তাহলে কি দেশপ্রেমই দায়ী!

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 15 August 2011, 03:02 PM
Updated : 15 August 2011, 03:02 PM

আজ দুপুরে কবি, গদ্যকার সৈকত দে'র ফোনে মর্মান্তিক সড়ক-সংঘর্ষে তারেক, মিশুকের অকালমৃত্যুর খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রগাঢ় এক বেদনাবোধ আর শূন্যতার অনুভবে সারা মনপ্রাণ ছেয়ে গিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে বেদনার জায়গা দখল করে নিলো প্রবল বিক্ষোভ আর ক্রোধের আগুন। সেই দুর্মর ক্রোধের ভেতর থেকে জেগে উঠলো একটি অবুঝ প্রশ্ন "দেশকে ভালোবাসা কি অপরাধ?" তা নইলে কেন এমন বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো আমার দুই উজ্জ্বল, মেধাবী, প্রাণোচ্ছ্ল, সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর, স্বপ্নময় বান্ধবকে!


নিউ ইয়র্কে সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের কার্যালয়ে তারেক মাসুদ ও আলম খোরশেদ। ছবি. সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৪।

নয়ের দশকে আমার ন্যুয়র্ক-বাসের এক পর্যায়ে এক ছাদের তলার সহবাসিন্দা তারেক তো তখন বেশ ভালোই ছিল তার মার্কিন জীবনসঙ্গীনী চৌকস, প্রতিভাবান, বনেদি পরিবারের মেয়ে ক্যাথারিন শাপিরোকে নিয়ে! ততদিনে চলচ্চিত্র তৈরির বিদ্যায় হাত পাকিয়ে সে নিজেকে বেশ একটা পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠার জায়গায়ও নিয়ে যেতে পেরেছিল। চাইলে সে ন্যুয়র্কের মূলধারাতেই একজন সৃষ্টিমুখর চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসাবে জায়গা করে নিতে পারতো। কিন্তু, তা না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত, প্রগতিশীলতার মন্ত্রে দীক্ষিত তারেক তখন তার মুক্তির গান ছবিটি নিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের শিকড়কে আরও নিবিড়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সে তার চলচ্চিত্রকে হাতিয়ার করে দেশে ফিরে এল নিঃশঙ্ক চিত্তে।

আমার অপর বন্ধু মিশুকও, যার পত্নী মঞ্জুলি ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রিয় সহচর, বছর খানিকও হয়নি কানাডার লোভনীয়, সম্মানজনক পেশা ও পদবী ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিল দেশের সেবা করবে বলে, দেশের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের জগতে তার এতদিনের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গুণগত পরিবর্তন আনবে বলে, আর তার কুশলী ও শৈল্পিক হাতের ক্যামেরা চালনায় আমাদেও রোগাদুবলা চলচ্চিত্র শিল্পকে আরেকটু সবল ও সাবালক করে তুলবে বলে। মনে পড়ে, ২০০৩ সালে, আমার নিজের স্থায়ীভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বছর খানেক পূর্বে, মিশুক আমার মন্ট্রিয়লের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল সপরিবারে, পত্নী মঞ্জুলি আর পুত্র সুহৃদকে নিয়ে। ততদিনে সে কানাডার প্রচারমাধ্যম জগতে একটা জায়গা করে নিয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই আফগানিস্তান যাওয়ার কথা তার, কান্দাহার বিষয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরির কাজে, কিন্তু তার চিন্তাজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। কবে, কখন সে কানাডায় শেখা এই নতুন জ্ঞান দেশের প্রচার মাধ্যমে কাজে লাগাবে তার জন্য ব্যাকুলতা। সে তার কথা রেখেছিল, ফিরে এসেছিল দেশে, দেশকে ভালোবেসে, দেশের কাজে লাগবে বলে।

কে জানতো তারেক, মিশুকের এই নিখাঁদ দেশপ্রেমই কাল হবে তাদের জন্য। অপঘাতে, অপমৃত্যু হবে তাদের, হতভাগ্য দেশের মাটিতে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, আমি আর সবার মত তাদের এই করুণ মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করছি না। কেননা একে তো কোনো অর্থেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও নাগরিকদের জন্য নিরাপদ চলাচলব্যবস্থা গড়ে তোলায় রাষ্ট্রের নিদারুণ ব্যর্থতার পরিণাম এই হত্যাকাণ্ড, যাকে সহজেই বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। পত্রিকান্তরে দেখলাম দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এই তথাকথিত দুর্ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাদের তো উচিত ছিল লজ্জিত হওয়ার! এই দুই দেশপ্রেমিক শিল্পী ও উঁচু মাপের মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার জন্য সমগ্র জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার! আমাদের মহামান্য যোগাযোগ মন্ত্রীকে দেখলাম আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে এই মৃত্যুর দায়ভার স্বয়ং মৃতের কাঁধেই এই বলে যে চাপিয়ে দিতে যে তারেক-মিশুকদের বহন করা গাড়িটিরই নাকি উচিৎ হয়নি অমনভাবে ওভারটেক করা! তার কাছে বিনীত প্রশ্ন–নিজের ব্যবসাবাণিজ্যের কাজে এবং সম্প্রতি মন্ত্রীত্বের সুবাদে তিনি তো অনেক হিল্লী, দিল্লী ঘুরেছেন। তিনি কোন্ সভ্য দেশে দেখেছেন এরকম অপ্রশস্ত, এক লেনবিশিষ্ট, কোনো প্রকার বিভাজিকাবিহীন, দ্বিমুখী মহাসড়ক? এমন নিশ্চিত মৃত্যুকূপসদৃশ মহাসড়কের ন্যায় নামধারী মহামড়ক বোধহয় আমাদের মত দেশেই সম্ভব যেখানে মানুষের জীবনের মূল্য সবচেয়ে কম। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেবার আগে কেন এতদিনেও একটা ভদ্রগোছের নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেন না আপনারা এই প্রশ্নের উত্তর চাই আমরা।

ক্ষমা করো প্রিয় ব্রাত্য রাইসু। তুমি আমাকে অনুরোধ করেছো তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ত্রিশ বছরের বন্ধুজীবনের স্মৃতিচারণ করার জন্য। কিন্তু আজ আমার মন এতটাই বিক্ষিপ্ত, বিস্রস্ত এবং বিক্ষুব্ধ যে আমি হয়ত তোমার অনুরোধ ঠিকঠাক রক্ষা করতে পারবো না। একথা সত্যি, দেশে ও বিদেশে তারেকের সঙ্গে আমার অজস্র সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে। কোনো একদিন হয়ত সেইসব স্মৃতির কথাও বিশদে শোনাব আমি তোমাদের। আজ শুধু বলি তারেকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আমি যখন নগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন, নাট্যজন আলী যাকেরের ইস্কাটনের বাসায় 'অচলায়তন' নাটকের মহড়ায়। এর পর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সুবাদে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, যে ঘনিষ্ঠতা পরে বন্ধুত্বে পরিণত হয় আমার সুদীর্ঘ প্রবাস জীবন পর্বে।

১৯৮৯-এ বন্ধুবর সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে মিলে তার বিশ্ববিদ্যালয় নিউ স্কুল ফর সোশাল রিসার্চ-এর মিলনায়তনে শিল্পী এস. এম. সুলতানকে নিয়ে করা তারেকের অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র আদমসুরত-এর প্রদর্শনীর আয়োজন, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন-এর বাসায় সুলতান ও সত্যজিৎ রায়-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন, দল বেঁধে গ্রীনিচ ভিলেজ-এর আর্ট হাউসগুলোতে পুরনো বিদেশী ছবিগুলো দেখে বেড়ানো, তারেক ন্যুয়র্কের যে সুবিশাল পুরনো বইয়ের দোকানে খণ্ডকালীন কাজ করতো, সেই 'স্ট্রান্ড বুক স্টোরে' দুর্লভ বইয়ের সন্ধানে আমার ও সলিমুল্লাহর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করে দেওয়া, ন্যুয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত আমাদের কোলকাতার বন্ধু নাট্য নির্দেশক ও লালন গবেষক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়-এর দপ্তরে, বাংলাদেশের মেধাবী নাট্যবিদ সালেক খানসহ শিল্প সাহিত্যের আড্ডায় মশগুল থাকা, কোনো এক গ্রীষ্মে আমি, সলিমুল্লাহ, নাসির আলী মামুন, তারেক, ক্যাথারিন মিলে কানেকটিকাট রাজ্যের সালেম শহরে ক্যাথারিনের দাদার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, সেখান থেকে রোড আইল্যান্ড-এ ক্যাথারিন-এর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রাউন কলেজ ও সংলগ্ন এডগার অ্যালান পো স্মৃতিস্তম্ভ দর্শন, তারপর গাড়ি চালিয়ে আরও উত্তরে মেইন রাজ্যের ছোট এক আরণ্যক দ্বীপে ক্যাথারিনের নানীর গ্রীষ্মকুটিরে অবস্থান, সেখানে হ্রদে নৌকো বাওয়া, সাঁতার কাটা আর মেইনের বিখ্যাত বিশাল লবস্টার ভক্ষণ। এরকম আরও কত অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে আমার তারেককে ঘিরে।

তবে এই সবকিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে, থাকবেও আমৃত্যু, তারেকের মুক্তির গান ছবিটি নির্মাণের মহাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে থাকার স্মৃতিটুকু। তারেক তখন থাকতো ন্যুয়র্কের একটি দ্বীপাঞ্চল স্ট্যাটেন আইল্যান্ড-এ। আমিও ছিলাম তার সহ-আবাসিক। সদ্য সে ব্রুকলিনের এক বেসমেন্ট থেকে লীয়ার লেভিন চিত্রায়িত 'মুক্তির গান' ছবিটির হাজার হাজার বাক্সবন্দি ফুটেজ উদ্ধার করে এনে তার ঘরে তুলেছে। তারপর শুরু হলো তার আর ক্যাথারিনের আহারনিদ্রা ভুলে অষ্টপ্রহরের এক মরণপণ কর্মযজ্ঞ, সেই সংখ্যাহীন ফুটেজের প্রতিটি ইঞ্চি পরখ করে, কেটেছেঁটে, ফের জোড়া লাগিয়ে, তিলতিল করে মুক্তির গান-এর মূল কাঠামোটুকু নির্মাণের ভেতর দিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মাটিকে স্পর্শ করার। এদিকে প্রবল অর্থসংকট। অর্থনীতির তুখোড় ছাত্রী ক্যাথারিন তখন সিটি ব্যাংক এন. এ. তে ঢোকে। তারেক ঘরদোর সামলায়, এমনকি ঘরের মার্কিন মালিক জনাথন, যাকে আমরা তার ভারতপ্রীতির জন্য জনার্দন বলে ডাকতাম, তার সঙ্গে চুক্তি করে ঘরবাড়ি রং ও মেরামতের কাজ নিজ হাতে করে দিয়ে কিছু টাকা আয় করে। সেই টাকা দিয়ে ভিলেজ থেকে ভাড়া করে এনে একটি আস্ত এডিটিং মেশিন তার ঘরে বসিয়ে দিয়ে বাড়িটিকে রীতিমত একটি চলচ্চিত্র কারখানা বানিয়ে তোলে। এই ছবিটি নির্মাণের পেছনে তাদের দুজনের ত্যাগ তিতিক্ষা নিষ্ঠা পরিশ্রম ও নিবেদন নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না নিজের কাজের প্রতি, দেশের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি একজন মানুষের এতখানি দায়বদ্ধতা থাকতে পারে। আমার সৌভাগ্য আমি শুধু এই কর্মযজ্ঞের একজন নীরব সাক্ষী হয়ে থাকিনি, কিছুটা হাতও লাগাতে পেরেছিলাম। তারেকের অনুরোধে মুক্তির গান-এর বাংলা ভাষ্যবর্ণনাটুকু আমিই লিখে দিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে এর প্রথম প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকাটি সম্পাদনার দায়িত্বটিও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম সানন্দে। একে আমি আমার জীবনের অন্যতম পূণ্যের কাজ বলে গণ্য করি।

তবে আজ সেসব কথা ছাপিয়ে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছে যে কী অক্ষম ও অকৃতজ্ঞ আমাদের এই রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নেতৃত্ব যে তারেক মিশুকের মতন এমন মেধাবী, পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ, দেশপ্রেমিক মানুষের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও দিতে পারে নি। এই রাষ্ট্র আজ গুটিকয় দুর্নীতিবাজ, ন্যায়নীতি বিবর্জিত ব্যবসায়ী, লুটেরা শ্রেণীর কাছে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে গেছে। শান্তিপ্রিয়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষদের পিঠ আজ আক্ষরিক অর্থেই দেয়ালে ঠেকে গেছে। কিন্তু এই অবস্থা আর মেনে নেয়া যায় না। দেশের জন্য, দেশের শিল্পসংস্কৃতির জন্য তারেক, মিশুকের এই অপরিসীম আত্মত্যাগ বৃথা যাবে, যদি না আমরা এই অন্যায় অবিচার ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে আমরা আর মুখ বুঁজে সহ্য করবো না এই অনাচার, মেনে নেবো না এই রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ। আমরা সংগঠিত হবো, আমরা আদায় করে নেবো আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার। আর কোনো তারেক কিংবা মিশুককে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার বলি হতে দেব না আর কোনোদিন। এটাই হোক আমাদের সবার এই মুহূর্তের অঙ্গীকার। তারেক-মিশুক, এই অক্ষম, অথর্ব রাষ্ট্রের হয়ে আজ আমি তোমাদের দুজনের কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী।

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: আলম খোরশেদ
ইমেইল: purbapashchim@yahoo.com

আরো লেখা

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts