লেখা 'বাংলার হিন্দু বাংলার খ্রিস্টান বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান অামরা সবাই বাঙালি' কথাটি এখন অার তার পছন্দ নয়। সে কারণেই সেটি কুটিকুটি করে ফেলা হয়েছিল। ঠিক যেমন আজকাল উগ্রবাদদের হাতের চাপাতি করছে!

এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে পাকসেনাদের বিচার করব বা বিচার চাইব না দেশ জাগাব? এ বোধ নিশ্চয়ই অাছে তাদের। এভাবে চলতে থাকলে একসময় কে যে কার বিচার চাইবে বা করবে সেটা ভাবলেও ভয়ে শিউরে উঠি।

সাধু সাবধান।

সিডনি