২০ মিলিয়ন ডলার, টাকার জোরে কি বেঁচে যাবে ওরা?

বি স্যানাল
Published : 1 Oct 2012, 07:47 PM
Updated : 1 Oct 2012, 07:47 PM

কথায় আছে, টাকায় কি না হয়? আর সেই টাকা যদি দুর্বৃত্তের হাতে আসে তাহলে ইচ্ছেমতো অপকর্ম সাধন ও তা করে পার পেয়ে যেতে পারে তারা। আর আমাদের দেশে যদি টাকাওয়ালার পরিসংখ্যান নেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে এখানে টাকার মালিক যারা হয়েছে তাদের অনেকেই দুর্বৃত্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর যখন দেশগড়ায় মনোনিবেশ করেছিল এই মাটির স্বাপ্নিকেরা-যখন চলছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্নিমাণের সংগ্রাম তখন বা তারই একটি পর্যায় ১৯৭৫ সালের সেই ১৫ অগাস্ট পাল্টে যায় এখানকার ইতিহাস। সামরিক কুর্দি পরা কয়েক সেনা কর্মকর্তার হাতে এ দেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর বিলুপ্ত হয় সে ধারা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাজনীতিকের হাত থেকে চলে যায় স্বৈরশাসকদের হাতে-বাংলাদেশে পুনর্বাসিত হয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা যারা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নিজের ভাই-মা'র ওপর নির্যাতন করেছিল, যারা সহায়তা করেছিল নিজেরই ঘরের বোনকে পাকিস্তানিদের ধর্ষণে, যারা পান করেছিল নিজের ভাইয়ের রক্ত- সেই সব দুর্বৃত্ত নতুনভাবে এদেশে ঘাঁটি গাড়ে। মাঝে সৌদি আরবে পালিয়ে থাকার সময় মধ্যপ্রাচ্যের বড় বড় মালদারের সঙ্গে খাতির করে আসে- ইসলাম রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছেন বুঝিয়ে। এবার দেশে আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেল বিক্রির ওই ডলারের ভাগ পায় তারা। এছাড়া স্বৈরশাসনের সুবিধাভোগী হয়ে এদেশে গড়ে তোলে একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান- হয়ে ওঠে শিল্পপতি- কোটিপতি- সে রকমই একজন নয়া দিগন্ত পত্রিকা ও দিগন্ত টেলিভিশনের মালিক মীর কাসেম আলী। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটকের পর তাকে 'বিশেষ মর্যাদায়' কারাগারে ডিভিশন দেয়া হয়েছে। অথচ এই কাসেম আলী ছিলেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী আল-বদরের চট্টগ্রামের অপারেশন কমান্ডার। তখন তার নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন টিএন্ডটি অফিসের পিছনের সড়কে একটি হিন্দু পরিবারের মালিকানার 'মহামায়া ভবন' দখল করে তার নাম দেয় ডালিম হোটেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ডালিম হোটেলেই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীসহ বহু মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে বদর বাহিনীর সদস্যরা। চট্টগ্রামের ইংরেজি দৈনিক পিপলস ভিউর নির্বাহী সম্পাদক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ওই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর ওই ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নাসিরুদ্দিনের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু দিন আগে বিডিনিউজে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, "আমাকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলের একটি অন্ধকার কক্ষে অন্য বন্দিদের সঙ্গে চোখ বেঁধে রাখা হয়। প্রচণ্ড মারধর করে আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চাইতো তারা। ওই হোটেলে সারাক্ষণ বন্দিদের ওপর নির্যাতন আর নির্যাতিতদের চিৎকার-কান্নাকাটি চলতো। এই নির্যাতনের মূল পাণ্ডা ছিলেন মীর কাসেম আলী।" আরেক নির্যাতিত সাইফুদ্দিন খানের বর্ণনায় পাওয়া যায় অমানবিক নির্যাতনের এক চিত্র। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তৎকালীন স্থানীয় ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রামের নেতা হান্নানা বেগমের ভাই মুক্তিযোদ্ধা জসীম উদ্দিনকে এবং নন্দনকানন এলাকার রাহার পুকুর পাড়ের টাইপ মেশিন দোকানের মালিক জীবনকৃষ্ণ শীলকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে বদর বাহিনী। ওই হোটেলে বন্দিদের প্রথম তিন দিন কোনো খাবার না দিয়ে প্রসব খেতে দেওয়া হতো বলেও জানান তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই পালিয়ে সৌদি আরব যায় ওই ডালিম হোটেলের পরিচালক মীর কাসেম আলী। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক উর্দি পরা জেনারেল জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাজাকারদের দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন শুরু করলে দেশে ফেরে রাজাকার কাসেম। আর ওই কাসেম আলীই এখন ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংকসহ কতগুলো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তার রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আর ওই টাকাই তিনি ঢালছেন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধকে ঢাকতে। তারই ইঙ্গিত মিলেছে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। গত শনিবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ '৭১-এর নতুন গঠিত নারী কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, "গত ৪০ বছরে যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতার অংশীদার হয়ে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। তারা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে বিদেশি মধ্যস্ততাকারী (লবিস্ট) নিয়োগ দিচ্ছে। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে, অপরাধ-সম্পর্কিত আইনে অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই।"

অথচ বিদ্যমান আইনে অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে যা আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম দেখে সাদা চোখেই বুঝতে পারছি এবং তা কারো কাছেই অবিদিত নয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধেও আসামিপক্ষের আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে আইনে। কিন্তু টাকার জোরে বিশ্ব ব্যাপী ওই অপপ্রচার চালিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করার এই অপচেষ্টার তথ্য-প্রমাণ হাতে রয়েছে বলেও আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। আর বিদেশি ওই লবিস্ট গ্রুপগুলো টাকার জন্য এমন কিছু নেই যে, তারা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবিষ্টরা প্রভাবশালী হওয়ায় বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েলি সেনাদের বুলেটে ফিলিস্তিনিদের বুক ঝাঁজরা হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনি গুলিবর্ষণকারী ইহুদি সেনার দিকে একটি পাথর ছুড়লে তা বড় অপরাধের হয়ে যায়। ফিলিস্তিনিদের ভূমি গায়ের জোরে ইসরায়েল দখল করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা। আর এর প্রধান কারণ ইহুদি লবি। ওই লবির বিরাগভাজন হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আসনই নড়বড়ে হয়ে ওঠে। আর এবার সে ধরনেরই লবিস্ট নিয়োগ করছে মীর কাসেম আলী গং। একাত্তরের কসাই নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা ও মীর কাসেম আলীকে রক্ষা করতে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। আর এর নমুনাও দেখা গেছে ইতোমধ্যে। একটি ব্রিটিশ দৈনিকে তো যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সাঈদীর বিচারের কার্যক্রম চালাতে এদেশে আসার চেষ্টা করে ফিরে গেছে তিন বিদেশি আইনজীবী। তারাও এ বিষয়ে নানা অপপ্রচার চালানোতে তৎপর রয়েছে। তাই টাকার জোরে একাত্তরের ওই অপরাধীরা যাতে পার না পেয়ে যায় সেদিকে আমাদের সবার নজর দিতে হবে। সরকার যেহেতু এ বিষয়ে জানতে পেরেছে তাই তাদের উচিত হবে সেই পথ রুদ্ধ করা। আর আমাদের অর্থাৎ আমরা যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই তাদের উচিত হবে, এই প্রক্রিয়া যাতে নস্যাৎ না হয় সেজন্য তৎপর থাকা। আশা করি- একাত্তরের রক্তপিপাসুদের রক্তে শোধ হবে শহীদের রক্তঋণ।