রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কোভিড-১৯ এবং ভীত শিশুরা

ডেভিড স্কিনার
Published : 23 Jan 2012, 02:54 AM
Updated : 28 June 2020, 04:31 PM

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় কিভাবে কোভিড-১৯ এর সাথে লড়াই করছে তা মোটাদাগে দুইটি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে: নেতৃত্ব ও সক্ষমতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী মহামারী ঘোষণার তিন মাসেরও বেশি পরে এটি স্পষ্ট যে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কিছু দেশ ভাল করছে আবার অন্যরা ততটা নয়। যাদের আর্থিক সহায়তা দেবার সক্ষমতা রয়েছে শুধু তারাই নয়, বরং সবার মনে সবকিছুর আগে বিশ্বের সর্বাধিক প্রান্তিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের কথা আসা উচিত। আমরা যদি তাদের রক্ষা করতে না পারি, তাহলে বুঝতে হবে আমরা কোভিড-১৯ যুদ্ধে হেরে গেছি।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সমস্যা নয়। বাংলাদেশ সরকার পুরো জেলা জুড়ে লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন এই স্বাস্থ্য সংকটে সাড়া প্রদান করতে তারা সেভ দ্য চিলড্রেনসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করছে। 

তবে সক্ষমতা এখানে একটি সমস্যা। উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলায় মায়ানমার থেকে আসা প্রায় ৮৫০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ৪০০,০০০ বাংলাদেশি স্থানীয় জনগোষ্ঠি রয়েছে। এখানে যেসব বাংলাদেশি নাগরিকরা কেউ ধনী নন, বেশিরভাগই কৃষি কাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। শরণার্থীদের অবস্থা আরো শোচনীয়।

মিয়ানমারে নৃশংস সহিংসতা ও নির্যাতনের মুখে ইতিমধ্যে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার পরে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে বাস করছে। তারা কমিউনিটিতে যৌথভাবে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করে। তারা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পক্ষে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা থেকে পাওয়া খাবার খেয়ে দিন কাটায়। মায়ানমারে কয়েক দশকের বৈষম্য এবং শিবিরগুলিতে শিক্ষার অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা, স্বাক্ষরতা এবং সংখ্যাবৃত্তির স্বল্প দক্ষতা, সীমাবদ্ধ আস্থা প্রভৃতির ফলে শিবিরগুলিতে ভুল তথ্য প্রচারের পরিমাণ সর্বকালের শীর্ষে।

কোভিড-১৯ এখন শিবিরে পৌঁছে গিয়েছে যার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এবং মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল। কিন্তু তা স্বত্বেও এটি অনুমেয় যে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কোভিড-১৯ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে যেখানে আসলে নিউ ইয়র্ক শহরের চারগুণ বেশি ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে শরণার্থীরা বসবাস করছে। শিবিরের আবহাওয়া ভয়ের। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট থেকে ভালোভাবে বোঝা যায় যে, রোহিঙ্গা শিশুরা কোভিড-১৯ দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত। এই রিপোর্টে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ রোহিঙ্গা শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ে ভীত যেখানে ৪০ শতাংশ নিজে মরে যাওয়ার কিংবা পরিবারের কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে চিন্তিত। প্রাদুর্ভাব হ্রাস করার জন্য সকল রকম চেষ্টাই আমরা অব্যাহত রাখবো, কিন্তু সত্য হচ্ছে, যে আমরা এটা থামাতে পারবো না, ঠিক যেভাবে ইউরোপ, আমেরিকা এশিয়াতে থামানো সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ হবে অসুস্থদের সেবা করা এবং যতটা সম্ভব তাদের জীবন বাঁচানো। 

২৭ জুন সেভ দ্য চিলড্রেন কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবিরের প্রাণকেন্দ্রে একটি আইসোলেশন এবং চিকিৎসাকেন্দ্র উদ্বোধন করেছে যেখানে ৬০ জন পর্যন্ত কোভিড-১৯ নিশ্চিত ও সন্দেহভাজন রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এই কেন্দ্রটিতে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের সেবা দেওয়া হবে যাতে তাদের বিস্তৃত জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করা যায় এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যায়। আশা করি যারা গুরুতর অবস্থায় থাকবে তাদের মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সাথে সেবা দিয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে সক্ষম হবো এবং প্রয়োজনে কক্সবাজারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পাঠাতে পারবো। 

যদিও কঠিন বাস্তবতা হলো এগুলো পর্যাপ্ত নয়। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড-১৯-এ সাড়া দিতে সর্বোচ্চ এক হাজার থেকে পনেরশ অতিরিক্ত আইসোলেশন বেডের ব্যবস্থা করা হবে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য। সে হিসেবে শিবিরের ভিতরের ও বাইরের প্রতি হাজারে এক জনের জন্য একটি বেড বরাদ্দ থাকবে। শিবিরের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অসুস্থ ও গুরুতর রোগীদের জীবন কল্পনাতীতভাবে কঠিন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় সেভ দ্য চিলড্রেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল (মোবাইল হেলথ টিম) গঠন করছে যাতে করে যেসব শরণার্থীরা অসুস্থ এবং চিকিৎসাসেবা দরকার কিন্তু আইসোলেশন কেন্দ্রে বেড পাবে না বা যেতে পারবে না তাদের সেবা পৌঁছে দিতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিবিরে কোভিড-১৯-এ আমাদের সাড়া প্রদানের বড় অংশজুড়ে থাকবে মোবাইল হেলথ টিম যারা নিশ্চিত করবেন যে আমাদের সেবাদান আইসোলেশন কেন্দ্রের বেডে সীমাবদ্ধ নয়। 

এই মহামারী শেষ হলে, আমাদের অবশ্যই যৌথভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সমবেদনা, ন্যায়বিচার এবং প্রতিশ্রুতি দাবি করতে হবে। পুরো পৃথিবী তাদের কাছে ঋণী। যারা তাদের পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবশ্যই মায়ানমারে তাদের নিজ শহর ও গ্রামে নিরাপদে এবং মর্যাদার সাথে ফিরে যেতে হবে। কক্সবাজার এবং মায়ানমার উভয় ক্ষেত্রেই তাদের উপর প্রভাব ফেলবে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবশ্যই তাদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সরকার, দাতা এবং সংস্থাগুলোর প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত তাদের অধিকার। 

এই মুহুর্তে বিচলিত না হওয়া ছাড়া উপায় নেইআমাদের নিজস্ব সহকর্মীসহ অনেক মানুষ এই বিপর্যয় এড়াতে কঠোর পরিশ্রম করছেন, তবে যা কিছুই করা হয়েছে তা যথেষ্ঠ হবে না বলে একটি সত্যিকারের উদ্বেগ রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর পরিধি নির্ভর করবে এখন নেওয়া পদক্ষেপের উপর। যখন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবশ্যই আশা করা উচিত যে তাদের ভবিষ্যত তাদের অতীতের চেয়ে ভাল হবে তখন তারা আরও একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।