সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস ‘মনের মানুষ” অবলম্বনে গৌতম ঘোষ একটি সিনেমা নির্মান করেছেন। বাংলাদেশের লালন গবেষক, আলোচক, পর্যবেক্ষক, ভক্তরা ‘মনের মানুষ’কে কিভাবে গ্রহণ করছেন এবং তাদের মূল্যায়ন কি – এ বিষয়কে সামনে রেখে বিডিনিউজ২৪ ডট কম আজ এক সেমিনার আয়োজন করেছে। আর্টস সম্পাদক ব্রাত্য রাইসু’র সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান, মানস চৌধুরী, অরূপ রাহী, সাইমন জাকারিয়া, ফাহমিদুল হক, নাসিফ আমিন, সাবরীনা চৌধুরী, মুসতাইন জহির, রাজু আলাউদ্দীন, রেজাউল করিম, অনিন্দ্য রহমান …[নাম আপডেট হবে]। আলোচনার ধারাবাহিকতা থেকে উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি সংক্ষিপ্তাকারে এখানে তুলে দিচ্ছি।
■ ফরহাদ মজহার
আমার কাছে মনে হয়েছে মনের মানুষ ছবিতে লালনকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। এর মধ্যে Perversion ছাড়া আর কিছুই নেই। লালনীয় গুরুবাদের মধ্যে রাজনীতির ধারণা আছে। অথচ মনে হচ্ছে লালন যেন আনন্দবাজারে একটা ব্রোথেল পরিচালনা করে।
■ অরূপ রাহী
লালনকে এই মুভিতে রিডাকশন করা হয়েছে। সাবঅলটার্নরা এ পর্যন্ত লালন নিয়ে কোনো চর্চা করেছেন বলে আমার জানা নাই। রঞ্জিত গুহ সুনীলের মনের মানুষকে যেভাবে প্রশংসা করেছেন তা একেবারে হতাশাজনক। সাবঅলটার্নদের চর্চা এতে বাধাগ্রস্থ হবে। কালচারাল ইন্ড্রাস্ট্রির একটা প্রোডাক্ট ছাড়া এটা আর কিছুই না। তবে এর রিপ্রেজেন্টেশনাল রাজনীতিটা বুঝতে হবে। লালনকে আমরা যেভাবে দেখি সেটা থেকে বিভ্রান্তির জন্য এটা একটা কুল মার্কেটিং প্রয়াস।
■ সাইমন জাকারিয়া
আমি এমনও শুনেছি তরুণদের মুখে, এ ছবি দেখার প্রতিক্রিয়ায়, গৌতম ঘোষকে দেখা হলে একটা থাপ্পড় দিতাম। সাধুদের গানের কথার যে গভীরতা সে প্রসংগে – লালন চর্চা কি এখন পর্যন্ত জাতপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? এই ছবি দেখে মনে হয় সাধু প্রকৃতির মানুষদের মধ্যে সেক্সুয়াল ফ্রিডম বেশী – এটা সাধু সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ ধারণা তৈরী করবে কিনা? তবে আমার মনে হয় ক্রিয়েটিভ সাধুদের পরিমাণ কমেছে, যদিও বিশুদ্ধ সাধুদের অস্তিত্ব এখনও রয়েছে।
■ সলিমুল্লাহ খান
মুভিটা দেখে মনে হলো লালন কোথাও পিকনিকে গেছে। তাদের জীবিকার কোনো ইংগিত নেই। সুনীল বলেছেন, ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসের কাহিনী মুখ্য নয়, আমি চেয়েছি লালনের মূলভাব ফুটিয়ে তুলতে যা প্রকৃতপক্ষে তার গানের মাধ্যমে ফুটে উঠবে। যদি এই হয় তার অবস্থান তবে সে মূলভাবই তো অনুপস্থিত এই উপন্যাস ও মুভিটিতে। ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্র যেমন কৃষ্ণ বা গৌতমের জীবনীতে দেখা যায় উচ্চবর্ণীয়, রাজন্যবর্গ যখন পরমাত্মার সন্ধানে বের হন, এর পর থেকে তাদের জাগতিক বিষয়াদির কোনো খোঁজ নাই। কিন্তু পরবর্তীতে বিশেষত ৫০০ বছরের মধ্যে যদি দেখি যেমন সে সময়ের বিখ্যাত সাধক কবীর, তিনিও শ্রমজীবি ছিলেন। লালনও শ্রমজীবি ছিলেন। সুনীল ফোটাতে চেয়েছেন লালনের মূলভাব কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি এর মাধ্যমে নিজের মূলভাব তুলে ধরেছেন। রঞ্জিত গুহ এই বই সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন সেটা পড়ে আমি হতাশ। পশ্চিম বাংলায় এখন যে জাগতিক সংকট দেখা দিয়েছে, আসুন সেজন্য শোক প্রকাশ করি। ভারতে এখনও ব্রাক্ষণ্যবাদ রয়েছে। এমনকি ১৫ই আগষ্ট যে ভারতের স্বাধীনতার দিবস – এইদিনটাও গণকেরা নির্ধারণ করেছে। তাদের মতে ১৪ই আগষ্ট অমঙ্গলের। এই উপমহাদেশে এখনও বর্ণবাদ প্রধান সমস্যা। অভিজাতের দৃষ্টিতে লালনকে দেখাই হচ্ছে এই ছবির প্রধান প্রতিপাদ্য। মনে হয়েছে রাতভর তিনি ঠাকুরকে তার কাহিনী শুনিয়েছেন খাজনা মওকুফের জন্য। সকালবেলা খাজনা মওকুফের ঘোষণা শুনে তার অভিব্যক্তি যেনো সেটাই তুলে ধরে।
■ নাসিফ আমিন
মনের মানুষকে যেভাবে দেখানো হয়েছে আনন্দবাজারে সেটা অবাস্তবিক, এর সাথে আমাদের যৌনতার দর্শনের সাথে, লালনের ভক্তিমূলক অবস্থান সাংঘর্ষিক।
■ মুসতাইন জহির
রঞ্জিত গুহ কখনই চৈতন্যকে লৌকিক বলবেন না। নিত্যানন্দকে বলবেন কিনা জানি না, কিন্তু লালনকে সহজেই বলে ফেলেছেন। এটা নিয়ে ভাবা উচিত। এই ছবিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি কোনো অর্থবোধক ডায়লগ শুনিনি। এ ছবির সুবাদে বাংলাদেশের সেকুলার একটা গোষ্ঠীর সাথে পশ্চিমবঙ্গের সেকুলার গোষ্ঠীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
■ সাবরীনা চৌধুরী
সিনেমটি একটা টেক্সট হিসাবে আমি একটু দেখতে চেয়েছিলাম। এই ছবিকে বলা হচ্ছে মিউজিকাল – কিন্তু সেটা নয়! কেউ বলেছেন এটা ন্যারেটিকাল, সেটা নিয়েও সমস্যা আছে!
■ সলিমুল্লাহ খান
এই ছবি মিউজিক্যাল না ন্যারেটিক্যাল সে বিষয়ে আমি বলতে পারি এই ছবিতে আনুপাতিক হারে সবই মেশানো হয়েছে যা ছবিকে জনপ্রিয় করে। জনপ্রিয়তা একধরণের সার্টিফিকেট দেয় যা এই ছবির ভুল মেসেজের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে প্রতিবন্ধক করে তুলবে।
■ [নাম আপডেট হবে]
এই ছবিতে লালনকে ভদ্রলোকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা ছবির বেশ কিছু ধারা দেখি, যেমন আর্টস ফিল্ম যার একটা ধরণ – এখন দর্শকবিহীন। এই ধারাটা ইউরো-আমেরিকান টেকনিক ব্যবহার করে উপমহাদেশের দারিদ্রকে তুলে ধরে যার সূচনা হয়েছিলো সত্যজিতের হাত ধরে এবং এই চর্চাটা পরবর্তীতে সত্যজিত স্কুল অব থটের অনুসারীরা বহাল রেখেছেন। এই ছবিতে তেমন করে আমাদের ড্রইংরুমের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
■ রাজু আলাউদ্দিন
আমার মনে হয় এই ছবিটা পপুলার হবে। কারণ এই ছবিতে এন্টারটেইনমেন্ট এলিমেন্ট আছে – যা একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত পছন্দ করবে।
■ ফাহমিদুল হক
এই ছবির টেক্সটের ভিতরে নান্দনিকতা বা জনপ্রিয়তার কিছু উপকরণ আছে। বিশেষত মিউজিক। পদ্মা নদীর মাঝি থেকে এ ছবিতে একধরণের শিফট আছে, একটা ঝকঝকে, গ্লসি ভাব ও চিত্রায়ন আছে।
■ মানস চৌধুরী
এই ছবিতে মিস্টি প্রেমের গল্প আছে। ডিসলোকেশন আছে। মধ্যবিত্তীয় পছন্দের ফোক ফ্যান্টাসী নির্ভর নানা উপকরণে সমৃদ্ধ। দ্রুতলয়ের গান আছে, যাকে আইটেম সং বলা যায়। মোটকথা এর ভেতরে জনপ্রিয়তার উপকরণগুলো আছে। তবে গৌতমের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাবাহিকতায় এ ছবি উত্তীর্ণ নয়।
আইরিন সুলতানা বলেছেনঃ
আলোচনায় উপস্থিত সকল ব্যক্তিবর্গের নাম জানতে চাই।
আইরিন সুলতানা বলেছেনঃ
এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে ব্লগার দিনমজুর একটি রিভিউ লিখেছিলেন সামহোয়্যার ইন ব্লগে। লালনকে কিভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তা পয়েন্ট আকারে ব্লগার দিনমজুর এর লেখাটি থেকে উদ্ধৃতি করছি –
১. ছবির ন্যারেটিভ কন্সট্রাকশান বা আখ্যান নির্মাণের জন্য লালনকে জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরায় বসিয়ে গল্প বলানো হয়েছে।
২. এই কথিত আনন্দবাজারে লালন ও তার শীষ্যদের কাজ হলো কেবল গান গাওয়া।
৩. আনন্দবাজারের লালন স¤প্রদায়ের যৌথ জীবনের শুধু যৌনতার অংশটুকু ছাড়া আরো কোন বিষয়ে কোন ডিটেল বা বিস্তারিত বর্ণনার কোন ঝোঁক আমরা পরিচালকের মধ্যে দেখি না।
৪. গোটা ছবিতে দেখা যায় লালন স¤প্রদায়ের প্রধান শত্রু হলো মোল্লা আর পুরুত মশাইরা আর প্রধান পৃষ্ঠ পোষক হলো জামিদার। অথচ মোল্লা-পুরুতদের পাশাপাশি বাংলার মানুষের ওরাল ন্যারেটিভ বা কথ্য ইতিহাসের মধ্যে জামিদার তন্ত্রের সাথে লালন সম্প্রদায়ের রীতিমত লাঠালাঠির ঘটনার উল্ল্যেখ পাওয়া যায়।
৫. ছবিতে তরুণ লালনকে দেখা যায় লালন হয়ে উঠার আগেই ”আর আমারে মারিস নে মা’র মতো গান গাইতে।
লেখার শেষ ভাগে ব্লগার দিনমজুর একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন,
ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র কি ইতিহাস যে ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা চরিত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নিক্তিতে মেপে উপস্থাপন করতে হবে?
উনি নিজেই এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন, লেখার মাধ্যমে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকরা এ বিষয়ে কী মনে করেন?
বাদশা মিন্টু বলেছেনঃ
সহজিয়া লালনকে ঘিরে কমাশির্য়াল সিনেমা তৈরি করা হয়েছে। লালনকে ধারণ করা হয়েছে কারো নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেখানে বতর্মানের পুঁজিবাদী আর সেক্সুয়াল পারভারশন সুস্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের লালন সহজিয়া যেমন তেমনি ভোগবাদী সমাজের সম্পূর্ণই বাইরে। বতর্মানের `ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কে লালন যে চোখে দেখেছেন তার ছিঁটেফোঁটাও নেই ছবিতে। লালনসঙ্গীদের জীবন আচরণও ঠিক এমনটা ছিলোনা। লালনের গানের ব্যবহার কোন ক্ষেত্রে কোনটি সেটা লক্ষ্য রাখা হয়নি। সাধু সঙ্গ বা অন্যান্য কালচার বিকৃত করা হয়েছে। এই বিষয়ে আরো গবেষণা করা উচিত ছিলো। প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো অনেক নিভৃতচারী লালনভক্ত আছেন। তাদের লালনভক্তি খাটো করা হয়েছে। মনের মানুষ বানিজ্যিক ঘরানার ছবি হিসেবে দুর্দান্ত। কিন্তু প্রধান চরিত্র যাকে ঘিরে তাকেই করা হয়েছে বিকৃত ।
আয়েশা মেহজান বলেছেনঃ
সমস্যার কিছু নাই। এক লালনকে দিয়ে যদি ফরহাদ মজহার বুদ্ধিজীবী হয়ে যেতে পারেন, তাহলে ওপার থেকে কেউ এসে কোটি টাকা কামাতে চাইলে ক্ষতি কি? যে যার মতো করে লালনকে বেছে নিয়েছে।
আইরিন সুলতানা বলেছেনঃ
এই লেখার লিংক ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করাতে, সেখানে Sami- Ul-Washek মন্তব্য করেন,
লালন যদি মুভিটা দেখতো, তাহলে বলতো: কিছুই করার দরকার নাই গো ঠাকুর, খালি পারলে আমারে নিয়া আর সিনামাটিনামা বানায়েন না।