ছবি – বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
বাবা ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে তারা থাকতেন রাজধানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে। পাঁচ বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সাদেক বাচ্চু। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। বড় ছেলের বয়স তখন ১৫ বছরের মত; এদিকে ১৮ বছরের নিচে সরকারি চাকরি হয় না। শেষে বিশেষ বিচেনায় নিত্যদিনের আয়ে (ডেইলি বেসিস) ডাক বিভাগে তার চাকরি হয়।শর্ত থাকে, ১৮ বছর পূর্ণ হলে মিলবে মূল চাকরি। তিন বছর পর চাকরি পাকা হল।
টিঅ্যান্ডটির পোস্টাল কলোনিতে বাবার স্মৃতি জাগানিয়া ঘরেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রামের শুরু। দিনে চাকরি করে পড়াশোনা চালাতে টিঅ্যান্ডটি কলেজে রাতের শাখায় ভর্তি হলেন। এক সময় যুক্ত হলেন স্থানীয় মতিঝিল থিয়েটারের সঙ্গে। একটু একটু করে জীবনের অর্ধেকটা সময়ই কাটিয়ে দিলেন কলোনিতে। এ সময়ের মধ্যে 'আপনার চেয়েও আপন' হয়ে উঠলেন কলোনির মানুষের কাছে। কারো কারো কাছে পরম আত্মীয়।
পোস্টাল কলোনির এফ-২/৭ নম্বর বাসা। ছবি – বোরহান বিশ্বাস
মঞ্চ নাটক থেকে উঠে আসা সফল অভিনেতা সাদেক বাচ্চুর যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে টিঅ্যান্ডটি কলোনির মতিঝিল থিয়েটারের সঙ্গে। মতিঝিল থিয়েটারে তাকে নিয়ে এসেছিলেন নাট্য সংগঠক শফিক উল্লাহ দুলাল।
সেই সময়ের কথা জানতে চাইলে শফিক উল্লাহ দুলাল বললেন, "টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে 'ভ্রাতৃ সংঘ' নামে আমাদের একটি ক্লাব ছিল। এটি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটার সেক্রেটারি ছিলাম আমি।
"সেখান থেকে আমরা বাৎসরিক তিনটি নাটক করতাম। আখতার ভাই (আখতার খান) সেই নাটকগুলো নির্দেশনা দিতেন। তাকে সামনে রেখেই নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে ১৯৮৪ সালের ১০ নভেম্বর আমরা মতিঝিল থিয়েটার গঠন করি। এর প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি ছিলেন মীর মো. রুহুল আমিন আলম। আমি ছিলাম কার্যকরি কমিটির সদস্য। শামসুজ্জামান, বেলাল, মোসলেম, লিটনসহ প্রায় ২০ জনের মতো সদস্য নিয়ে কাজ শুরু করি।"
সাদেক বাচ্চুর তখন বেশ নামডাক। তিনি থাকতেন পোস্টাল কলোনির এফ-২/৭ নম্বরে। আর শফিক উল্লাহ দুলাল থাকতেন এফ-৫/১ নম্বর বিল্ডিংয়ে।
"মতিঝিল থিয়েটারে আনতে দু'বছর তার পেছনে সময় দিয়েছি। একই অফিসে চাকরির সুবাদে এবং একই কলোনির বাসিন্দা হওয়ায় তিনি আমার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি", স্মৃতির পাতা থেকে বললেন শফিক উল্লাহ দুলাল।
তার কথাতেই ১৯৮৯ সালে সাদেক বাচ্চু মতিঝিল থিয়েটারে যোগ দেন।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সামনের গেট (পোস্টাল গেট)। ছবি – বোরহান বিশ্বাস
শফিক উল্লাহ দুলাল বলেন, "১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার নির্দেশনায় আমরা 'ক্ষুদিরামের মা' নাটকটি মঞ্চস্থ করি। ওই বছরের নভেম্বরে বাচ্চু ভাইয়ের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় 'কতদিন এই দিন'। তুমুল দর্শকপ্রিতা পায় নাটকটি। পরের কয়েক বছর মতিঝিল থিয়েটারের জন্য ছিল স্বর্ণ সময়।"
তিনি বলেন, "মাঝে বেশকিছু বছর চলচ্চিত্র, টিভি নাটকসহ নানামুখি ব্যস্ততায় ছিলেন বাচ্চু ভাই।"
২০১৫ সালের কথা। দু'জনই তখন চাকরি থেকে অবসরে।
একদিন শফিক উল্লাহ দুলালকে জড়িয়ে ধরে সাদেক বাচ্চু বললেন, "তোর বুকও কাটা, আমার বুকও কাটা (দু'জনেরই বুকে রিং পরানো ছিল)। আয় আমরা আবার বুকে বুক মিলিয়ে মঞ্চে একসঙ্গে কাজ শুরু করি।"
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সামনের গেট (পোস্টাল গেট)। ছবি – বোরহান বিশ্বাস
"শুরু করেছিলাম একসঙ্গেই, কিন্তু বাচ্চু ভাই চলে গেলেন। যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না", আপ্লুত কণ্ঠে বললেন শফিক উল্লাহ দুলাল।
অভিনেতা হিসেবে নয়, কলোনির বড় ভাই হিসেবে সাদেক বাচ্চুকে অনেক দিন ধরে চিনতেন মো. নিজাম উদ্দিন নবী। নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তার সঙ্গে।
নবী বলেন, "সেই ছোট বেলা থেকে বাচ্চু ভাইকে দেখে এসেছি। কলোনির সবাই তাকে বড় ভাই বলে ডাকতো। জীবনে কাউকে তুই করে বলতে শুনিনি। কাউকে অসম্মান করে কথা বলতে দেখিনি।"
সাদেক বাচ্চুর ছোট ভাই উদয়ের বন্ধু নিজাম উদ্দিন নবী। সেই সুবাদেও সাদেক বাচ্চুদের বাসায় যাওয়া-আসা ছিল।
নবী বললেন, "মতিঝিল থিয়েটারের সরাসরি সদস্য না হলেও দলের অনেক কাজই বাচ্চু ভাই আমাকে দিয়ে করাতেন। নাটকের আগে পত্রিকা অফিসে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠাতেন।
"বাচ্চু ভাইয়ের কারণে চলচ্চিত্রাভিনেতা লিয়াকত তাম্বুরা, শাহীন আলম, শুভ্রা আপা, ব্ল্যাক আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্রের মানুষ মতিঝিল থিয়েটারে এসেছিলেন। আমার বড় ভাই বেলাল মতিঝিল থিয়েটারের সদস্য ছিলেন। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে মঞ্চে অনেক দিন কাজ করেছেন।"
মহামারী দেখা দেওয়ার আগেও মানকিগঞ্জের ঘিওরে নিজাম উদ্দিন নবীর বড় ভাই বেলালের শ্বশুর বাড়িতে শুটিং করেছেন সাদেক বাচ্ছু; থেকেছেনও।
এক সময়ের 'ভ্রাতৃ সংঘ ক্লাব। ছবি – বোরহান বিশ্বাস
সাদেক বাচ্চুর সঙ্গে সামাজিক কাজে অংশ নেওয়ার স্মৃতি মনে করে নবী বলেন, "১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় ক্লাব ও থিয়েটারের পক্ষ থেকে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ দিয়েছি।
"এলাকার গরীব ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিতেন তিনি। ক্লাবের পক্ষ থেকে বিবাহযোগ্য অস্বচ্ছল মেয়ের পরিবারকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন।"
গত ১৪ সেপ্টেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৬৬ বছর বয়সী অভিনেতা সাদেক বাচ্চু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মারা যাওয়ার আগে সুস্থ থাকাকালে তার সঙ্গে একদিন জিপিওতে দেখা হয় নবীর। পেনশনের টাকা তুলতে গিয়েছিলেন।
দেখা হওয়ার পর সাদেক বাচ্চু বলেন, "কি রে নবী, ফোন দ্যাশ না কেন?"
ওইদিনের কথা মনে করে নবী বলেন, "আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। আসলে বাচ্চু ভাই অবসরে যাওয়ার পর কলোনি ছেড়ে পরিবার নিয়ে রামপুরার বনশ্রী চলে যান। এজন্য তার সঙ্গে যোগাযোগটা একটু কমে গিয়েছিল।
"মনে পড়ে, বাচ্চু ভাই রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের সামনের গেটটি (পোস্টাল গেট) দিয়েই বেশি যাওয়া আসা করতেন। প্রধান সড়কের ওই গেটটি তার বাসা থেকে সামান্য দূরে ছিল। নিচতলার ওই বাসাতেই তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন।"
সাদেক বাচ্চুর বাসার বারান্দা। ছবি – বোরহান বিশ্বাস
নবীর ভাষ্যে, অসুস্থ অবস্থায় কিংবা বিশ্রামে নিতে প্রায়ই বাসার বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকতেন সাদেক বাচ্চু।
তিনি বলেন, "বাচ্চু ভাই মারা যাওয়ার পর কলোনির সবাই ভেবেছিলেন তার মরদেহ কলোনিতে নিয়ে আসা হবে। তাই পুরনো বন্ধু, স্বজন, নাট্যকর্মীদের অনেকে কলোনিতে এসেছিলেন তাকে শেষবারের মতো দেখতে। কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়ায় মরদহে আর এখানে আনা হয়নি।"