খিলগাঁওবাসীর কাছে এখনও অধরা জোড়পুকুর মাঠ

বোরহান বিশ্বাস
Published : 19 Feb 2020, 06:45 PM
Updated : 19 Feb 2020, 06:45 PM

২০১৭ সালে 'জল সবুজে ঢাকা' নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এই প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর ৩১টি মাঠ আধুনিকায়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায় খিলগাঁও জোড়পুকুর মাঠে শুরু হয় আধুনিকায়নের কাজ।

দুই পর্যায়ের কাজের প্রথম পর্যায় (সবুজ ঘাসের মাঠ তৈরি) শেষ হয় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মাঠের বাইরের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়। মাঠের দায়িত্বে থাকা প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ হাসান এমনটিই জানান।

কাজের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন,  "দ্বিতীয় প্যাকেজের ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়া গেছে গত জানুয়ারি মাসে। এখন সামান্য কিছু কাজ বাকি রয়েছে। কাজ চলমান থাকলে দুই মাসের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে।"

তিনি বলেন, মাঠের ভেতরে ও বাইরে ৪৮টি এলইডি লাইট বসানোর কাজ প্রায় শেষ। মাঠে সার্বক্ষণিক পানি দেওয়ার জন্য চারপাশে থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা; ১৩টি স্প্রিং কিলার পয়েন্ট।

তবে একসঙ্গে সবগুলো পয়েন্ট থেকে পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার করে পানি দিতে হয়।

মাঠের ঘাস রক্ষায় কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে দুটি সময় নির্ধারণ করে দেয় খেলাধুলার জন্য। কিন্তু পরবর্তী সময় দেখা যায়, উৎসুক জনতা প্রায় সারাদিনই মাঠটি ব্যবহার করছেন। ভোর থেকে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত চলতে থাকে খেলাধুলা। ফলে এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশন বাধ্য হয়ে মাঠটি বন্ধ করে দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়।

মাঠের চারপাশ জুড়ে লাগানো এলইডি লাইটও বন্ধ করে রাখা হয়। এতে ভূতুড়ে অবস্থা তৈরি হয়। মাঠের ভেতরে খেলাধুলার পাশাপাশি বাহিরে নারী ও বয়স্ক পুরুষদের হাঁটাহাঁটিও বন্ধ হয়ে যায়।

অন্ধকারে কিছু উঠতি বয়সী তরুণরা গাঁজার আসর বসায় বলে এলাকাবাসীদের অভিযোগ রয়েছে। নিরাপত্তার অভাব ও গাঁজার উৎকট গন্ধে স্থানীয়দের অনেকেই এখন রাতে মাঠের পাশ দিয়ে চলাচল করতে সঙ্কোচবোধ করেন।

গৃহিণী শামিমা আক্তার বলেন,  "এলাকায় হাঁটার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। মাঠের বাইরে রাতের বেলায় বেশ কিছুদিন লাইটগুলো জ্বলেছিল। অনেক মহিলা-পুরুষ তখন মাঠের পাশে ওয়াক ওয়েতে হাঁটতে আসতেন। লাইট বন্ধ থাকায় এখন আর কেউ আসেন না। মাঠের আশপাশে অপরিচিতদের আড্ডা বসে। সিগারেটের গন্ধে সেখানে যাওয়া মুশকিল।"

বিষয়টি নিয়ে জল সবুজে ঢাকা প্রকল্পের প্রধান নকশাকার স্থপতি রফিকুল আজমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, নারী, শিশু এবং বয়স্কদের কথা চিন্তা করে মাঠের বিভিন্ন স্থানে 'ধূমপানমুক্ত' ছোট ছোট সাইনবোর্ড হয়তো আমরা লাগিয়ে দিতে পারি। দেখভালের জন্য কিছু লোকও থাকবে।

তবে সার্বিকভাবে মাঠকে টিকিয়ে রাখতে এলাকাবাসীকে  এগিয়ে আসতে হবে জানিয়ে এর জন্য স্থানীয়ভাবে কমিটি করার কথাও বলেন তিনি।

সম্প্রতি এই মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে স্লাব তৈরির কাজ চলছে। এগুলো প্রিকাস্ট স্লাব যা মাঠে সিঁড়ির কাজে ব্যবহার করা হবে বলে কর্মীরা জানালেন।

সন্ধ্যার পর মাঠ অন্ধকার থাকা প্রসঙ্গে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ হাসান বলেন, বিদ্যুতের মিটার লাগানোর কাজ এখনো শেষ হয়নি। হলেই লাইন চালু হবে। এর আগে কিছুদিনের জন্য কন্ট্রাক্টে লাইন নেওয়া হয়েছিল বলে তিনি জানান।

দেখা গেল, মাঠের উত্তর কোনো প্রধান ফটক ও এর সঙ্গে প্লান্টার বক্স নির্মাণের কাজ চলছে। দক্ষিণের দেয়ালে চলছে মার্বেল লাগানোর কাজ। কফিশপের ভেতরে চলছে ইলেক্ট্রিক কাজ। এছাড়াও, কিচেন, ওয়াশরুম ও মনিটরিং রুমের কাজও শেষ পর্যায়ে।

মাঠের বাইরে শিশুদের জন্য বিশেষ জোন 'বাটার ফ্লাই এরিয়া'। এখানে ফুল ও ছোট ছোট বাঁশ গাছ লাগানো হবে। বাটার ফ্লাই এরিয়ার নামকরণ প্রসঙ্গে জানা গেল, এখানে এমন সব ফুল গাছ লাগানো হবে যার উপর প্রজাপতি এসে বসবে। এসব দেখভালের জন্য চারজন নিরাপত্তাকর্মী ও দুজন মালি রাখার কথা রয়েছে।

নান্দনিক সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে স্থাপিত পানির ফোয়ারার কাজও প্রায় শেষ। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটি চালু করা হবে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মাঠ ও মাঠের বাইরে যে ১৪টি সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা জানা গিয়েছিল সেই কাজটি এখনো শুরু হয়নি।

মাঠটির সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় থাকা মো. সুরুজ মিয়া বলেন, মাঠ ব্যবহারের নিয়ম মানা হয়নি বলে মেয়র সাহেব পরীক্ষামূলকভাবে খুলে দেওয়া পর অনেকদিন তালা মেরে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। যখন-তখন মাঠ ব্যবহার করলে ঘাস টেকানো যাবে না। মাঠেরও বিশ্রাম দরকার আছে।

গত ১১ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন জোড়পুকুর মাঠে উপস্থিত থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাঠ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ও মেয়র সাঈদ খোকন উপস্থিত থেকে নতুন সাজে সাজানো খিলগাঁও জোড়পুকুর মাঠের উদ্বোধন করেন।

মাঠের কাজ নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের ১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওয়াহিদুল হাসান মিল্টন বলেন, পুরো কাজ শেষ করে আগামী ৩০ মার্চের মধ্যে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

তবে এখনো ২০ ভাগ কাজ বাকি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে মাঠের চারপাশে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে।

তবে এখনও মাঠের কাজ শেষ না হওয়ায় খিলগাঁও তিলপাপাড়ার ক্রীড়াবান্ধব কিশোর-তরুণ ও বয়স্কদের অনেকেই মনোক্ষুন্ন। মাঠ পেয়েও যেন পাচ্ছেন না তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রীড়া সংগঠক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, "মাঠের সংস্কার কাজের জন্য কয়েক বছর খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত ছিল এলাকার শিশু-কিশোররা। সুন্দর একটি মাঠের জন্য তারা অপেক্ষা করেছে দীর্ঘদিন।

"আজ যখন মাঠ হলো, সেটিও আবার নানা নিয়মের বেড়াজালে বন্দি। সেই নিয়ম মেনে যখন আমরা চলতে শুরু করলাম মাঠ বন্ধ করে দেওয়া হলো। কিছুদিন আগে মাঠ উদ্বোধন করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে ঘাস বাঁচাতে আরো কিছুদিন পর খেলা শুরু করতে হবে। রাতে লাইটগুলোও জ্বলছে না।"

বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুস সাত্তার বলেন,  "আমি ও আমার স্ত্রী ডায়াবেটিস রোগী। আগে গলিতে দুজনে হাঁটাহাঁটি করতাম। কিছুদিন মাঠের ওয়াক ওয়েতে হেঁটেছি। এখন রাতে মাঠ অন্ধকার থাকায় ও নিরাপত্তার কারণে আবার গলিতে হাঁটা শুরু করেছি।"

স্থানীয়রা মনে করেন, মাঠের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে এর সুফল ভোগ করা যাবে না। মাঠের বেশির ভাগ অংশই উন্মুক্ত। বাতাস ও দৃষ্টিনন্দনের জন্য এটি ভালো।

তবে ঠিকভাবে দেখভাল না হলে সেটিই হয়তো এক সময় কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ জন্য সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং ব্যবস্থার কথা বলেন তারা।