অবশিষ্ট গীতিগুচ্ছ

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 24 June 2012, 04:05 PM
Updated : 24 June 2012, 04:05 PM

১০.
তীর ছোঁড়া হয়ে গেলে একবার
ফেরানো কি যায় কখনো তা আর?

ছাড়া-পাওয়া তীর ছোটে নিশানায়
গতিমুখ তার ঘোরানো না যায়
তারপর থেকে কোনো কিছু আর
থাকবে না ঠিক মতো আগেকার।

তীর ছোঁড়া হয়ে গেলে একবার
ফেরানো কি যায় কখনো তা আর?

বুমেরাং তবু ফিরে চলে আসে,
শিকার না পেলে, শিকারীর কাছে
তীরের তো আর নাই প্রতিকার
একরোখা তার গতি দুর্বার।

তীর ছোঁড়া হয়ে গেলে একবার
ফেরানো কি যায় কখনো তা আর?

১১.
কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

কোন-বা জলের জলজ আহা কোন ঝরনায় বাস
কোন অম্ল¬জানের হাওয়ায় নিচ্ছ তুমি শ্বাস
কোন ঝরনার জলে শোধন সারাদিনের গ্লানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

কোন ঘটনার অনুঘটক, কোন জারণের জারক
কোন উল্কার গতি তুমি, কোন কৃত্যের কারক?
উল্কারূপে আকাশ-মাটির মধুর কানাকানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

ভাব-উচাটন পুরুষ হলে প্রকৃতিস্থ হও।
কিংবা যদি হও প্রকৃতি, পুরুষরত রও।
জীব-পরমে পরস্পরে গভীর জানাজানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

কোন ধর্মের ধর্মী ওহে, কোন-বা রূপের রূপী,
রূপ থেকে রূপ-রূপান্তরে ফিরছ চুপিচুপি।
জড় থেকেই জীবে আসো, শিব থেকে শিবানী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

জন্মান্তর ঘুরে আসি তোমায় দেখার ছলে,
কোন রূপে ফের আকার পেলে? কোন মন্ত্রবলে?
আকার থেকে নিরাকারে, প্রাণ হতে ফের প্রাণী…
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

কোন মেঘেদের বিজলি তুমি, কোন-সে কুলের কেতু,
কেমন করে তুলব গড়ে যোগাযোগের সেতু?
মাঝে-মাঝে ঝলকে ওঠো হঠাৎ-ঝলকানি
মাঝে-মাঝে পাঠাও তুমি হঠাৎ-হাতছানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ॥

১২.
দই পাততে লাগে দইয়ের বীজ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ॥

বীজের গূণে একেক গাছে একেক ফল ধরে
ধুতরা ফুলেও মধু থাকে, জানে মধুকরে।
ময়লা জলেও জন্মে কেমন রঙিন সরসিজ!
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ।

দই পাততে লাগে দইয়ের বীজ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ॥

ফণিমনসায় কাঁটার ফণা, তারই ফাঁকে ফুল
কাঁটার সাথে পুষ্পমিথুন, মধুমাখা মূল।
কাঁটায় কেমন আগলে রাখে ফুলকে অহর্নিশ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ।

দই পাততে লাগে দইয়ের বীজ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ॥

মাটির গুণে একেক গাছে একেক ফল ধরে
মাটির টানেই সে-ফল সাধু ফের মাটিতে ঝরে।
কালোয় থেকেও আলো ছড়ায় কোন খনির খনিজ!
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ।

দই পাততে লাগে দইয়ের বীজ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ॥

১৩.
বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

বহু বছর আগে গোলকগাঁয়ের বাঁকে
চোখধাঁধানো আলোকধাঁধায় হারিয়ে ফেলি তাকে।
অনেক কাল ধ'রে খুঁজে ফিরছি, ওরে
ভুবনগাঁয়ের মেলা, বাজার, আড়ত, গুদামঘরে।
তোমায় ফেলে গেলাম চ'লে কোন-বা কুলক্ষণে!
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

বহু সময় ধ'রে সওদাপাতি ক'রে
ফিরে এসে পাই না খুঁজে, বিকল লণ্ঠনে…
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

উদ্ভ্রান্ত স্বরে হাহাকার ক'রে
শুধাই আমি জনে জনে, শুধাই মহাজনে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

খুঁজে ফিরছি রোজ, কিন্তু তোমার খোঁজ
কেউই দিতে পারছে না এ বেঘোর বরিষণে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

আমি তবু ছাড়ছি না হাল
সময় যতই বেতাল-মাতাল হোক না ঝড়ের তোড়ে
খোঁজার ব্রত, খুঁজেই যাব
খুঁজে একদিন ঠিকই পাব প্রবল মনের জোরে।
মগ্ন থাকি নিরন্তর তোমার অণ্বেষণে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

অন্য সবাই ভোলে ভুলুক
কিংবা খুঁজে পাক বা না পাক
কিংবা তোমার নামে ছড়াক কালি-কেলেঙ্কারি
যার যা খুশি ভাবে ভাবুক
কিংবা কেউই নিক বা না নিক
আমিই তোমায় ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নেব বাড়ি।
ফিরিয়ে আমি নেবই তোমায় আপন সে-ভুবনে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে।

বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ॥

১৪.
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ॥

ডাঙার বুকে ঢেউয়ের মরণ স্বেচ্ছা-সমর্পণ
স্মরণকালের সর্বমহৎ আত্মবিলোপন
কেউ কখনো দেখেছে কি কালে কালান্তরে?
লুপ্ত ঢেউয়ের কিছু স্মারক ডাঙায় রাখে ধ'রে।
ডাঙার গন্ধে পাগল-পাগল প্রচণ্ড উচ্ছলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা।

ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ॥

ডাঙার দেহে ঢেউ-স্মারকের প্রতীকগুলোর মানে
হচ্ছে লেখা ডাঙা-নদীর প্রেমের উপাখ্যানে।
প্রেম বাড়ে, প্রতীক বাড়ে, বাড়ে চন্দ্রকলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা।

ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ॥

ডাঙাটা তো জন্মবোকা, ভোলাভালা, হাবা
নদীটা কি তার কারণেই তরঙ্গ-স্বভাবা?
পূর্ণিমাতে জোয়ার-লাগা নদী রজঃস্বলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা।

ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ॥

ওই তো আবার ডাকছে ডাঙা নদীমোহন স্বরে
আধো-আধো নেশায় নদী ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ডাঙার গন্ধে উন্মাদিনী সদাই হরবোলা।
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা।

ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ॥

১৫.
মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন
ভেতর না সাজায়ে তুই সাজালি ভূষণ ॥

জানি না তোর ধর্ম-ধরন
বুঝি না তোর কর্ম-করণ
কেমন করে জানব ওরে কেমন যে তোর অন্তঃকরণ!

মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন
ভেতর না সাজায়ে তুই সাজালি ভূষণ ॥

না যদি তুই জ্বালাস আলো
আঁধারে সব অগোছালো
হয়ে যাবে এলোমেলো তোর যত সব সাধের সাধন

মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন
ভেতর না সাজায়ে তুই সাজালি ভূষণ ॥

চোখ যাবে তোর যথা-তথা
কান শুনবে ভিন্ন কথা
কেমনে করে হবে তোর এ চোখ ও কানের বিবাদ-মোচন!

মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন
ভেতর না সাজায়ে তুই সাজালি ভূষণ ॥

১৬.
তোমার সহগ হয়েই ঘুরি
তোমার সহগ হয়েই মরি
তোমার সঙ্গে সহমরণে
একই-সে চিতায় চড়ি ॥

তোমার দেহে যে রূপক-ভার
আমার শরীরে প্রভাব তার
অমায় কিংবা পূর্ণিমায়
জাগায় ঘোর জোয়ার।

তোমার সহগ হয়েই ঘুরি
তোমার সহগ হয়েই মরি
তোমার সঙ্গে সহমরণে
একই-সে চিতায় চড়ি ॥

আমার নিবিড় গভীরে স্বামী
তোমারই বিম্ব, অন্তর্যামী…
তোমারই দেখানো দিশায় আমি
তোমারই সঙ্গে চলি।

তোমার সহগ হয়েই ঘুরি
তোমার সহগ হয়েই মরি
তোমার সঙ্গে সহমরণে
একই-সে চিতায় চড়ি ॥

১৭.
মর্মী জানে মর্মব্যথা, অন্যে জানে না
প্রবোধ যতই দাও না কেন, মন তো মানে না ॥

চাতকী চায় বৃষ্টির জল
ওই জলই তার প্রিয় তরল
ও-জল ছাড়া অন্য কিছু তাকে টানে না
মর্মী জানে মর্মব্যথা, অন্যে জানে না

মর্মী জানে মর্মব্যথা, অন্যে জানে না
প্রবোধ যতই দাও না কেন, মন তো মানে না ॥

বইছে হাওয়া মধুক্ষরা
অধরা সব দিচ্ছে ধরা
চিত্তে তবু কোনো কিছুই শান্তি আনে না
মর্মী জানে মর্মব্যথা, অন্যে জানে না

মর্মী জানে মর্মব্যথা, অন্যে জানে না
প্রবোধ যতই দাও না কেন, মন তো মানে না ॥

১৮.
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে… কিংবা কীসের টানে
লোকগুলো আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়।
কীসের নেশায় ঘর ছেড়ে যায় কোন-সে রাহুগ্রাসে!
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

এ-মধুদিবসে আকাশে বাতাসে জাগে
ঘর ছাড়বার একটানা প্ররোচনা।
হারিয়ে পড়তে নদী মাঠ বায়ু ডাকে
ঘরে ঘরে তাই গোপন উন্মাদনা।
ঘরছাড়া হায় ঘর ছেড়ে যায় মধুর সর্বনাশে।
ঘরছাড়া হায় ঘর ছেড়ে যায় গোধূলির অবকাশে।
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

হারানো মানুষ সেই কত কাল ধ'রে
স্বজনের ভয়ে দেশ থেকে দেশে ঘোরে।
স্বজনেরা তবু নানান বাহানা ক'রে
বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে!
হারানো কেবলই হারাতেই থাকে, স্বজনেরা তল্লাশে…
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়।
স্বজন যখন নিরাশাদ্বীপের পথে
হারানো খুঁজছে নতুন এক অধ্যায়।
ধ্রুবতারা ওঠে, দিকদিশা ফোটে হারানো-র নীলাকাশে।
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে ॥

১৯.
স্বর্ণ যদি হয় এক নিরূপ আকার
অলংকার হয় তবে সোনার বিকার ॥

আকারে আর বিকারে
অলংকারে অলংকারে
আকারে-বিকারে অলংকারে ভরা এ অনিত্য সংসার।
অলংকার হয় তবে সোনার বিকার।

স্বর্ণ যদি হয় এক নিরূপ আকার
অলংকার হয় তবে সোনার বিকার ॥

ধাতু যদি হয় এক বিমূর্ত আকার
মারণকলগুলি হয় তবে ধাতুর বিকার।

আকারে আর বিকারে
ধাতুর অহংকারে
আকারে-বিকারে ধাতু-অহংকারে মত্ত আজব সংসার
মারণকলগুলি হয় তবে ধাতুর বিকার।

স্বর্ণ যদি হয় এক নিরূপ আকার
অলংকার হয় তবে সোনার বিকার ॥

২০.
তুমিই যদি যাও ছেড়ে তো কোথায় বলো রই তবে
তুমি ছাড়া এই অনাথের আর কে আছে এই ভবে?

তোমার মনের মেঘরোদ্দুর
বুঝতে আমার অনেকটা দূর
তুমি আমায় ফেললে হায় এ কেমনতর কৈতবে!
তুমি ছাড়া এই অধীনের আর কে আছে এই ভবে?

তুমিই যদি যাও ছেড়ে তো কোথায় বলো রই তবে
তুমি ছাড়া এই অনাথের আর কে আছে এই ভবে?

নাই যে আমার ধনকাঞ্চন
জীবন শুধু হরণপূরণ
তুচ্ছ জ্ঞানে একটু দিয়ো তোমার অতুল বৈভবের।
তুমি ছাড়া এই অধীনের আর কে আছে এই ভবে?

তুমিই যদি যাও ছেড়ে তো কোথায় বলো রই তবে
তুমি ছাড়া এই অনাথের আর কে আছে এই ভবে?

ক্ষণেই সুরের মেলবন্ধন
ক্ষণেই আবার ছন্দপতন
তবু দীনহীনকে ফেলে দীননাথ-বা কই রবে?
তুমি ছাড়া এই অধীনের আর কে আছে এই ভবে?

তুমিই যদি যাও ছেড়ে তো কোথায় বলো রই তবে
তুমি ছাড়া এই অনাথের আর কে আছে এই ভবে?

২১.
কুল ও কানাই কোনোটাই নাই পড়েছি বিষম ঘোরে
বিকারের ঝোঁকে রেখা যায় বেঁকে বৃত্ত রচনা করে ॥

বিশাল বৃত্তে বিষাদচিত্তে ছোট্ট বৃত্তচাপ
জেগে আছে একা- দূর থেকে দেখা জ্যামিতিক অভিশাপ।
যমুনার কালো জল ও জ্যামিতি পাল্টায় দ্রুত স্বরে
বিকারের ঝোঁকে রেখা যায় বেঁকে বৃত্ত রচনা করে ॥

কুল ও কানাই কোনোটাই নাই পড়েছি বিষম ঘোরে
বিকারের ঝোঁকে রেখা যায় বেঁকে বৃত্ত রচনা ক'রে ॥

কুলের মুখে তো দিয়ে চুনকালি, ছাড়লাম ঘর গৃহস্থালি
যমুনাতীরের কূট চোরাবালি ডুবিয়ে নিলো যে দিনদুপুরে
বিকারের ঝোঁকে রেখা যায় বেঁকে বৃত্ত রচনা করে ॥

কুল ও কানাই কোনোটাই নাই পড়েছি বিষম ঘোরে
বিকারের ঝোঁকে রেখা যায় বেঁকে বৃত্ত রচনা করে ॥

২২.
সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

শৈশবকালে অঝোর শ্রাবণে হয়েছিল সাক্ষাৎ
এতটা বয়স উজিয়ে এসেছে অবাক সে-ধারাপাত!
এসেছে যখন ঝরুক অঝোরে নামতা-পাঠের স্বরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

এসেছে যখন ঝরুক অঝোরে দেশ ও দেশান্তরে
মধুরস-সুরে ধারাপাত হোক শ্রুতিকে বধির ক'রে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ধারাপাত হতো পাঠশালা আর পড়শির আঙিনায়
আজও দেশে দেশে পুরাতন ধারা নতুন এক ঘরানায়।
আজও দিকে দিকে পুরাতন মেঘে নতুন বৃষ্টি ঝরে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ধারাপাতদেরই সংখ্যারা ঝরে ফোঁটা-ফোঁটা অক্ষরে
সংখ্যাধারাই বিবেচিত হয় বৃষ্টি, মতান্তরে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

পড়শিরা হায় কোথায় যে যায়, কে যে আজ কোন ভুবনে!
এক বর্ষায় ভেসে ওঠে তারা, ঝাপসা অন্য শ্রাবণে।
মুখগুলি আহা ফুটে ওঠে সব একটু একটু ক'রে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ইচ্ছামতন ধারাগান গেয়ে যাচ্ছে ইচ্ছামতী
বিচিত্র সুরে ফুলকি ঝরিয়ে সুরের সরস্বতী
সুরের আবেশ, মৃদু মৃদু রেশ, দিগদিগন্তরে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ডুবিয়ে জরুরি কথা ও কথিকা একটানা ধারাভাষ্যে
বৃষ্টি-বাতাসে ভীষণ বাহাস বইয়েছে লীলালাস্যে।
জল আর হাওয়া পরস্পরে মেতেছে মনান্তরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ভেসে যায় কালো কাফ্রি মেঘেরা গগনবিহারী দাস
উপরে তাদের খাঁ-খাঁ বৈশাখ নিচে তো শ্রাবণ মাস।
বোশেখ-শ্রাবণ সব একাকার বরুণদেবের বরে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

শ্রবণ ভিজছে মনন ভিজছে ভিজছে দেহের দাহন
এরই নাম কহে ভিজে যাওয়া আর এরই নাম অবগাহন।
ভেজানোর ছলে তন-মন-প্রাণ সব এলোমেলো করে।
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

ছড়িয়ে পড়ছে এই ধারাপাত অতীতে, ভবিষ্যতে
শাসন করতে ভেজা দেহমন নতুন ধর্মমতে।
ছড়িয়ে পড়ছে দূরদূরান্তে, ইথারে, বায়ুস্তরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে।

সকল বয়স ফিরে যেতে চায় বালকবেলার ভোরে
সব ইতিহাস লেখা হতে চায় শ্রাবণে নতুন ক'রে ॥

২৩.
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে
জাল ফেলে নিশ্চুপ। এত ধৈর্যের রূপ
আহা কোথাও তো দেখি না রে ॥

এমন জাদুর জালে কত মাছ ও শৈবালে
ছুটে এসে দেয় আত্মাহুতি।
তুমি জাত-জলদাস, তবু এ কী পরিহাস
মাছে তব জাগে অনুভূতি!

ধীবরের শাদা মন, সদা ভাবছ কখন
নদী ভাসে মাছের জোয়ারে!
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে ॥

ধীবর ও জালের লীলা, তরলে ভাসায় শিলা
ঘাই মারে মৎস্যরতন
জাল নয়, কালাচাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ত্রিভুবনে কী আছে অমন?

জালের মায়ায় ম'জে, ধীবরের খোঁজে খোঁজে
ধেয়ে আসে আধেয়, আধারে।
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে ॥

একে তো ঘোলাটে পানি, তদুপরি কানাকানি,
জলে নাকি কামঠ, কুমির
তবুও ধীবর বলে, কখন নামব জলে
মনপ্রাণ উতলা, অধীর।

মন তবু মানে তার, প্রাণটা তো অনিবার
ছুটে যায় ইশারা আকারে
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে ॥

এমন নদীর বাঁকে তেঁতুলের গাছ থাকে
তেঁতুল পাকতে থাকে ক্রমে।
কুমির কামুক বটে ঠেলিয়া ডাঙায় ওঠে
পাকা-পাকা তেঁতুলের ভ্রমে।

ধীরে ধীরে বয় বায়ু, আরো ধীরে পরমায়ু
বেড়ে যায় মীন-সংসারে।
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে ॥

জল ও জালের খেলা সারাদিন সারাবেলা
মাছেরা মারছে খালি ঘাই
জাল সে তো নয়, চাঁদ, মায়া লাগানোর ফাঁদ,
ওরকম আমার তো নাই!

ওপারে মীনের দেশ, লীলার তো নাই শেষ,
আমি থাকি নদীর এপারে।
তুমি তো ধীবর-জাত, সারাদিন সারারাত
বসে থাকো নদীর কিনারে ॥