ভেঙ্গে যাওয়ার আগে রাজমনি-রাজিয়ার শেষ ‘শো’

বোরহান বিশ্বাস
Published : 20 Oct 2019, 11:35 AM
Updated : 20 Oct 2019, 11:35 AM

'রাজমনি' ও 'রাজিয়া' একই মালিকের দুটি সিনেমা হল। একই ভবনেই অবস্থিত। রাজমনির দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৯০০; আর রাজিয়ার ২৪৩। ভেঙে ফেলার ঘোষণা আসার পর রাজমনি হলের ভেতরের যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়া শুরু হয়। 'রাজিয়া' হলেরও ভাঙার কাজ শুরু হবে।

১৮ অক্টোবর। শুক্রবার। বেলা ৩টা। রাজিয়া হলে সর্বশেষ শো চলছে। এরপর থেকে আর কখনো এ নামের হলটিতে কোনো সিনেমা দেখানো হবে না। নীচের টিকেট কাউন্টারে একজনমাত্র দর্শক। টিকেট কিনে রাজিয়ার দিকে ছুটলেন। কাউন্টারের ভেতরে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব কফিল উদ্দিন। যিনি ৪০ বছর রাজমনি ও রাজিয়া সিনেমা হলে টিকেট বিক্রি করেছেন।

শেষ দিনের অনুভূতি  প্রকাশ করে নরসিংদীর এই ক্ষীণকায় মানুষটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,  "অনেক স্মৃতি রইছে। কি বলমু! মালিক নিজে আমারে এখানে নিয়ে আসছিলেন। চল্লিশটা বছর কাটাইয়া দিলাম। একটা সময় ১৩ টাকার টিকেট ১০০ টাকায়ও বিক্রি করছি। ওই যে নেট আইছে না? এর জন্যই তো দর্শকরা হলে আসে না।"

টিকেট কাউন্টারের লবির দেয়ালে 'গুন্ডা পুলিশ' ছবির পোস্টার দেখে বোঝা গেল এটিই রাজিয়ায় প্রদর্শিত শেষ চলচ্চিত্র।

আক্ষেপ করে কফিল উদ্দিন বলেন,  ৩টার শোতে এ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি টিকেট বিক্রি হয়েছে।

"এক সময় রাজমনি, রাজিয়ার সব টিকিটই অগ্রিম বিক্রি হইয়া যাইতো। ব্ল্যাকে বিক্রি হইতো।"

পাশের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় মূল ফটকের সামনে একজনকে বসে থাকতে দেখা গেল। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তিনি হলের গেটকিপার। নাম সাত্তার কাজী। ৩৬ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন।

পেছনের দিনগুলোর কথা উঠতেই বিষন্ন মনে সাত্তার কাজী বলেন,  "শোর সময় এই রাস্তা দিয়া মানুষের চলাচল কঠিন হইয়া যাইতো। দর্শকগো ভিড় ঠেকাইতে যুদ্ধ করতে হইতো। যেই পরিমাণ মানুষ শো দেখতো, তার চেয়ে বেশি মানুষ হলের উপরে-নিচে দাঁড়াইয়া থাকতো। একেকটা ছবি তিন-চার সপ্তাহ চলতো। অহন তো মাসে একটা ছবিই ঠিক মতো আসে না। সালমান শাহ্ নাই, মান্না নাই! ছবি চলবো কইত্থিকা!"

হঠাৎ একটি লেখায় দৃষ্টি আটকে গেল। মূল ফটকের উপরে লেখা 'রাজমনি পূর্ণ, শো শেষ হওয়ার পূর্বে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ, রাজিয়া পূর্ণ'।

জানা গেল, প্রতি শোতে দর্শক আসন পূরণ হয়ে গেলে হলের বাইরের দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য লেখা সংবলিত বোর্ডটির ভেতরের বাতিটি জ্বালিয়ে দেওয়া হত।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাতের বাঁ দিকে একটি লেখা চোখে পড়লো- যারা স্বাধীনতার ইতিহাস জানেন না, তাদের জন্য এই চলচ্চিত্র 'পূর্ব পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ'। ছবিটি পরিচালনা করেছেন রাজমনি-রাজিয়ার মালিক মুক্তিযোদ্ধা আহ্সান উল্লাহ মনি। হলে নারীদের বসার জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা ছিল সেটিও চোখে পড়লো।

বিশাল লবি আর সুনসান নিরবতা।

"শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজমনি-রাজিয়ার এমন চিত্র সত্যিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চরম দুরাবস্থার কথাই মনে করিয়ে দেয়", বললেন  দীর্ঘদিন ধরে হলে কাজ করে আসা মো. সেলিম।

তৃতীয় তলায় রাজিয়াতে শেষ প্রদর্শনী চলছে। হলের ভেতর থেকে ডিজিটাল সাউন্ডে মারপিটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলাম।

চতুর্থ তলায় 'মাস্টার বিজনেস' আমদানি ও রপ্তানিকারক কক্ষ। সেখানে অবশ্য কারো দেখা পাওয়া গেল না। তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা গেল কক্ষটি।

শেষবারের মতো রাজিয়াকে দেখে নামার সময় চোখ গেল ম্যানেজারের কক্ষের দিকে। দুজন ভদ্রলোক বসা। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে কথা বললেন জিয়াউল আলম। দুমাস হল এখানে এসেছেন। তিনি আছেন মূলত জোনাকি হলের দায়িত্বে। এখানেও সময় দেন।

জিয়াউল আলম বলেন,  "রাজমনি-রাজিয়া ভেঙে যে বহুতল ভবনটি নির্মাণ করা হবে, তাতে চলচ্চিত্র দেখানোর কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। তবে সোনারগাঁওয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ভালো কিছু করার ইচ্ছে আছে হল মালিকের।"

এই কক্ষেরই অন্য একটি চেয়ারে বসে আছেন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. নুরুল ইসলাম। রাজমনি-রাজিয়ায় তিনি আছেন ৪০ বছর। হল মালিকই তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে নুরুল ইসলাম বলেন,  "আগে সপ্তাহে ৩-৪টা ছবি আসতো। এখন মাসে একটা ছবি আসতেই সমস্যা হয়ে যায়। শুধু সাউন্ড ভালো হলেই তো হয় না। ছবির চিত্রনাট্য, পরিচালনা, অভিনয়- সবই দরকার আছে।"

রাজমনি-রাজিয়ার সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক হলমুখো দর্শকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল একটা সময়। দর্শকদের মিষ্টি মুখ করানোর মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালের ৩ মার্চ রাজমনির যাত্রা শুরু হয়েছিল। শেষটা বড় করুণ, বিষাদের।

রাজধানী কেন্দ্রিক সিনেমা দর্শকরা এখানে আসতেন তাদের প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনীত চলচ্চিত্র দেখতে। ইট-পাথরে গড়া হল দুটি আপাতদৃষ্টিতে ভেঙে যাবে। কিন্তু অনেক সিনেমা পাগল দর্শকের মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে রাজমনি-রাজিয়ার স্মৃতি।