ভ্যানে সাজানো জীবিকার পসরা

বোরহান বিশ্বাস
Published : 16 May 2020, 12:13 PM
Updated : 16 May 2020, 12:13 PM

অদৃশ্য এক ভাইরাস মানুষের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে। অতি সংক্রামক এই ব্যাধি থেকে বাঁচতে অধিকাংশ নগরবাসীকে  স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর একটি অংশ জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বেরুতে বাধ্য হচ্ছেন। কাক ডাকা ভোরে ভ্যান নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন পাইকারি মার্কেটে। পসরা সাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নগরীর বিভিন্ন অলি-গলিতে।

নুরুদ্দিন এক সময় পাইকারি চালের দোকানে কাজ করতেন। বিক্রি হওয়া চাল মাথায় করে মানুষের বাসায় দিয়ে আসতেন। মাস দুয়েক আগে মালিকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর ওই কাজ ছেড়ে দেন তিনি।

সিদ্ধান্ত নেন, আর কারো অধীনে কাজ করবেন না, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করবেন। সেই থেকে ভ্যান ভাড়া নিয়ে শুরু তার সবজি বিক্রির জীবন।

গোপালগঞ্জের আব্দুস সালাম ভ্যানে করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুন বিক্রি করেন। গরমে চোখের চশমা ঘামে ভিজে নাকের ডগায় এসে ঠেকে তার। মাথায় গামছা বেঁধে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনি থেমে থেমে ডেকে ওঠেন, 'ওই পিঁয়াইজ, আদা, রসুন।'

বিকাল ৪টায় চলে যান শ্যামবাজার। সেখান থেকে পাইকারি মাল কিনে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রায় মধ্য রাত পর্যন্ত পেঁয়াজ, রসুন বাছাই করেন। ভোরে ভ্যান নিয়ে বের হয়ে পড়েন।

সালাম বলেন, প্রতিদিন প্রায় দুশো কেজি পেঁয়াজ, এক বস্তা আদা ও রসুন বিক্রি হয় ভ্যানে।

বিকালের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। ভ্যানটি তার নিজের নয়। দিন ১০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। মালিকের এমন আরো ৫০টির মতো ভ্যান আছে বলে জানালেন।

নন্দীপাড়ার আবুল হোসেন আগে রিকশা চালাতেন। এখন ভ্যানে করে তরকারি বিক্রি করেন। লেবু, কাঁচামরিচ, কুমড়া, লাউ আর শসার পসরা সাজিয়ে ঘুরে বেড়ান আশপাশের এলাকা। সবজি কেনার ফাঁকে কথা হলো তার সঙ্গে।

জানা গেল, আগে নিয়মিত রিকশা চালাতেন।  মহামারী শুরুর পর রিকশা চালিয়ে মালিকের জমা পরিশোধের পর তেমন কিছু থাকে না। তাই ঠিক করলেন, ভ্যানগাড়ি ভাড়া নিয়ে সবজি কিনে এনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করবেন।

তার ধারণা, এসময় ভয়ে অনেকেই এখন বাজারে যেতে চান না। বাড়ির সামনে ভ্যান থেকে সবজি কেনেন।

আবুল বলেন, অনেক রিকশাচালকই এখন ভ্যানে সবজি বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।

পড়ন্ত বিকালে বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ ও কিছু শসা নিয়ে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন রেজাউল। ২৭ বছর ধরে ঢাকায় আছেন তিনি। কয়েক বছর ধরে ভ্যানে নিয়মিত সবজির ব্যবসা করে আসছেন।

ডাক দিতেই তিনি বলেন,  "নিবেন নাকি? এই কয়টা মালই আছে। বেচতে পারলে চইলা যামু।"

কথায় কথায় জানলাম, খিলগাঁওয়ে তার পরিচিত কিছু ফার্নিচার ব্যবসায়ী এখন ভ্যানে ফলমূল বিক্রি করছেন। লকডাউনের ফাঁদে তাদের এই দৈন্যদশা।

রেজাউল বললেন,  "অনেক মানুষই এহন শাকসবজি বিক্রি করে। আগের মতো বেচাকেনা নাই। যেই লেবু কয়েকদিন আগে ৪০ টাকা হালি বিক্রি করছি অহন ১০ টাকায়ও কেউ কিনতে চায় না।

"কাস্টমার কয়জনের কাছ থেইকা কিনবো! দিনে ৫০০ টাকা কামাইতেই খবর হইয়া যায়। তাই চিন্তা করছি, চাইনিজ তরমুজ আর বাঙ্গি আইনা বেচা শুরু করমু। বিকাল ৩টা থেকে ইফতার পর্যন্ত ভালোই যাইবো।"

তিনি বলেন, "ভোর চারটায় কখনো যাত্রাবাড়ি, কখনো কারওয়ানবাজার চলে যান পাইকারি সবজি আনতে। এরপর সারাদিন  ঘুরে তা বিক্রি করেন। দিনের জিনিস দিনেই বিক্রি করার চেষ্টা করেন। কখনো বিকালেই সব বিক্রি হয়ে যায়। কখনো কখনো রাত পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। তখন কেনা দামের চেয়েও কম দামে তা বিক্রি করে ঘরে ফেরেন।

সবজি বিক্রেতা হিসেবে খিলগাঁওয়ে কালুর বেশ নামডাক ছিল। ভ্যানে সবজি বিক্রি করে ভালোই চলছিল সংসার। বাসাবাড়ির গৃহিণীরা যেন তার ডাকের অপেক্ষাতেই থাকতেন। কখন আসবে কালু?

কয়েক মাস আগে তার বুকে দুটি ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসার পর ডাক্তারের পরামর্শ মতো এখন বিশ্রামে আছেন। ইতোমধ্যে একটি ব্লকের অপারেশন করিয়েছেন। এতে বেশকিছু টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। হাতে তেমন কোনো টাকা-পয়সা নেই। এই দুর্যোগ সময়ে ডাক্তারও দেখাতে পারছে না। তাই ওষুধ খাওয়াও এক রকম বন্ধ রয়েছে।

কালু এখনো স্বপ্ন দেখেন, সুস্থ হয়ে আবার সবজি বিক্রি করার। সেটি ভ্যানে করে সম্ভব না হলেও কোনো একটি নির্ধারিত জায়গায় বসে করবার।

ইফতারের সামান্য সময় বাকি থাকতে আপেল বিক্রেতা রমজান ভ্যান গোছাতে শুরু করেন। সামান্য কিছু আপেল অবশিষ্ট আছে আর দু'তিনজন ক্রেতার ভিড়। তাদের মধ্যে একজন মাত্র ৭৫ টাকা কেজিতে পুরো সাড়ে তিন কেজি আপেল কিনে নিলেন।

রমজান বলেন, প্রতিদিনই ইফতারের আগে এমন হয়ে থাকে।

কয়েক বছর আগেও নগরীতে ভ্যানে করে শুধুমাত্র সবজি বিক্রি করতে দেখা যেত। কিছুদিন পর মুদি সামগ্রীর পাশাপাশি ফলমূলও বিক্রি শুরু হয় ভ্যানে। এই সময়  বিস্কুট, ডিমও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। শুধু খাদ্যসমাগ্রীই নয়, নিত্যব্যবহার্য জিনিসও ঠাঁই নিয়েছে ভ্যানে; শার্ট-প্যান্ট, থান কাপড় আরো কতো কি!