তারেক মাসুদের সংগ্রাম: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 16 August 2011, 01:26 PM
Updated : 16 August 2011, 01:26 PM

আর্টস-এ প্রকাশিত সলিমুল্লাহ খানের লেখা 'আমার শিক্ষক তারেক মাসুদ' রচনাটি ভালো লাগল। সড়ক দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুর পরে তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করছিল মনে, এই নামে মাসুদকে নিয়ে একটি রচনা লিখব বলে ভাবছিলাম। সলিমুল্লাহ খান যেন আমার অন্তর্যামী হয়ে একই শিরোনামে রচনাটি লিখে ফেলেছেন। তিনি বয়সে তারেক মাসুদের একেবারেই সমসাময়িক বন্ধু। ফলে তাঁর এমনটি লেখার কথা নয়! তা সত্ত্বেও যে লিখেছেন সেটা তাঁর বন্ধুত্বের ও উদার মনের পরিচয়।


………
তারেক মাসুদের ডকুমেন্টারি 'আদম সুরত'-এর পোস্টার
………

লেখাটিতে আমার মনের কথা আছে বলে তাঁকে আরও একটু বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাই! আমার সঙ্গে তারেক মাসুদের যে সম্পর্ক তাতে অনুভব করেছি যে, বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও তারেক মাসুদ আমাকেও বন্ধুই ভেবেছেন। তাই আমি নিজেকে দাবি করি তাঁর অনুজপ্রতিম বন্ধু বলে। তাঁকে আমি প্রথম দেখি যতদূর মনে পড়ে আশির দশকের প্রথম দিকে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৩৭ ইন্দিরা রোডের প্রাঙ্গণে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বই-পড়া ছবি-দেখা গান-শোনা ইত্যাদি কর্সূচির কর্মী হিসেবে আমার যুক্ততার সূত্রে। সেখানকার কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর আড্ডা দিতাম আমরা। তারেক ভাইকে আড্ডায় পেতাম, পেতাম নানা কাজে অংশগ্রহণরত অবস্থায়। কাজ মানে তাঁর আদম সুরত চলচ্চিত্রের কাজ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলা মোটরের এখনকার প্রাঙ্গণে আসার পরেই তাঁকে বেশি দেখা যেত। আহমদ ছফার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। আহমদ ছফা বাংলা মোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের একটি বাড়িতে থাকতেন। তারেক মাসুদ কখনও শিল্পী এস এম সুলতানসহ ছফা ভাইয়ের বাসায় যেতেন, কখনও এস এম সুলতানকে নিয়ে ছফা ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও আসতেন। আমি এস এম সুলতানকে যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কিছুটা কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম তা সম্ভব হয়েছিল তারেক মাসুদের কারণেই। কখনও এস এম সুলতান নিজে থেকেই আহমদ ছফার বাসায় আসতেন বা কখনও কখনও তারেক মাসুদের কাজের সূত্রে সেখানে আসতেন। এস এম সুলতান এলে তারেক মাসুদ তো আসতেনই। সেই সূত্রেই আমরাও সুলতানের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পেতাম।

সুলতান যে নিজের সৃষ্ট রঙে ছবি আঁকতেন এ খবর আমি তারেক মাসুদের কাছেই পাই। তারেক মাসুদ আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন ছফা ভাই সম্পর্কে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ছফা ভাইয়ের ব্যাপরে কিছুটা বিরূপ ছিলাম। তবে এখন পেছন ফিরে দেখি তাঁর সম্পর্কে আমি যতটা সম্ভব হালনাগাদ থাকতে পারতাম তারেক মাসুদেরই সূত্রে। ছফা ভাইয়ের চিন্তার স্পর্শ পেয়ে যেতাম তাঁর কাছে শুনে শুনে। তারেক মাসুদ সুলতানের চিত্রকর্ম নিয়ে কথা বলতেন দীর্ঘ সময় ধরে। তিনিই আমাকে একদিন বলেছিলেন 'বাঙলার চিত্র ঐতিহ্য ও সুলতানের সাধনা' প্রবন্ধটি পড়বার জন্য। প্রসঙ্গত 'বাঙালি মুসলমানের মন' প্রবন্ধটির কথাও তিনিই আমাকে প্রথম বলেছিলেন। স্পষ্ট মনে আছে ছফা ভাইয়ের ব্যাপারে আমার মনে যে বিরূপতা ছিল তা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল এই দুটি রচনা পড়ে। তারেক ভাই আমাকে ছফা ভাইয়ের অলাতচক্র উপন্যাসের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ছফা ভাইয়ের একজন আলী কেনানের উত্থান উপন্যাস ও ওঙ্কার উপন্যাসের প্রতি। অলাতচক্র তখন সদ্য ঈদসংখ্যা নিপুণ-এ বেরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের আর এক চেহারা এই উপন্যাসটির উপজীব্য। মনে আছে ওঙ্কার সম্পর্কেও তারেক মাসুদ ছিলেন সপ্রশংস। আমার বন্ধু সাজ্জাদ শরিফ, সেলিম মোরশেদ বা পারভেজ হোসেন যেত আহমদ ছফার বাসার আড্ডায়। তাঁর ব্যাপারে ব্যক্তিগত সংকোচ থাকায় আমি যেতাম না। আজিজ মার্কেটে বা বাংলা একাডেমীতে বা অনুষ্ঠানাদিতে দেখা হয়ে যেত। অন্যদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন, তাঁর সে-সব কথা শুনতাম। সে-সব অন্য প্রসঙ্গ। মোটকথা আহমদ ছফার সঙ্গে আমার যোগসূত্র ছিলেন তারেক মাসুদ।

বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ ১৯৮৫ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত বৃটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে James D. Leahy-র পরিচালনায় এক চলচ্চিত্র কর্মশালার আয়োজন করেছিল। কর্মশালার বিষয় ছিল ইয়োরোপীয় ও তৃতীয় বিশ্বের চলচ্চিত্র। তারেক মাসুদ এই কর্মশালার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন আমাকে। ফলে তাঁর ও সুশীল সূত্রধরের সহযোগিতায় আমি কর্মশালায় অংশ নেই। কর্মশালাটি তখনকার ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। লাতিন আমেরিকীয় ও আফ্রিকীয় চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমি সে-সময়েই খানিকটা ধারণা লাভ করতে পেরেছিলাম। মনে আছে আফ্রিকার কবি-চলচ্চিত্রকার ওসমান স্যামবেনে ও ল্যাটিন আমেরিকীয় দেশ চিলির চলচ্চিত্রকার মিগুয়েল লিতিনের চলচ্চিত্র দেখেছিলাম সেখানে। এর আগে এ ব্যাপারে সামান্য ধারণাও ছিল না আমার। যতদূর মনে পড়ে পিটার ব্রুকের মহাভারত ছবিটাও তাঁরই সূত্রে আমি ব্রটিশ কাউন্সিলে দেখার সুযোগ পাই! তারেক শাহরিয়ার, জাহেদুর রহিম অঞ্জন ও সূশীল সূত্রধরও তখন আমাকে ছবি দেখার সুযোগ পাইয়ে দিতেন। আমার মনে আছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের শেষ ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে আমি আর্থিক কারণে নাম লেখাতে পারি নি। তা ছাড়া চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী হিসেবেও কোনো সংসদের সঙ্গে তালিকাভুক্তি ছিল না। প্রধানত তারেক মাসুদ ও তারেক শাহরিয়ারের সূত্রে আমি মাঝে মাঝে ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম। ছবি দেখার সুযোগ নিতাম। মনে আছে জার্মান চলচ্চিত্রকার ফাসবাইন্ডার ও পিটারসেনের রেট্রস্পেক্টিভের সবগুলো ছবিই আমি তারেক ভাইয়ের সূত্রেই দেখতে পেরেছিলাম! তখন সেন্সর বোর্ডের খুব কড়াকড়ি ছিল ছবি প্রদর্শনের ব্যাপারে। কিন্তু মনে আছে ফাসবাইন্ডারের দুটি ছবি সেন্সর ছাড়াই আমরা দেখতে পেরেছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমেও তারেক মাসুদের উপদেশনা ছিল।

সেই আশির দশকেই দেখতাম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রায় সকলেই তাঁকে চিনতেন। আদম সুরতের নাম প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল 'রেবেল অ্যাঞ্জেল'। প্রথমে আমি এই নামটিই জানতাম। আদম সুরতের জন্য টাকা যোগাড় করা সে-সময়ের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। অথচ তিনি থামেন নি। আদম সুরত নির্মাণ শেষ করেছেন। তখনই মিশুক মুনরীকে দেখতাম তাঁর সঙ্গে চলাফেরা করতেন। দুজনের মধ্যেই তখন শিল্পের ক্ষুধা। শিল্পের জন্য ছিল নিরাপোষ মানসিকতা। ফলে বুঝতাম যে এফডিসির বৃত্তে তিনি যাবেন না। চলচ্চিত্রের কারিগরি সামর্থ্যকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। নিজেও শিখতে চাইতেন প্রবল আগ্রহে। কেবল একাকী স্বার্থপরের মতো নয়, সবাইকে নিয়ে চলতে চাইতেন। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান 'অডিওভিশনের' যাত্রা শুরু হয়েছিল। আসাদগেট এলাকায় একটা বাড়ি নেয়া হয়েছিল 'অডিওভিশনে'র জন্য। চলচ্চিত্র সার্বক্ষণিকের কাজ। সেজন্যে 'অডিওভিশনে'র অফিসই হবে তাঁদের ঘরবাড়ি–অনেকটা এমনই ছিল প্রস্তুতি। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যকে দেখতাম সেখানে নিয়মিত যেতে। দেখতাম শিল্পী ক্যামেলিয়াকে। শিশির-ক্যামেলিয়ার তখনও বিয়ে হয় নি। দেখতাম ক্যাথারিনকে। ক্যাথারিনকেও দেখলাম চলচ্চিত্রের নেশায় মাতোয়ারা। ক্যাথারিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও প্রায়শই আসতেন। আদম সুরতের সঙ্গে ক্যাথারিনও জড়িয়ে পড়লেন। সাবটাইটেল করেছিলেন তিনি। মনে আছে এখনকার বিবিসির সাংবাদিক পুলক গুপ্ত ছিলেন এই দলে, ছিলেন ঢালী আল মামুন। পুরো দলটার নেতৃত্বে ছিলেন তারেক মাসুদ। কিন্তু নেতৃত্বের দম্ভ ছিল না তাঁর। নেতাগিরি ফলাতে চাইতেন না। শাহাদুজ্জামানও আসতেন চট্টগ্রাম থেকে। ঢালী আল মামুন, ফয়েজুল আজিম, শাহাদুজ্জামানরা লিটল ম্যাগাজিন বের করতেন প্রসঙ্গ নামে, চট্টগ্রাম থেকে। তবে ঢালী আল মামুন একটু বেশিই লগ্ন ছিলেন মনে আছে তারেক মাসুদের সঙ্গে। ১৯৮৫-৮৬ সালেই হবে বোধহয় তারেক মাসুদ একদিন বললেন, চলচ্চিত্র বানাতে হলে শিল্পের সব শাখাকে বুঝতে হবে। আমি নিজের মধ্যে কখনও চলচ্চিত্রকারের শক্তি অনুভব না করলেও তারেক মাসুদের মতো অনুভব করতাম যে সৃষ্টিশীল মানুষকে সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। ইতিহাস সমাজ রাজনীতি দর্শন—বুঝতে হবে সব। ঠিক হল নিজেরাই নিজেদের শিক্ষক হবেন। দরকার জানা ও শেখা, সার্টিফিকেট পাওয়া নয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অবকাঠামোর সুবিধা নেয়া হবে। শুরু হল মাল্টিমিডিয়া অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। মনে পড়ছে পুলক গুপ্ত বলতেন সঙ্গীত বিষয়ে, শিশির ভট্টাচার্য্য ও ঢালী আল মামুন বলতেন চিত্রকলা নিয়ে, ফটোগ্রাফি সম্পর্কে বলতেন মিশুক মুনীর। প্রবীণদের মধ্যে মোস্তফা মনোয়ারকে নিয়ে আসা হয়েছিল একদিন, নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে বলবার জন্য। সেই পাঠচক্রের অংশী ছিলাম বলে ক্যামেরা বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলাম মিশুক ভাইয়ের কাছ থেকে। কাছাকাছি সময়েই, ১৯৮৫ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আয়োজিত জাতীয় আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আমার দুটি আলোকচিত্র স্থান পেয়েছিল। আলোকচিত্র গ্রহণের নান্দনিক ও কারিগরি উভয় শিক্ষাই আমি পেয়েছিলাম মিশুক মুনীরের কাছে। এ-কথা আমি বলছি এই কারণে যে তারেক মাসুদ একা কাজ করতেন না। সবাইকে নিয়ে করতেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নেতার। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কী ও কেন এ ব্যাপারেও আমি তাত্ত্বিক ধারণা পেয়েছিলাম তারেক মাসুদের কাছ থেকেই। যখন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হল তখন একদিন অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আমাকে বললেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখা যোগাড় করতে। আমি তারেক মাসুদের নাম বললাম। তিনি বললেন ও লিখলে তো খুবই ভালো হয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রস্তাব তাঁকে দিলে তিনি উল্টো বললেন আমাকে লিখতে, কারণ লেখালিখিটাই আমি করি। আমি বললাম আমি তো আপনাদের কাছে শুনে শুনে সামান্য জানি। এ দিয়ে কি একটা প্রবন্ধ লেখা যায়? তিনি কয়েকটি বইয়ের এবং প্রবন্ধের নাম বললেন আর প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্রের ফটোকপি দিলেন নিজের সংগ্রহ থেকে। আর কোন কোন দিকে নজর দিতে হবে সে ব্যাপারে আমাকে বুঝিয়ে বললেন। বিষয়ও ভাগ করলাম অনেকটা তাঁর সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত ধারণার আলোকে। আমার লেখায় বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কথাই বেশি এল। আন্তর্জাতিক তথ্য যেটুকু এল তা তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন সময় শোনা তথ্যের ভিত্তিতে। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত সুন্দরম পত্রিকায় আমার সেই খঞ্জ লেখাটি ছাপাও হয়েছিল। পরবর্তীকালে বইয়ে স্থান দেবার সময় ইন্টারনেটের সহযোগিতা নিয়ে ও নতুন বইপুস্তক ঘেঁটে প্রবন্ধটির ব্যাপক সংস্কার করেছিলাম। এবারেও তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে অনেক পরামর্শ দিলেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে স্বতন্ত্র একটা শিল্পমাধ্যম মনে করতেন। বাংলাদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনেরও তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়া চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবির প্রিন্ট সংগ্রহের ব্যাপারেও সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। পরবর্তী কালে ঢাকার ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সগুলোতে যে ঐ বিশ্ববিখ্যাত ছবিগুলো দেখানো যেতো তাতেও তাঁর ভূমিকা ছিল।

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে মনে করতেন নিজের জন্য কার্যকর শিল্পমাধ্যম। যাঁরা তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন তাঁদের জানা আছে যে, তারেক মাসুদ তথাকথিত কাহিনিনির্ভর ছবি বানাতে চাইতেন না। গল্প থাকলেও তার মধ্যে থাকবে প্রামাণ্য বিষয়। এটা ছিল তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের আঙ্গিকদৃষ্টি। এই দর্শন তিনি বজায় রেখেছিলেন সব সময়। আমার মনে হয় তিনি যে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন এবং নিজের মধ্যে ইতিহাস চেতনাকে অনুভব করেছিলেন তার আলোকেই নিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্ত। মধ্যসত্তর থেকে গোটা আশির দশক জুড়ে বাংলাদেশের মুক্তির ইতিহাসের চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল সামরিক-অসামরিক স্বৈরশাসক গোষ্ঠী। মুক্তির গানমুক্তির কথার প্রামাণ্যতার মধ্য দিয়ে তিনি যেন ইতিহাসের সেই চাকাকে যথাস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আদম সুরত বা মুক্তির গান, মাটির ময়না বা রানওয়ে–সবই কোনো-কোনো-ভাবে প্রামাণ্য ছবি! ডকুফিকশন শব্দটাও বলতেন তাঁর নিজের ছবির সংরূপ সম্পর্কে। সেই আশির দশক থেকেই মাটির ময়নার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলতেন আমাদের। উপজীব্য বিষয় সম্পর্কে বলতেন। মাটির ময়না নির্মিত হবার পর আমার মনে হয়েছিল তারেক মাসুদ আর কোনো প্রতিকূলতায় হটবেন না। কারণ তিনি জানতেন স্বপ্নের পেছনে ছুটলেই শুধু চলবে না। এর জন্য বাস্তবসম্মত পথকেও চিনে নিতে জানতে হয়। তাঁর লক্ষ্যস্থল ছিল সুদূরে অবস্থিত। সেজন্যে কঠোরভাবে নিজেকে গড়ে নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র যে একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার সেটা তিনি বুঝেছিলেন যৌবনের সেই প্রথম লগ্নেই! ক্যাথারিনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ও পরিণয় তাঁর লক্ষ্যকে অনেকটা সহজ করে এনেছিল। আলমগীর কবিরের মৃত্যুতে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের অঙ্গনের তরুণদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার অনেক খানিই কাটিয়ে উঠছিলেন তারেক মাসুদ ও তাঁর সহযাত্রী চলচ্চিত্রকারেরা। মানতেই হবে যে তারেক মাসুদ ছিলেন এর মধ্যে বিশিষ্ট। সিনেমা হল যে ধরনের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ওপর নির্ভর করে তাদের ব্যবসা চালায় সে ধরনের চলচ্চিত্র তারেক মাসুদ নির্মাণ করবেন না। কিন্তু চলচ্চিত্র তো দেখাতে হবে মানুষকে। কীভাবে সেটা সম্ভব হবে তা নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। মুক্তির গানের ফুটেজের সন্ধান তিনি করছিলেন অনেক দিন ধরে। শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেনু তাঁর আত্মীয়। বেনুর কাছ থেকে লিয়ার লেভিনের স্যুটিঙের খবরটুকুই কেবল জেনেছিলেন। তারেক মাসুদ আমেরিকা পাড়ি দিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। তা কেবল অর্থের সন্ধান নয়। সন্ধান লিয়ার লেভিনের ফিল্ম ফুটেজের। তারেক সেই লিয়ার লেভিনকে খুঁজে বের করলেন। উদ্ধার করলেন বিস্মৃতপ্রায় ফিল্ম ফুটেজ। প্রয়োজনীয় আরো ফুটেজ সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করলেন । সেই ফুটেজ সম্পাদনা করে ও নতুন স্যুটিং করে নির্মিত হল মুক্তির গান। ছবি তো নির্মিত হল। এখন সেটা প্রদর্শন করবেন কোথায়। প্রজেক্টার নিয়ে একদল কর্মীকে সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে মুক্তির গান আর মুক্তির কথার প্রদর্শনী করেছেন। নিজেকে বলতে ভালোবাসতেন চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা। এর ফলেই নতুন প্রজন্মের সামনে ফিরে আসতে পেরেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যতা।

১৯৯৮ সালের শেষের দিকে কর্মী হিশেবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে আমার যুক্ততার অবসান ঘটে। ফলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে আমি খানিকটা দূরে চলে যেতে বাধ্য হই। তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ কমে আসে। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় মাটির ময়না নির্মাণের খবর দেখতাম। হঠাৎ একদিন বন্ধু পারভেজ হোসেনের মাধ্যমে খবর পেলাম যে তারেক মাসুদ আমাকে তাঁর মাটির ময়নার প্রিমিয়ার শোতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি যে আমাকে ভোলেন নি সেটা জেনে খুবই খুশি হয়েছিলাম। পরে রানওয়েনরসুন্দর ছবির প্রিমিয়ার শোতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন আমি যেন চলচ্চিত্রের ক্রিটিক লিখি। আমি প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম যে লিখব। লিখলেও আর সেটা তিনি দেখতে পাবেন না কোনোদিন!

তরুণ বয়সে তখনকার যে-সব তরুণের চিন্তা ও কর্মতৎপরতা ও কথাবার্তার অনুরাগী ছিলাম এবং গভীরভাবে যাঁদের মতামতকে বিবেচনা করতাম তারেক মাসুদ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কর্মপদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত কখনও কখনও হলেও সার্বিকভাবে তাঁর সমর্থকই ছিলাম। তিনি সেটা জানতেন। তাঁর নানা কাজে আমি খুব ছোটখাটো সহযোগিতাও করবার সুযোগ পেয়েছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মী হবার সুবাদে। তখনই অনুভব করেছি উদার ভাবে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। আমি অনুভব করতাম তাঁর নিজস্ব শিল্পতত্ত্বের শক্তি। তবে আমার মনে হচ্ছিল তাঁর প্রকৃত সৃষ্টিশীল কাজ এখনও করে উঠতে পারেন নি। ক্রমশ নিজেকে শক্তিশালী করে তুলছিলেন। প্রকৃত কাজ করবার প্রস্ততিপর্ব শেষ হয়েছিল কেবল। শিল্পবোধের দিক থেকে তিনি দার্শনিক একটা অবস্থানে উপনীত হয়েছিলেন অনেক আগেই! তাঁর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ ও অভিনিবিষ্ট। এস এম সুলতানের চিত্রকলা নিয়ে তিনি যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন তখনই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। সুলতানকে নিয়ে আহমদ ছফার প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলাম তাঁরই অনুপ্রেরণায় সে-কথা আগেই বলেছি। সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের শিল্পগত সৌন্দর্যও তিনি ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছিলেন আমাকে, মনে আছে। তাঁকে নিয়ে আরও কত স্মৃতি মনে পড়ছে! এখানে তা লিখে শেষ করা যাবে না। আজ আমি পেছনে তাকিয়ে দেখছি তারেক মাসুদ ছিলেন আমার অন্যতম প্রকৃত শিক্ষক। আমার জীবনদৃষ্টি বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার কোনও কোনও রূপ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলে ও তর্ক করে। ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক মানসিকতার অধিকারী। তাঁর মতন করে নিজের ব্যক্তিত্বে গণতান্ত্রিকতার চর্চা করেন এমন মানুষও আমি আমাদের সমসাময়িক কালে খুব বেশি দেখি নি। সেজন্যে মনে মনে তারেক মাসুদকে আমি আমার শিক্ষক মেনেছি অনেক আগেই! সলিমুল্লাহ খানের লেখার সূত্রে এ-কথাটি বলতে পারলাম বলে তাঁর লেখটির জন্য তাঁকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই!

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: আহমাদ মাযহার
ahmadmazhar01@yahoo.com


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts