অনুজের জন্য এলিজি

ফখরুজ্জামান চৌধুরী
Published : 6 March 2011, 05:42 AM
Updated : 9 March 2013, 03:51 PM

অনুজ আমার চলে গেল। ঝড়ের পাখি অ্যালবাট্রসের মতো ২৬ ফেব্রুয়ারি , রাত গভীরেই মোটামুটি বলা যায়। এসেছিলো আমাকে দেখতে । খোকা এল হাসপাতালে, এ দফা আমার অবস্থানকালীন শেষ রাতটিতে। সঙ্গে আমার বোনের বাসায় সব কাজ করা মানুষটি, মালেক যার নাম। ওর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার।

ইতোমধ্যে প্রায়ই আমার শরীর বিকল হয়ে যেত। ২০০৯ সালের শেষ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর শীতের তীব্রতায় আমার ভেতরকার নানারকম রোগ মাথা জাগিয়ে উঠতে থাকে। খোকা ঢাকা থেকে অনুযোগ করে ফোন করত। বলত, 'তুমি আর ভাবি ওখানে কী দুঃখে গেছো? আমার স্নেহের ভাইঝি জুবায়রা, ও পুত্রতুল্য জামাই ইফতিখার জানি জাগতিক সব সুযোগ-সুবিধায় তোমাদের আবৃত করে রাখবে। কিন্তু পারবে কি ওরা তোমাদের ঢাকার শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য জগতের বৈভব দিতে? বড় ভাইঝি কানাডার টরেন্টোতে শুনি তোমাদের টানাটানি করছে। পারবে কি ওরাও তোমাদের এত বছরের যাপিত জীবনের স্বাদ দিতে? অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও যে জীবন আপন মহিমায় উজ্জ্বল।'

শুনে হাসি। খোকা কখনও আমার সঙ্গে এমন দীর্ঘ আর নিবিড় কথা বলেনি।


আমার প্রতি ছিল তার এক ধরনের মুগ্ধতা-মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ। দেখা হলে নানা রকম উপদেশ দিতাম, বকাঝকাও করেছি কখনও কখনও। বকাঝকায় ছিল তার ভীষণ আপত্তি। তাই তার ভাবিকে এবং আমার অন্যতম সুহৃদ এনটিভির অনুষ্ঠান-প্রধান মোস্তাফা কামাল সৈয়দকে বলত, 'ভাইয়ের কাছে যে যাব, তিনি তো বকাঝকা করেন।' করতাম, কারণ কী এক অনির্ণীত তাড়নায় এমন জীবনবিমুখ হয়েছিল সে যে তা আমাদের কারও পছন্দ ছিল না।

লেখাপড়ায় তুখোড় ছিল খোকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ষাট দশকের উজ্জ্বল সময়ে সমাজতত্ত্বে সম্মানসহ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করে সর্বোচ্চ আসন নিয়ে। ভালো রেজাল্টের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষকের চাকরিও পেয়ে গেল, আর আমি তখন সাধারণ সরকারি চাকরির চোরা ময়দানে জীবনের দর্শনের জন্য অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াই।

তখন থেকেই খোকার স্বাধীন সত্তা প্রকট হতে থাকে। কারও সঙ্গে থাকা, কারও সঙ্গে থেকে দীর্ঘ অবস্থানকালীন সময়ে সম্পর্কের ওপর কোনোরকম আঁচড় ফেলতে দিত না তার ব্যবহার। আপন আলয় খুঁজে নিয়েছে নিজের মতো। তার কোনো আলয় ছিল কি? আসলে সত্যিকার অর্থে অনিকেত ছিল সে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তৎকালীন আরসিডিভুক্ত তিন দেশ (রিজিওনাল কোঅপারেশন ফর ডেভলপমেন্ট) পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইরানে এক সংক্ষিপ্ত সফরে যান। ইরান ও তুরস্ক ঘুরে এসেই খোকা অনির্ভর সূত্রে একটি খবর পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। না, ঠিক ভেঙে পড়া বললে তার প্রতি অবিচার করা হয়, আসলে সে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। কে একজন খুব 'নির্ভরযোগ্য' সূত্র উল্লেখ করে খোকার কানে কানে জানায়, তার রাজনৈতিক পশ্চাদপট বিবেচনায় অচিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর গভর্নর মোনায়েম খান আরও ক'জন নবনিযুক্ত শিক্ষকের সঙ্গে তাকে চাকরিচ্যুত করার পরিকল্পনা করছেন। খোকা মুহুর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাকে অপমান করার সুযোগ সে কাউকে দিতে রাজি নয়। আমাদের সবার অজ্ঞাতে ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে শৃঙ্খলমুক্ত প্রমিথিউসের মতো খোকা এসে দাঁড়াল আমার সামনে। বলল চাকরি ছাড়ার ইতিবৃত্ত।

বললাম, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হুট করে এত বড় কাজ করা ঠিক হয়নি। দি নিউজ কুড বি এ হোক্স! বলল, দুঃসংবাদ কদাচ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে জানা গেল, ওটা ছিল নিছকই গুজব। কোনো স্বার্থাণ্বেষী মহলের প্রচারণা। উদ্দেশ্য সহজবোধ্য। অনিশ্চয়তার সমুদ্রের কালো জলরাশি খোকার চারধারে। আমার প্রাথমিক চাকরিজীবনে স্বল্প রোজগারে তাকে তেমন সাহায্য করার সুযোগও ছিল না।

কিন্তু তার চরিত্রে বসে বসে মার খাওয়া ছিল না। তাই শিগগির গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। বলল, সাংবাদিকতা করব, এবং অবশ্যই সিনে-সাংবাদিকতা। এক দুপুরে তাকে নিয়ে হাজির হলাম জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজের কাছে। পারভেজ ভাই প্রসন্নচিত্তে প্রসারিত হাতে গ্রহণ করলেন তাকে। বললেন, আপনার ছোট ভাই, আমারও ছোট ভাই। ভ্রাতৃত্বের উষ্ণতায় তাকে আগলে রাখলেন।

সিনে জার্নালিজমকে খোকা কোন উচ্চতায়, কোন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, তা আজ ইতিহাস। চলচ্চিত্রের কাহিনী বিনির্মাণে, সংলাপ-সঙ্গীত-চিত্রনাট্য রচনায় তার উৎকর্ষ, সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে। কত পুরষ্কার, কত প্রশংসা, কিছুই তাকে নাড়া দিত না। দার্শনিক নির্লিপ্ততার বাত্যাবরণে ঢাকা ছিল তার জীবন।

আমার বর্তমান অসুস্থতা-ক্লিষ্ট জীবনে তার সাথে শেষ দেখা হল না। তবে আমার হাসপাতাল-জীবনের শেষ রাতে সে এসেছিল আমাকে দেখতে। হয়তো এসেছিল আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে; নাকি আমাকে ঝাড়ফুঁক করে সে আমার রোগ নিজের শরীরে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে ফিরে গেল ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতের প্রথম প্রহরে।

এসব দুর্জ্ঞেয় রহস্যের কথা আমাদের অগম্য। আকাশ আর জমিনের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে হোরেশিও যা আমাদের স্বপ্নেও দূরাগত।

ফখরুজ্জামান চৌধুরী :প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সদ্যপ্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরীর অগ্রজ।